তিস্তা এখন আর নদী নয়, একটি মরা খাল। ভারতের গজলডোবা নামক স্থানে এর প্রবেশমুখে ও লালমনিরহাটের দোয়ানীতে ব্যারেজ নির্মাণ করে এ নদীর উচ্ছল দুর্বার গতিকে রোধ করে দিয়েছে সভ্য সমাজের কিছু মানুষ। তিস্তা ব্যারেজের উজানে ভারতের গজলডোবা বাঁধের সব গেট বন্ধ করে দেওয়ায় তিস্তা নদী প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পানির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ অব্যাহত রেখেছেন তিস্তাপারের কৃষকরা।
তিস্তা ব্যারেজ থেকে শুরু করে ভাটিতে তিস্তা রেলসেতুর নিচে কাউনিয়া পয়েন্ট পর্যন্ত দেড়শ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর বুকজুড়ে এখন শুধুই ধু-ধু বালুচর।
দেশের বৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ দাঁড়িয়ে আছে বালুর ওপর। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন খাল সৃষ্টির মাধ্যমে তিস্তার স্রোত ঘুরিয়ে দিয়ে এর বুক থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে পানি নামের জীবন। মরে গেছে তিস্তা। পাড়ে দাঁড়ালে এখন বাতাসে শুনতে পাওয়া যায় ক্ষীণকায় তিস্তার দীর্ঘশ্বাস আর গুমরে ওঠা কান্নার শব্দ। প্রতিদিনই পানির ক্রমহ্রাসমানতায় আশা-নিরাশা ও লুকোচুরির কবলে পড়েছে একসময়ের প্রমত্তা তিস্তা।
খরস্রোতস্বিনী তিস্তা নদীর নাব্য এতটাই হ্রাস পেয়েছে যে, চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রম চালানোই কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রতিদিনই পানি কমছে। নদীর বুকভরা বালুচর। কোথাও সামান্য পানি আবার কোথাও দিগন্তজোড়া ধু-ধু চর। আর এই ইরি-বোরো মৌসুমে পানি না পেয়ে প্রতিদিনই হাজারো কৃষক তিস্তাপারে চালিয়ে যাচ্ছেন বিক্ষোভ মিছিল।
ব্যারেজ থেকে শুরু করে তিস্তার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পানি না থাকায় ভেঙে পড়েছেন সুবিধাভোগী কৃষকরা। তারা বলছেন, বারবার দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে পানি প্রবাহের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও আজ পর্যন্ত সুরাহা না হওয়ায় ব্যারেজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এদিকে শুধু যে তিস্তা মরেছে তা নয়, এর সঙ্গে এখন মৃতপ্রায় এর পারের কয়েক হাজার জেলে। যারা তিস্তার বুক থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, আজ তারা নিঃস্ব, অসহায়। অন্যদিকে তিস্তার বুকে পানি না থাকায় কয়েক লাখ কৃষকের প্রতিনিয়ত কান্নায় পারের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রমতে, তিস্তার পানিপ্রবাহ এযাবৎকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে যেখানে প্রয়োজন চার হাজার কিউসেক পানি, সেখানে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এসে ব্যারেজ এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৩০০ কিউসেক। পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, পর্যাপ্ত পানির অভাবে তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। তাই চলতি সেচ মৌসুমে তিস্তার পানির হিস্যার বিষয়টি ভারতের সঙ্গে সুরাহা জরুরি হয়ে পড়েছে। কৃষকদের মতে, রোপণ থেকে গাছের শীষ হেলে না পড়া পর্যন্ত বোরোতে সেচ প্রদানের প্রকৃত সময়।
সে পর্যন্ত বোরো আবাদের জন্য সেচ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ব্যারেজ প্রকল্পের আওতাভুক্ত এলাকার কৃষকরা সেচকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ বলে মনে করছেন। গতকাল ৩ এপ্রিল তিস্তা ব্যারেজ এলাকায় পানির পরিমাণ ছিল মাত্র ২০০ কিউসেক। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ব্যারেজে প্রকৃতপক্ষে পানির প্রয়োজন প্রায় ২০ হাজার কিউসেক।
তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের কর্তব্যরত পাউবোর ডালিয়া এলাকার উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মাইনউদ্দিন মণ্ডল জানান, অকার্যকর হয়ে পড়েছে তিস্তা ব্যারেজ।
তবে চুইয়ে আসা পানি তিন-চার দিন জমিয়ে রেখে তা রেশনিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন ক্যানেলে সরবরাহ করা হচ্ছে। ব্যারেজের পানি দিয়ে চলতি বোরো আবাদে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে নীলফামারীতে ২৬ হাজার ৫০০ হেক্টর, দিনাজপুরে ১৩ হাজার, রংপুরে ২৫ হাজার ৫০০ ও নীলফামারীতে ১৫ হাজার ৬০০ হেক্টর। সূত্রমতে, সেচ প্রকল্পের পানিসহ তিস্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে নূ্যনতম পানির প্রয়োজন প্রায় ২০ হাজার কিউসেক। অভিন্ন তিস্তার উজানে বিজনবিভূঁই এলাকায় গজলডোবা নামক ব্যারেজ নির্মাণ করে ১৯৮৭ সাল থেকে তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে আসছে ভারত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাকুল্যে তিস্তায় সর্বশেষ গতকাল ৩ এপ্রিল ব্যারেজের মূল গেটের পানিপ্রবাহ ছিল মাত্র ২০০ কিউসেক, যা দিয়ে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের সেচ কার্যক্রম চালানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ময়েন উদ্দিন মণ্ডল আরও জানান, পর্যাপ্ত পানির অভাবে তিস্তা ব্যারেজের সেচ কার্যক্রম কোনোভাবেই চালু করা সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ব্যারেজ এলাকায় যেখানে পানি থাকার কথা ৩০ হাজার কিউসেক, সেখানে চলতি এপ্রিলে প্রথম সপ্তাহেই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে ব্যারেজ এলাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের সেচ কার্যক্রম চালাতে পানির প্রয়োজন হবে শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ২০ হাজার কিউসেক। কারণ দ্বিতীয় পর্যায়ের সেচ খাল বগুড়া পর্যন্ত প্রলম্বিত করা হচ্ছে।
এ জন্য তিনটি ইউনিটে ভাগ করে এর কাজ চলছে। প্রথম ইউনিটের কাজ চলছে দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত। এরপর দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শুরু হবে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ও বিরামপুর উপজেলা পর্যন্ত। এরপর তৃতীয় ইউনিটের কাজ শুরু হবে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ হয়ে বগুড়ার ধুনট পর্যন্ত। কৃষি বিভাগ সূত্রমতে, চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে রংপুর বিভাগের আট জেলায় ৯ লাখ ৪৩ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ পরিমাণ জমিতে বোরো আবাদে বিদ্যুৎ, ডিজেল ও পা-চালিত সেচযন্ত্র ব্যবহার করা হবে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৬১টি। এর মধ্যে ডিজেলচালিত গভীর নলকূপ রয়েছে ১৪৯টি, অগভীর নলকূপ ২ লাখ ৮৫ হাজার ৭০৪টি, পাওয়ার পাম্প ৮৪৩টি ও বিদ্যুৎ-চালিত ৫৬ হাজার ৩৮২টি ও পা-চালিত সেচযন্ত্র ২৭ হাজার ৬৮৩টি।
এদিকে পানির অভাবে এখনো ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে চারা লাগাতে পারেননি কৃষক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুর অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ আলী আজম বলেন, বোরো ধানের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় ১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ। এ সময়ের পর চারা রোপণ করা হলে তা হবে আউশ আবাদ।
বোরোর মতো কাঙ্ক্ষিত ফলন এতে আসবে না।
এদিকে পানির দাবিতে নীলফামারী, রংপুর ও লালমনিরহাটের সেচ প্রকল্পের আওতাধীন কৃষকরা দফায় দফায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করছেন। পানির দাবিতে রংপুর জেলা বাসদের উদ্যোগে বিভিন্ন সংগঠন ৩০ মার্চ তিস্তা ব্যারেজ অভিমুখে রোডমার্চ কর্মসূচি পালন করে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের রংপুর ক্যানেলের অধীন গঙ্গাচড়া উপজেলার খলেয়া গ্রামের কৃষক ও খলেয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন তোফা বলেন, রংপুর ক্যানেলে পানি না থাকায় এ এলাকার কৃষকরা এখনো বোরো চারা রোপণ করতে পারেননি। পানি সরবরাহের দাবি জানিয়ে পাউবোতে একাধিকবার আবেদন করেও কাজ হচ্ছে না।
রংপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব আলম বলেন, কৃষকের হাহাকার বুঝতে পারছি। তীব্র সংকটের কারণে চাহিদামতো পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। রংপুর পাউবোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৮ সালে তিস্তা ব্যারেজের ৬০ কিলোমিটার উজানে গজলডোবায় তিস্তা নদীর উৎসমুখে ব্যারেজ নির্মাণ করে নদীটির প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ শুরু করে ভারত। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ লালমনিরহাটের দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করলে ভারত স্বাভাবিক পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি করে। গজলডোবা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ তাদের খেয়ালখুশিমতো পানি ছেড়ে দেয়, আবার বন্ধ করে রাখে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবারই দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। জোরালোভাবে চাপ প্রদানের পর ১৯৯৬ সালে উভয় দেশের সরকার দ্বিপক্ষীয় কোনো চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত একটি সমঝোতায় পেঁৗছায়। সে অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে ভারত ৪০ ভাগ, বাংলাদেশ ৩৫ ভাগ এবং স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে ২০ ভাগ পানি ছাড়ার কথা। তবে সমঝোতা কাগজকলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। সমঝোতার পর বাংলাদেশ ৩৫ ভাগ তো দূরের কথা, ১০ ভাগ পানিও পায়নি কখনো।
বছর বছর পানির পরিমাণ কমতে কমতে এবার তা ধারণ করেছে ভয়াবহ রূপ।
এদিকে উত্তরের শেষ জেলা কুড়িগ্রাম দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তায় পানি নেই। এখানে নদীটি পরিণত হয়েছে সরু মরা খালে। ফলে জেগেছে ধু-ধু বালুচর। একসময় তিস্তায় বছরজুড়ে মৎস্যজীবী পরিবারগুলো মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করত।
কিন্তু চার বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে থাকছে হাঁটুপানি। আবার কোথাও পানি মোটেই না থাকায় ওই পরিবারগুলো একেবারেই বেকার হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে নদী থেকে পানি উত্তোলন করে বোরো চাষ করতেন এখানকার কৃষকরা। কিন্তু এবার চিত্র ভিন্ন। বোরো চাষে সেচ দিতে পারছেন না কৃষক।
এ ছাড়া তিস্তায় পানি না থাকায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ফলে নলকূপেও তেমন পানি উঠছে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।