মাইলের পর মাইল জুড়ে কোন বৃক্ষরাজি দেখা যাচ্ছেনা, গাছের সমস্ত শাখা-প্রশাখা শুভ্র বরফের নিচে ঢাকা। যতদূর চোখ যায় কেবল উপত্যকা, পর্বত এবং রাতের আকাশের তারা দেখা যায়। এর মাঝেই আছি আমি এবং আমার স্ত্রী। মৃত্যুর অপেক্ষা এবং কেউ এসে উদ্ধার করবে এই আশা দুটো অপশনের দিকেই চেয়ে আছি আমরা।
''আমি ক্লান্ত, নাতাশা''-দুই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে বললাম, চূড়ান্ত হতাশা আমার চোখে-মুখে।
এভাবে আর কদিন কাটবে তা ভেবে ভেবে দিশেহারা আমি।
টুপিটাকে কানের নিচে নামিয়ে এনে আমার পাশ দিয়ে পেছনে দূরে বিরান উপত্যকার দিকে তাকালো নাতাশা, অস্ফূট স্বরে সে বললো, ''আমিও''-হতাশায় যে নি:শ্বাস ছাড়লো নাতাশা তা চায়ের কেটলির ধূমায়িত বাষ্পের চেয়ে মতোই উত্তপ্ত।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ''তুমি কী কিছু খুঁজে পেয়েছো?''
''না''-নাতাশা বললো। ''তুমি?''
''না''-মিথ্যে বললাম আমি।
আমি নাতাশাকে বলতে ভয় পেলাম, বেচারী ঘাবড়ে যাবে।
বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে বেশ দূর চলে গিয়েছিলাম, পথে একটি গাড়ি দেখলাম-ক্যুপ। দুটি মানবসন্তান তাতে বরফমানব হয়ে ঘুমিয়ে আছে অজানা প্রশান্তিতে।
''গড, আমি বরফ হয়ে গেলাম। ''-বললো নাতাশা। ''চলো ভিতরে যাই''
দুইটা জ্যাকেট, তার ভিতরে কোট এভাবেই এতক্ষণ ক্যারাভ্যানের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
নাতাশাকে নিয়ে ক্যারাভ্যানের ভেতরে ঢুকলাম, ক্যারাভ্যানে বিন্দুমাত্র জ্বালানি অবশিষ্ট নেই। সপ্তাহখানেক আগে যখন ঢাকা থেকে হিমাচলের এদিকটায় ক্যাম্পিং করতে আসি, তখন এসি চালু না করলে গা থেকে ঘাম ঝরতো, আর এখন থুথু ফেললেও তা বরফ হয়ে যাচ্ছে। চন্ডিগড় থেকে ক্যারাভ্যান রেন্ট করার সময় একজন বলতেছিলো, ''সাবধানে থাকবেন, এসময় আবহাওয়া সুবিধের থাকেনা তেমন''। বিয়ের পর নাতাশাকে নিয়ে এটাই ছিলো আমার প্রথম দেশের বাইরে ক্যাম্পিং। অবস্থাদৃষ্ঠে এটাকে শেষ ক্যাম্পিং বললেও ভুল হবেনা বোধ হয়।
''শিট! আবীর''-শুন্য দিয়াশলাই বক্স হাতে নিয়ে আমার দিকে হতাশার দৃষ্টিতে তাকালো নাতাশা। একটি দানা সলিড খাবারও আর ক্যারাভ্যানে নেই। কিছু চকলেট ছিলো তাও নষ্ট অবস্থায় এখন। আগুন ধরিয়ে একটু উষ্ণতা নেয়ার মতো বিকল্পও নেই। টানেলের শেষে আলো দেখতে পাচ্ছি, এরপর ধীরে ধীরে মিশে যাবো আলোতে, আলোকরশ্মি হয়ে।
''ফাক দিস''-আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না।
নাতাশা নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট পাচ্ছিলো, এমন সময় সে জ্যাকেটের চেইন খুলতে শুরু করলো।
আমি বললাম, ''থামো, কী করছো?'', আমার কথায় কর্ণপাত না করে আপন মনে এক এক শরীরের সমস্ত কাপড় খুলে ফেললো নাতাশা। ঠান্ডায় তার চামড়া কফি কালারের হয়ে আছে। সে বললো, ''এমন পরিস্থিতিতে তুমি বাঁচতে চাও?''
আমি তার কাছে পৌঁছে বললাম, ''হতাশ হয়োনা, কেউ হয়তো আসবে!''
সে আমাকে ক্যারাভ্যানের জানালার কাছে টেনে নিয়ে গেলো, একটুখানি জায়গাতে বরফ নেই।
তা দিয়েই বাইরে তাকিয়ে নাতাশা বললো, ''এইযে পাহাড়-পর্বত, এর একশো মাইলের ভেতরও কেউ নেই। শুধু শুধু আশা নিয়ে আমরা বাঁচবোনা, এ পথ দিয়ে মানুষের যাওয়া আসা শুরু হতে অনেক সময় লাগবে এখনো। ''-বলে কাঁদতে লাগলো নাতাশা।
আমি আমার টুপি, জ্যাকেট, মাফলার, গ্লাবস সব এক এক করে খুলতে লাগলাম, ''নাউ হোয়াট''-আমি বললাম।
আমার দিকে এগিয়ে আসলো নাতাশা, দুর্বল হাতে জড়িয়ে ধরলো আমাকে।
সূর্যের আলো যে কয়দিন ধরে দেখছিনা তার সময়কালের মাঝে এই প্রথম নাতাশা আমাকে চুমু দিলো। তার হাতের স্পর্শ কেমন যেনো মৃত মানুষের মতো মনে হলো। প্রানচঞ্চল মেয়েটি যে কিনা আহ্লাদী অস্থিরতায় আমার জীবনটাকে ভরিয়ে তুলেছিলো তাকে এ অবস্থায় দেখতে কষ্ট হচ্ছে খুব।
''আই লাভ ইউ''-মৃদু আওয়াজে কিন্তু দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো নাতাশা।
আমি বললাম, ''জানিতো''
প্রচন্ড ঠান্ডায় দুজনে জমে গিয়েছি প্রায়, ক্যারাভ্যানের উইন্ড শিল্ড দিয়ে বরফরাশির ভেতর দিয়ে ধোঁয়া উড়ে যেতে দেখলাম।
এরই মাঝে নাতাশা একবার কাশলো। রাত গভীর হতে লাগলো এবং সারাদিনে এই প্রথম আমি একটু উত্তাপ পেতে শুরু করলাম।
----------------------------------------
শব্দ পথিক
ডিসেম্বর ১০, ২০১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।