আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমাপ্তি

দুবন্ধু যেন মানিকজোড় । আলো আর মিঠুর প্রগাঢ় বন্ধুত্বের কথা হলের সবাই মায় ইউনিভার্সিটির অনেকেই জানে । দুজনেই হলে থাকেনা । আলো হলে থাকে । বহু দূরের এক উপজেলায় ওর গ্রামের বাড়ি ।

ইউনিভার্সিটির পাশেই মিঠুদের বাড়ি । বাড়ি প্রায় প্রাসাদের মত । কয়েক একর জুড়ে ফল ফলাদির বাগান , পুকুর- তাতে বাঁধান ঘাট । অনেক বড় দোতলা বিল্ডিং । অসংখ্য রুম ।

অথচ পরিবারের মূল সদস্য সংখ্যা মাত্র চারজন । মা বাবা, মিঠু আর তার ছোট বোন রুমা । ওদের গ্রামের বাড়ি কয়েক মাইল ভেতরে । আলো হলে উঠার পর অল্প সময়েই মিঠুর সাথে ঘনিষ্ঠ সখ্য গড়ে উঠল । আলো নিয়মিত ওদের বাসায় যাওয়া আসা করে ।

কিছু সময়ের ব্যবধানে এমন হয় মনে হতে পারে আলো বুঝি এ বাড়িরই ছেলে । মিঠুর মা ওকে খুবই স্নেহ করেন । কিছু না খাইয়ে কখনোই ছাড়েন না । ছুটির দিনেতো খালাম্মার সামনে বসে খাওয়া অত্যাবশ্যকীয় । এদিন উনি বিশেষ আইটেম রেঁধে থাকেন ।

খালাম্মার হাতের ভূনা খিঁচুড়ি আলোর অতিশয় পছন্দ । সাথে যদি গরুর গোশত ভূনা থাকে তাহলেতো কথাই নেই । সে এক অপূর্ব স্বাদের কম্বিনেশন । প্লেটে খিঁচুড়ি গোশত নিয়ে তার উপর সুগন্ধি লেবুর রস চিপে নাও । এক গ্রাস মুখে নিয়ে কচ করে কামড় বসাও কাঁচা মরিচে ।

আহা স্বাদ ! খালাম্মা প্রায়ই নানান পিঠা পুলি তৈরী করেন । মাঝে মাঝে পায়েস রাঁধেন । খেজুড়ের গুড়ের তৈরী সেই পায়েশ যেন অমৃত । খালাম্মা কাজ কাম না থাকলে আলোর সাথে গল্প করেন । উনি এক নম্বর শ্রোতা এবং বক্তা ।

আলোর গ্রামের , তার পরিবারের গল্প মন দিয়ে শোনেন । দুঃখের জায়গায় ‘আহারে’ বলেন । আবার আনন্দের কথা এলে তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে । আলোর নিজের গল্প শোনাতে ভালই লাগে । সে খালাম্মাকে মায়ের সংগ্রামের কাহিনী বলে ।

আলোদের অভাবের সংসার । ভালই অভাব । বাবা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক । অতি অল্প বেতন পান । সামান্য জম জমা আছে ।

সেসব বর্গা দেয়া । সামান্য ধান গম পান । অথচ ওরা চার ভাই বোন । সবাই পড়া লেখা করে । আলোর ইমিডিয়েট ছোট বোনটা এবার এসএসসি পাশ করেছে ।

তার পরেরটাও বোন । ক্লাশ নাইনের ছাত্রী । একদম ছোট ভাইটা সিক্সে পড়ে । খরচান্ত ব্যাপার । মা শক্ত হাতে হাল ধরে আছেন ।

তিনি অতি বুদ্ধিমতি ও হিসেবি মহিলা । ঠিকই সব সামলে নিচ্ছেন । ওদের কখনো সবজি কিনতে হয়না । মা ঘরের চারপাশে চাষ করেন । মায়ের লাউএর জাংলায় ঝুলে থাকা কচি লাউ গুলোর দিকে তাকালে মন ভরে যায় ।

কি সুন্দর শরীর ওগুলোর । কুমড়ো, শশা, ধুন্দুল, পুঁই- আরো কত কি । মা অনেক হাঁস মুরগী পোষেন । ডিম গোশতের অভাব নেই । এসব ওরা বাজারেও বেঁচে থাকে ।

মায়ের রান্নাও অতি সুস্বাদু । লাউএর সব কিছুই উনি কাজে লাগান । বাকল কুচি করে ভাজি করেন । স্বাদ মন্দনা । লাউএর বয়স বেশি হলে এর বীচিগুলো একটু শক্ত হয় ।

মা ওগুলো আলাদা করে বেঁটে চাটনী বানান । ভাতের সাথে বেশ লাগে । কাচকলার বাকলে সুস্বাদু ভর্তা তৈরী হয় । মায়ের কথা বলতে বলতে আলোর গলা ধরে আসে । মাকে কতদিন দেখেনা ।

কিযে মায়া মায়ের । কথায় মায়া , দেখায় মায়া , তার কাছে থাকাই যেন সুখের –নির্ভরতার । খালাম্মারও অনেক মায়া । আলোর মনে হয় খালাম্মাকে না পেলে এখানকার জীবন ওর অনেক কষ্টের হত । আসলে মহিলারাই মায়ার জাত ।

ওদের হৃদয় ভরা মায়া দয়া । এইযে রুমা , মিঠুর বোন । আলো কিছু খেতে না চাইলে সেও খেতে চাপাচাপি করে । ভালই কাটছে তার পরিবার ছেড়ে আসা এ ছাত্রজীবন । মিঠুদের পরিবারের একটাই দুঃখ ।

রুমা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ কম দেখে । ডাক্তার বলেছে ধীরে ধীরে ওর দৃষ্টি শক্তি আরো কমে যাবে । এনিয়ে ওদের পরিবারের সবাই চিন্তিত । ডাক্তার দেখান হচ্ছে । ঢাকায় নিয়েও বেশ কবার ডাক্তার দেখান হয়েছে ।

তেমন ভাল কোন ফল পাওয়া যাচ্ছেনা । রুমা দেখতে বেশ সুন্দরী । নিষ্পাপ মায়া মায়া চেহারা । হ্যাংলা পাতলা শরীর । গায়ের রঙ বেশ ফর্সা ।

চোখে ভারী লেন্সের চশমা । এপাশ থেকে চোখ গুলো অন্যরকম লাগে । চশমা ছাড়া ওকে দেখেছে আলো । রুমার চোখ দুটো কি সুন্দর ! মায়াভরা ! ভেবে খুব কষ্ট হয় আলোর । মেয়েটি প্রকৃতি ভীষন পছন্দ করে ।

প্রায়ই বিকেলে নদীর পাড়ে বেড়াতে যেতে চায় । মিঠুর কাছে আবদার করে নিয়ে যেতে । একা একা যায় না ও । মিঠুর সাথে যায় । সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর মিঠু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ।

ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে । ক্লাশের পরও ক্যাম্পাসে সময় দিতে হয় । এখন আর চাইলেই রূমাকে সবসময় নদীর পাড়ে বেড়াতে নিতে পারেনা । এতে রুমা বেশ মন খারাপ করে । আলোর রাজনীতির ঝোঁক নেই ।

সে আগের মতই ফ্রী । সে একদিন বলল, ‘ খালাম্মা , আমিতো ফ্রীই থাকি । আমিই না হয় রুমাকে বেড়াতে নিয়ে যাই । ’ খালাম্মা বললেন, ‘ বেশতো । ও যদি যায় নিয়ে যাও না ।

’ আলো রুমাকে ওর ইচ্ছে আর খালাম্মার অনুমতির কথা জানাল । সে সানন্দেই বেড়াতে যেতে রাজী হল । বাসা থেকে এক মাইল দূরে নদী । বেশ নিরিবিলি । আলোর এর আগে আসাই হয় নি ।

এই প্রথম । নদীর একটা বাঁক । চমৎকার দৃশ্য । পাড়ে ঘাস উঠা জায়গা দেখে বসল ওরা । নদীটি ভালই প্রশস্ত ।

ওপাড়ে পাড়ের কাছেই বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছে । এপাড়ে বাড়ি ঘর খানিকটা দূরে । নদীর বুকে পাল তোলা পাল ছাড়া নৌকা দেখা যাচ্ছে । পরিষ্কার স্বচ্ছ পানি । মন ভাল করে দেয়া পরিবেশ ।

রুমা নির্বাক চেয়ে আছে নদীর দিকে । চশমার ভারী লেন্সের ফাঁক দিয়ে ওর মুগ্ধ দৃষ্টি বোঝা যায় । এমন ভাবে চেয়ে আছে মনে হচ্ছে এই প্রথম এত সুন্দর দৃশ্য দেখল । বড় সুন্দর কাব্যিক মন মেয়েটির । এখন আর ভাইয়ের অপেক্ষায় থাকেনা রুমা ।

আলোর সাথেই বেড়াতে বের হয় । কখনো নদীর পাড়ে কখনোবা পার্কে । বছর পেরিয়ে গেল । আলো থার্ড ইয়ারে উঠে গেল । রুমার এসএসসি পরীক্ষা ঘনিয়ে এল ।

ওর চোখের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে । সেদিন নদীর পাড়ে বসে আছে ওরা । রুমার মুখটা অন্যান্ন দিনের চেয়ে আজ বেশি ম্লান । ওর জন্য কষ্ট লাগে আলোর । ওর চেহারা ম্লান দেখে বুকের ভেতরে চিন চিন করে উঠল ।

বলল, ‘ মন খারাপ কেন রুমা ?’ অল্প কষ্টের হাসি ফুটল রুমার মুখে । বলল,’ কই মন খারাপ নাত ?’ আহত কন্ঠে বলল আলো,’ আমি বুঝতে পারি । আসলে আমিতো দূরের মানুষ , তাই আমাকে বলতে চাচ্ছনা, এইতো ?’ ‘ না ভাইয়া । আপনাকে বুঝি আমরা দূরের মানুষ ভাবি ? আসলে মন খারাপ না । আচ্ছা ভাইয়া আপনি কি রাতে নদীর পাড়ে এসেছেন ?’ ‘ হ্যাঁ, গিয়েছি ।

তবে এই নদীর পাড়ে না । দেশে । কেন বলতো ?’ ‘ দিনের বেলা নদী বয়ে চলে কিন্তু এর চলার শব্দ তেমন বোঝা যায় না । রাতে এর কুল কুল ধ্বনি শুনেছেন , কি অপূর্ব , না ?’ আলো একটু লজ্জা পেল । ও আসলে ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি ।

বলল, ‘ তাই বুঝি ? খুব সুন্দর ?’ ‘ হ্যাঁ , খুবই সুন্দর । মন দিয়ে কান পেতে শুনলে কি যে ভাল লাগে !’ আবার নীরবতা নেমে এল । কিছুক্ষণ পর রুমা আবার বলল, ‘ চাঁদনী রাতে বসেছেন নদীর পাড়ে ? নদীর বুকে আলো পড়ে কেমন নৃত্য করে তাইনা ? আলো অবাক হয়ে দেখতে থাকল, প্রকৃতি না , রুমাকে ; ওর স্বচ্ছ রুপাশ্রয়ী ভেতরটা । ও যেন ক্রমশঃ মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে । ও কি প্রেমেই পড়ে গেল মেয়েটির ? পরীক্ষার আগে আগে রুমার অবস্থা খুবই খারাপ হল ।

ডাক্তার বললেন টেনশনে এমন হচ্ছে । আলো বলল, ‘ খালাম্মা পরীক্ষার পর ওকে ভারত নিয়ে গেলে ভাল হয় । ওখানকার চিকিৎসা খুব ভাল শুনেছি । ’ মিঠুর বাবারও এমনি চিন্তা ভাবনা ছিল । সিদ্ধান্ত হল তিনি পরীক্ষার পর ভারতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবেন ।

পরীক্ষার আগের দিন আলো সন্ধার পর রুমার রিডিং রুমে ঢুকল । বই সামনে নিয়ে আনমনা হয়ে বসে আছে মেয়েটি । কি ব্যাপার পড়ছেনা কেন ! আলো চিন্তিত হল । একটা চেয়ার টেনে ওর পাশে গিয়ে বসল । জিজ্ঞেস করল, ‘ কি হল রুমা, পড়ছ না যে ?’ ‘ ভাইয়া আমিতো পড়া দেখতে পাচ্ছিনা ।

’ ঝর ঝর করে কাঁদতে শুরু করল রুমা । কি বলছে ও । আলোর বুকটা ধক করে উঠল । নিজেকে সামলে বলল, ‘ তুমি একদম চিন্তা করোনা । টেনশনে তোমার এমন হচ্ছে ।

তুমি কি বোকা মেয়ে বল ? প্লীজ, টেনশন বাদ দিয়ে পড়ায় মন দাও । ’ ‘ টেনশন না ভাইয়া , লেখাগুলো আমি দেখতেই পাচ্ছিনা । ’ কান্নার শব্দ আরো বেড়ে গেল ওর । টেবিলের উপর মাথা ঠেকিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকল । অবস্থা দেখে আলোর মাথা খারাপ হয়ে গেল ।

নিজেওযে কাঁদতে শুরু করেছে , দু চোখ বেয়ে পানি পড়ছে সেদিকে খেয়াল নেই । চেঁচিয়ে ডাকল, ‘ খালাম্মা খালাম্মা এই মিঠু । ’ তড়িঘড়ি খালাম্মা ছুটে এলেন । রুমাকে নিয়ে শুইয়ে দেয়া হল । খবর পেয়ে মিঠু এল ।

বাবা চলে এলেন । ডাক্তার এল । লেখাপড়ার চেয়ে জীবন আগে । সিদ্ধান্ত হল পরীক্ষা দেয়ার দরকার নেই । হাউমাউ করে কাঁদছে রুমা ।

মিঠুর চোখে জল । খালাম্মা শক্ত ধাঁচের মহিলা । তিনিও নিশব্দে কেঁদে চলেছেন । বাবার মুখ থমথমে । অতি কষ্টে সামলাচ্ছেন নিজেকে ।

আলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ । সে প্রায় ডাক ছেড়ে কাঁদছে । ও রুমার গা ঘেঁসে বসল । উচিৎ অনুচিৎ বিস্মরণ হয়েছে । ওর মাথায় পিঠে হাত বোলাতে লাগল ।

বলল, ‘ কাঁদেনা রুমা কাঁদেনা । ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করলে তোমার চোখ ভাল হয়ে যাবে । সামনের বছর পরীক্ষা দেবে । এক বছরে কি হবে বল ? প্লীজ কাঁদেনা লক্ষী সোনা । ’ বলে নিজেই হাউমাউ করে কেঁদে বুক ভাসাতে লাগল ।

রুমার কান্নার বেগ আরো বাড়ল । আলোর বুকে আছড়ে পড়ে বলল, ‘ ভাইয়া ভাইয়ারে আমি আর ভাল হব না । আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি । ’ ‘ না না এভাবে বল না । তুমি অবশ্যই ভাল হবে ।

’ খালাম্মা এসে মেয়েকে নিজের বুকে টেনে নিলেন । আর কিছুতেই শক্ত থাকতে পারলেন না । চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন । বাবা এক সপ্তাহের মধ্যেই মেয়েকে নিয়ে ভারত রওনা হলেন । একমাস পর ফিরে এলেন ।

সাথে নিয়ে এলেন অন্ধ মেয়েকে । রুমা সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেছে । খবর পেয়েও গেলনা আলো । ও সইতে পারবেনা । কিছুতেই না ।

রুমার সামনে গেলে ওর বুক ফেটে যাবে । সে বাথরুমে ঢুকে কেঁদে বুক ভাসাতে লাগল । রাতে খেতে ডাইনিংএ গেল না । সবার অলক্ষ্যে ছাদে গিয়ে শুয়ে রইল । পরদিন দুপুরের পর ক্লান্ত পায়ে নিজেকে টেনে নিয়ে হাজির হল মিঠুদের বাড়ির সামনে ।

সবকিছু অন্যরকম লাগছে । পরিচিত আংগিনাকে অপরিচিত মনে হচ্ছে । সৌন্দর্যের জৌলুস হারিয়ে এটি যেন বেদনার্ত ধূসর । বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠছে বার বার । খালাম্মার রুমে গিয়ে ঢুকল আলো ।

উনি নিষ্পলক চোখ মেলে সাদা ছাদের দিকে চেয়ে শুয়ে আছেন । আলোকে দেখতে পেয়ে উঠে বসলেন । তার পাশে বসে মাথায় হাত রাখল আলো । ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি । বললেন, ‘ জীবনে কারো ক্ষতি করিনিরে বাপ ।

কারো খারাপ চাইনি কোনদিন । কার পাপে কার অভিশাপে এত বড় শাস্তি পেলাম । ’ কি বলবে আলো ! খালাম্মার মাথায় কাঁপা হাত বোলাতে লাগল । নীরবে আর দীর্ঘশ্বাসে অনেক সময় কেটে গেল । এক সময় আলো বলল, ‘ খালাম্মা আমি রুমার কাছে যাই ।

ও যদি যেতে চায় তাহলে ওকে নিয়ে নদীর পাড়ে ঘুরে আসব । ’ খালাম্মা চুপ করে থাকলেন , কিছু বললেন না । রুমা উপুর হয়ে শুয়ে আছে । হয়ত ঘুমাচ্ছে । চেয়ারটা উঠিয়ে ওর শিয়রের কাছে গিয়ে বসল আলো ।

রুমা ঘুরে উঠে বসল । ‘ কে ?’ আলোর ভেতরটা কেঁপে উঠল । উত্তর দিতে গিয়েও গলার কাছে আটকে গেল । ‘কে কে ?’ আবার জিজ্ঞেস করল রুমা । অতি কষ্টে উচ্চারন করল আলো, ‘ আমি ।

’ রুমা কিছু বলল না । নির্বাক নত মুখে বসে রইল । আলোর মুখেও কথা যোগাচ্ছে না । সেও নত মুখে বসে রইল । হঠাৎ মৃদু ফোঁপানির শব্দে চেয়ে দেখল রুমা কাঁদছে ।

ওর গাল বেয়ে জল গড়াচ্ছে । রুমা বলল,’ বলেছিলাম না আমি অন্ধ হয়ে যাব ? হলামতো ?’ কি বলবে আলো ? ব্যাথায় বুকের ভেতরটা কুঁকরে আসছে । কান্নার উদগত বেগ কন্ঠকে স্তব্ধ করে ফেলেছে । ভাষা হারিয়ে গেছে । আলো অকস্মাৎ রুমার ডান হাতটা নিজের দুহাতের মাঝে টেনে নিল ।

রুমা কিছু বলল না । সে যেন নির্জীব হয়ে গেছে । দেহে মনে কোন শক্তি অবিশিষ্ট নেই । বলল,’ এত অন্ধকার কেন চারপাশ ? সব অমাবস্যার মত আঁধার কেন ? কিছু দেখতে পাবনা, একটু আলোর পরশও কি পাবনা আর জীবনে ?’ ‘ এভাবে বলোনা সোনা । আমি যে সইতে পারছিনা ।

আমার বুক ফেটে যাচ্ছে । তুমিকি বুঝতে পারছনা ? নিজেকে এত অসহায় ভাবছ কেন । আমিতো আছি । সারা জীবন তোমার চোখের আলো হয়ে থাকব । ’ ‘ কি বলছেন ভাইয়া এসব ।

’ ‘ হ্যাঁ রুমা , আমি তোমাকে বিয়ে করব । তোমাকে আমি অনেক ভালবাসি রুমা । ’ আলতো করে আলোর মুঠি থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিল রুমা । ‘ ভাইয়া, আমাকে করুনা করতে চান ?’ নিদারুন আহত বোধ করল আলো । বলল,’ কি বলছ তুমি এসব ? আমি যে তোমাকে ভালবাসি রুমা ।

তুমি কি এতদিন পরেও বুঝতে পারনি ?’ ‘প্লীজ ভাইয়া প্লীজ । আমার চোখ গেছে বলে কি বিবেকও গেছে ? আমার কারো দয়ার প্রয়োজন নেই । ’ ‘ এভাবে বলোনা প্লীজ । ভালবাসার অধিকার কি নেই আমার ?’ ‘ কেন থাকবেনা, অবশ্যই আছে । কিন্তু বিয়ের কথা বলবেন না প্লীজ ।

’ ‘ আমি তোমার যোগ্য নই তাইনা ?’ ‘ ছি ছি কি বলছেন ? আপনি কেন অযোগ্য হবেন ? অনেক বেশি যোগ্য আপনি । আমিইতো অযোগ্য । একজন ভিখারীর স্ত্রী হবার যোগ্যতাও আজ আমার নেই । ’ ‘ দয়া করে এভাবে বলোনা । প্লীজ তুমি শান্ত হও ।

শান্ত হয়ে বিশ্রাম নাও । আমি আসছি । ’ পরদিন আলো আবার বিকেলে মিঠুদের বাড়ি গেল । গত দুরাতেই ওর ঘুম হয়নি । চেহারায় তার স্পষ্ট ছাপ পড়েছে ।

চোখ লাল হয়ে আছে । খালাম্মা ওর দিকে অবাক হয়ে তাকালেন । আলো উনার পাশে কিয়ে বসল । কেমন কাতর চোখে চাইল তাঁর দিকে । বলল, ‘ খালাম্মা , আমি রুমাকে বিয়ে করতে চাই ।

’ তিনি অনেকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন । তার চোখ মুখে একটা শক্ত ভাব ফুটে উঠল । বললেন, ‘ তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ?’ ‘ না আমি পাগল হইনি । প্লীজ না করবেন না । আপনি রাজী হলেই হবে ।

’ ‘ শোন বাবা, আমার মেয়ের জীবনতো শেষ হয়ে গেল । তোমার জীবন নষ্ট করতে চেও না । মা বাবার কত আশার আলো তুমি । তোমার পরিবারের কত আশা ভরসা তোমাকে নিয়ে । একথা দ্বিতীয়বার উচ্চারন করোনা ।

’ ‘ প্লীজ আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না । আমি রুমাকে ভালবাসী । ওকে অসহায় অবস্থায় রেখে আমি কিছুতেই বাঁচতে পারব না । ’ ‘ আলো অবুঝ হয়ো না । ভেবে দেখ এ হয় না ।

’ ‘ হয় খালাম্মা হয় । আপনি বললেই হয় । ’ কাতর অনুনয়ে খালাম্মার হাত চেপে ধরল আলো । দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের সব কথাই শুনেছে মিঠু । এবার ভেতরে ঢুকল ।

ওর চেহারায় কাঠিন্য । চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ আমাদের দয়া দেখাতে এসেছিস তাই না ?’ আলো ওর মেজাজ দেখে ভড়কে গেল । বলল,’ মিঠু তুই কি বলছিস এসব ?’ ‘ তাহলে সম্পত্তির লোভ । আমার বাবার অগাধ সম্পদ । রুমাকে বিয়ে করলে তার ভাগ পাবি এইতো ? তোদের গরীবদের আসলে মন ছোটই থাকে , কখনো বড় হয় না ।

মানুষের বিপদের মাঝেও স্বার্থ খুঁজে বেড়াস । ’ বিস্ময়ে ব্যথায় হতবাক হয়ে গেল আলো । জীবনের প্রতি প্রচন্ড বিতৃষ্না ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলল । এক দৌড়ে বেরিয়ে এল মিঠুদের বাড়ি থেকে । ‘ এটা তুই কি করলি মিঠু ।

এসব কি কথা বললি ছেলেটিকে । ’ মা অবাক হয়ে বললেন । ‘ মা তুমি জাননা । ও খুব জেদী ছেলে । এভাবে না বললে ওকে ফেরানো যেত না ।

’ ‘ তাই বলে তুই ওকে স্বার্থপর লোভী বলবি ? ও কি আমাদের সম্পত্তির লোভ করেছে ?’ ‘ না মা না । তুমি জাননা ও কত ভাল ছেলে । কিন্তু এভাবে না বললে ওকে ফেরানো যেত না মা । ও একটা দরিদ্র ফ্যামিলীর ভরসার স্থল । কত স্বপ্ন ওকে নিয়ে ওদের ।

ও যা চাইছে তা কখনোই সম্ভব নয় । ’ রাত এগারোটার দিকে বিশাল হট্টগোল শোনা গেল ক্যাম্পাসের দিক থেকে । শব্দ গোলমাল ক্রমেই বাড়তে লাগল । মিঠু গায়ে সার্টটা চাপিয়ে বের হল । আলোর হলের দিক থেকে শব্দটা আসছে ।

দ্রুত এগোল মিঠু । প্রথমেই নাইট গার্ডের সাথে দেখা হল । ওকে দেখতে পেয়েই বলল, ‘ স্যার আপনার বন্ধু আলো সাহেব ফাঁস নিয়েছে । ’ সমস্ত পৃথিবী ঘুরতে শুরু করল যেন । ওর মাথার ভেতরটা ফাঁকা মনে হল ।

পায়ের নীচের মাটি দুলতে শুরু করল । জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মিঠু । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।