ব্যস্ত শহরের মাঝে ছায়ায় ঘেরা পাখির কলতানে মুখর নির্মল একটি গ্রাম। ফুল, পাখি ও নদীর নামে সেখানকার ঘরগুলোর নাম। মমতায়, যত্নে অবাধ সম্ভাবনা বুকে নিয়ে বেড়ে ওঠে গাঁয়ের বাসিন্দারা। মাথা গোঁজার জন্যে তারা পায় নিরাপদ আশ্রয়, বিকশিত হবার জন্যে পায় ভালোবাসা। আর জীবনধারণের জন্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ অক্সিজেন।
শেষ বিকেলের কোমল আলোয় খেলার মাঠের হুটোপুটি ছেড়ে, ধুলি-ধুলো মেখে যার যার নীড়ে ফেরে ওরা। যেখানে ওদের অপেক্ষায় আছে 'মা'। মাথার উপরে সদ্য ছেয়ে যাওয়া মুকুলের ভারে নুয়ে পড়া বুড়ো একেকটা আম গাছ, তাদের মন-মাতানো আদি চেনা গন্ধ ছুঁয়ে যায় আমাদের ভেতর পর্যন্ত। কথা হচ্ছিল এক মায়ের সাথে - 'আমার দুই ইঞ্জিনিয়ার ছেলে আমেরিকায় থাকে। প্রতি সপ্তাহে ছেলে-বউ, নাতি-নাতনির সাথে কথা হয়।
এক মেয়ে থাকে ইতালি, মেয়ে-জামাই দু'জনেই ডাক্তার। এক মেয়ে রাজশাহী ইউনিভারসিটিতে ফিলোসফিতে পড়ছে, ওকে বলেছি স্কলারশীপের চেষ্টা করতে। এমনিতেই ওর রেজাল্ট বরাবরই ভালো। ' এভাবেই গর্ব আর আত্নবিশ্বাসের সাথে নিজের ছেলে-মেয়েদের কথা বর্ণনা করে যাচ্ছিল আরিফা, শরিফার 'আম্মা' সালমা বেগম।
নওশীন, আরিফা এবং শরিফা
শরিফা, নওশিন রাজশাহী পি এন স্কুল থেকে এবার এসএসসি দিচ্ছে।
পরীক্ষা কেমন হচ্ছে জিজ্ঞেস করায় বলল, 'ভালই'। 'পরীক্ষা শেষে লম্বা বিরতিতে কি করবা?' জিজ্ঞেস করলাম। বলল, 'আমাদের ক্লাবে এক্সট্রা-কারিকুলাম এক্টিভিটির অনেক সুযোগ আছে। লাইব্রেরীতে আছে প্রচুর বই। আর মাসে এক থেকে দুবার থাকে আউটিং।
সামনে পহেলা বৈশাখের প্রোগ্রাম, ২৩ শে জুন প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী তার প্রস্তুতি, সময় কই!' আম্মা সালমা বেগম মেয়েদের কথায় সায় দিয়ে বললেন, 'আমার ছেলে-মেয়েরা কেউ নাচ জানে তো কেউ গান, কেউ ছবি আঁকা, আবৃত্তি নয়বা কেউ হাতের কাজে পারদর্শী। '
ছোট্ট জাকিরের কথা বলা হয়নি। যাকে সবাই আদর করে ডাকে 'জেরী'। বয়স নয় মাস। আপাতত সেই সবচেয়ে ক্ষুদে আর আদরের সদস্য এই গ্রামে।
চোখে চোখ পড়লে ফিক করে মন গলানো এক টুকরো হাসি, আর কোলে নিতে চাইলে হতাশ না করে লাফিয়ে আসা। জেনে অবাক হলাম কোল ভরে থাকা হাসি-খুশি এই শিশুটি যখন এখানে আসে তখন ভয়ঙ্কর অপুষ্টিতে ভুগছিল। তিন মাসে তার ওজন ছিল তিন কেজিরও কম। তাই ভাই-বোনেরা দুষ্টুমি করে বলে জ়েরী এসেছিল দেশি মুরগির মত, এখন হয়েছে ফার্মের মুরগি। দেখলাম ফুটফুটে জমজ দুই বোনকে।
বয়স আট থেকে নয়ের ভেতর। ওরা এখানে এসেছিল যখন ওদের বয়স মাত্র একদিন!
আম্মা সালমার গল্প শেষ হয়নি। সালমা বেগম রাজশাহী এসওএস এর চিলড্রেন'স ভিলেজের এই এক কোয়েল হাউজেই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের মূল্যবান ২৬ টি বছর। তার মাতৃত্বের ছায়ায় বেড়ে উঠে সাবলম্বী হয়ে পৃথিবীর নানা স্থানে ছড়িয়ে আছে তার একাধিক সন্তান। যারা এখনো তাকে স্মরণ করে গাঢ় কৃতজ্ঞতাবোধ ও ভালবাসা থেকে।
কিন্তু আম্মার তো স্বস্তির সময় নেই! একই নিষ্ঠার সাথে মেতে আছে সে তার অন্য সন্তানদের নিয়ে। মাতৃত্ব এমনই এক বন্ধনের নাম যাকে পেশা বলে খাটো করার সুযোগ নেই। তাই হয়ত সালমার মত মায়ের নিজের দিকে তাকানোর ফুরসত হয়নি। জড়ানোও হয়নি স্বামী, সংসারের মত গতানুগতিক বন্ধনগুলোতে। পাশের দোয়েল হাউজের নওশিনের মা এই এসওএস এ ছিল তারো আগে থেকে, ৩০ বছর একনিষ্ঠ দায়িত্ব পালনের পর তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
নিজের মায়ের কথা বলতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি নওশিন।
আম্মা সালমার কোলে আমার তিন মাসের মেয়ে
আমার তিন মাসের মেয়ে আর সাত বছরের ছেলের মাথায় এই মহিয়সী নারীর হাতের ছোঁয়া নিলাম। আর নিজের জন্যে চাইলাম শুধু এইটুকুই দোয়া যেন আমি তার মত একজন গর্বিত মা হতে পারি।
এভাবেই এক বাসা থেকে আরেক বাসা, এতোসব স্বর্গের ফুল দেখতে দেখতে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল, খেয়াল করি নাই। নিজের রক্তের আত্নীয় থেকে দুরে অনাথ অথবা বাবা-মা পরিত্যক্ত এসব শিশুরা সহজাতভাবেই নিজেদের মধ্যে এমন এক আত্নীয়তা গড়ে নেয় যা তাদের কাছে পৃথিবীর অন্য যেকোন সম্পর্কের চেয়ে বড়।
ওরা যেমন ভালোবাসে বৃত্তের কেন্দ্রে বটবৃক্ষের মত ছেয়ে থাকা 'মা'টিকে, তেমনি ভালোবাসে একই রেখায় আবর্তিত হতে থাকা অন্য ভাইবোনগুলোকে। গ্রাম পরিদর্শনে আসা বহিরাগত থেকে শুরু করে সদ্য সদস্য হয়ে আসা শিশুটিকেও তারা গ্রহন করে অকৃতিম আন্তরিকতায়। বাড়িতে কখনও অতিথি এলে ওরা আপ্যায়ন করে হাতের বানানো পিঠা, মিষ্টি বা ডোনাট দিয়ে।
মনের ভিতরে অদ্ভুত ঘোর লাগা প্রশান্তি নিয়ে ফিরে এলাম রাজশাহী এসওএস চিলড্রেন'স ভিলেজ থেকে। কোন মন্দির, মসজিদ অথবা তীর্থ দর্শনেও এতটা পূণ্য পবিত্র অনুভূতি হয় কিনা আমার জানা নেই!
সংক্ষেপে রাজশাহী এসওএস চিলড্রেন'স ভিলেজঃ প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৭৮।
রাজশাহী এসওএস চিলড্রেন'স ভিলেজে ১৫টি বাসায় বর্তমানে প্রায় ১৫০ জন শিশু রয়েছে। প্রতিটি বাসা একই পরিধি ও আদলে তৈ্রী। ৫টি ফুল,৫টি পাখি আর ৫টি নদীর নামে বাসাগুলোর নাম। ওরা বলে - ফুলপাড়া, পাখিপাড়া আর নদীপাড়া। প্রতিটি বাসায় ১০ থেকে ১২ জন শিশুর দেখাশুনার দায়িত্ব একজন মায়ের উপর, মাকে সাহায্যের জন্যে থাকে খালারাও।
প্রতিটি বাসায় বাচ্চাদের থাকার ঘর, বড় হলঘর, রান্নাঘর ও মায়ের জন্যে একটি আলাদা ঘর আছে (যদিও সে ঘরটি প্রায় অব্যবহৃত থেকে যায়)। এছাড়াও এ শিশু পল্লীটিতে রয়েছে সবার জন্যে রয়েছে বড় পড়ার ঘর, লাইব্রেরী, ক্লাব ও খেলার মাঠ। পুরো গ্রামটি বড় বড় আমগাছের ছায়ায় ঘেরা, নানা রঙের ফুল ও পাখির কিচিমিচিতে মুখর।
বাংলাদেশ ও এসওএসঃ নয় মাসের যুদ্ধে পুরো বিধ্বস্ত একটি দেশে অসংখ্য গৃহহীন, যুদ্ধে অনাথ ও ওয়ার-চাইল্ডের চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে এসওএস ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া, সিলেট ও চট্টগ্রামে মোট ছয়টি এরকম এসওএস এর চিলড্রেন'স ভিলেজ আছে।
হার্মান মেইনার (Hermann Gmeiner) ও এসওএস চিল্ড্রেন'স ভিলেজঃ "from my point of view, nothing in the world is more important than careful and protect a child." এবং যা তিনি উপলদ্ধি করেছিলেন নিজের জীবন থেকে - শৈশবে মা হারানো মেইনার যুদ্ধের ভয়াবহতা শিশুদের উপর কতটা প্রভাব ফেলে তা হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন রাশিয়ায় তার সৈনিক জীবনেই। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে অনাথ, দুঃস্থ, গৃহহীন শিশুদের হয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন। তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে, কোন অনুদানই সেসব শিশুদের অসাহায়ত্ব মোচনে অবদান রাখতে পারে না, যদি তাদের একটি নিরাপদ আশ্রয়ে সুষ্ঠভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করা না যায়। মূলত তার সেই ধারনাই তিনি বাস্তবে রূপ দিয়েছেন এসওএস চিলড্রেন'স ভিলেজের মাধ্যমে। ১৯৪৯ সাল থেকে যেখানে গৃহহীন, অনাথ অথবা যেসব শিশুদের বাবা-মা তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পুরনে অপারগ তাদের একটি নিরাপদ আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা সহ শিক্ষা, চিকিতসা নিশ্চতকরনের পাশাপাশি পরবর্তীতে নানারকম ভোকেশনাল ও কারিগরি ট্রেনিং এর মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা হয়।
অর্থাত একটি শিশু ততদিন এসওএস এর আওতায় থাকে যতদিন না সে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। বর্তমানে ১৩৩টি দেশে ৬২০০০ শিশু ৫৪৫টি চিলড্রেন ভিলেজের ছত্রছায়ায় অবাধ সম্ভবনায় নিজেদের বিকশিত করে চলেছে।
পৃথিবীর বাতাস যখন দ্রুত এত ভারি হয়ে উঠছে, সেখানে কিছু মহৎ মানুষ তাদের মহত্বের উদাহরণ দিয়ে এখনো কিছু অক্সিজেন সাপ্লাই করে যাচ্ছে। যেকারণে আমরা এখনো শ্বাস নিতে পারি। চাইলেই খুব সহজেই এই মহৎ প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারি আমি, আপনি।
শিশুর চেয়ে সুন্দর আর কি হতে পারে, অন্তত একটি শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় কি আমরা অবদান রাখতে পারি না। ঘুরে আসুন একটি চিন্ড্রেন ভিলেজ থেকে, নিজ চোখে দেখে আসুন তাদের। আডোপশন বা ডোনেশনের জন্যে - http://www.sos-childrensvillages.org/what-you-can-do
হারমান মেইনার, ডেভিড শেলড্রিক এর মত মানুষদের প্রতি আমার শুধুই কৃতজ্ঞতা।
ছোট্ট জাকির
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।