বাংলাদেশের নগর এলাকার জন্য পরিকল্পনার ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম উন্নয়ন পরিকল্পনার উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯১৭ সালে (ব্রিটিশ আমলে) ঢাকা শহরের জন্য। যদিও পূর্ণাঙ্গ মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয় ১৯৫৯ সালে (পাকিস্তান আমলে) । প্রায় একি সময়ে চট্টগ্রাম শহরের জন্য মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। এরপরে খুলনা শহরের জন্য মহাপরিকল্পনা করা হয় ১৯৬১ সালে।
মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এ শহরগুলোতে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত গৃহায়ন এবং গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের অধীনে, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর (UDD) ৩৯২টি পৌরসভার জন্য ভূমি ব্যবহার মহাপরিকল্পনা (Land Use Master Plan) এবং ৫০টি জেলা শহরের অবকাঠামোগত পরিকল্পনা (Structural Plan), শহর এলাকার পরিকল্পনা (Urban Area Plan) এবং বিস্তারিত এলাকা উন্নয়ন পরিকল্পনা (Detailed Area Development Plan) প্রস্তুত করে। ১৯৯৫ সালে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর জন্য ২০ বছর মেয়াদী ( ১৯৯৫-২০১৫) উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়। ২০০১ সালে খুলনা এবং রাজশাহী মহানগরীর জন্য ২০ বছর মেয়াদী নতুন মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। এই মহাপরিকল্পনাসমূহ ৩টি অংশে (Structural Plan, Urban Area Plan এবং Detailed Area Plan) বিভক্ত ছিল।
১৯৯৯ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত UDD গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া এবং কোটালীপাড়া পৌরসভার জন্য ২০ বছর মেয়াদী ভূমি ব্যবহার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। ২০০৪ সাল থে ২০০৮ সাল পর্যন্ত UDD আরো ৮ টি পৌরসভার জন্য ২০ বছর মেয়াদী ভূমি ব্যবহার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে (তথ্যসূত্রঃ UDD ওয়েবসাইট, ২০১৪)।
এরপরে, UDD ২০১১ সালে টুঙ্গিপাড়া পৌরসভাকে একটি পর্যটন কেন্দ্রিক নগরীর তৈরীর লক্ষ্যে মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত করে। ২০১১ থেকে কুয়াকাটার জন্য বিস্তারিত এলাকার মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু যা এখোনো চলমান রয়েছে। বরিশাল এবং সিলেট মহানগরীর ২০ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে ২০১০ সালে (তথ্যসূত্রঃ UDD ওয়েবসাইট, ২০১৪)।
যদিও উপোরোক্ত মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী বড় নগরীতে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহী) কিছু কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও, মহাপরিকল্পনাগুলোতে যে সুপারিশগুলো করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান। বেশিরভাগ পৌরসভা/জেলা শহরের জন্য প্রণীত মহাপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন হয়নি এবং ইতোমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ন হয়ে গিয়েছে। বেশিরভাগ পরিকল্পনাই রয়ে গেছে কাগজে কলমে এবং মহাপরিকল্পনা শুধুমাত্র একটি মানচিত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এমনকি বেশিরভাগ শহর বা পৌরসভাগুলোতে মহাপরিকল্পনার কপিগুলো পাওয়া যায়না অথবা দায়িত্বরত কর্তাব্যক্তিরা মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু জানাতেও পারেন না। ফলশ্রুতিতে, অপরিকল্পিতভাবেই গড়ে উঠেছে বেশিরভাগ শহর।
পরিকল্পনাগুলো ব্যর্থ হবার পেছনে মূলত রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, প্রয়োজনীয় আইন-কানুন বাস্তবায়নের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দূর্বলতা, প্রতিষ্ঠানসমূহে দায়িত্ব বন্টনে অসামঞ্জস্যতা এবং সমন্বয়হীনতা, সম্পদের সীমাবদ্ধতা, অসেচতনতা, পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অদূরদর্শিতা, নগর পরিকল্পনা বিষয়ে জ্ঞানের অভাব ইত্যাদি কারণগুলোকে দায়ী করেছেন বেশিরভাগ নগর গবেষক, পরিকল্পনাবিদ এবং বিশেষজ্ঞগণ। বিশেষ করে, নগর পরিকল্পনা এবং পরিকল্পিত নগরায়ন বিষয়টিকে অগ্রাধিকার না দেয়া, পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানসমূহে পরিকল্পনাবিদের পোষ্ট না থাকা/অপ্রতুল পোষ্ট থাকা, স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পিত নগরায়ন বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেয়া/অসচেতনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো মহাপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন না হবার পেছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
বড় মহানগরীগুলোতে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা) উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করে, সেখানে পরিকল্পনাবিদসহ অন্যান্য জনবল নিয়োগ দেয়া হলেও, অন্যান্য জেলা শহর এবং পৌরসভাগুলোতে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বার্থে কোন পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ দেয়া হয়নি। UDD ভবনে (কেন্দ্রীয় অফিসে) পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ দেয়া হলেও তারা স্থানীয় পর্যায়ে (পৌরসভা/উপজেলা/জেলা শহর পর্যায়ে) ভূমি ব্যবহার এবং অন্যান্য মহাপরিকল্পনা সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন এবং তদারকি করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হলেও, সেখানে নগর/শহরের চাহিদা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী জনবল রাখা হয়নি।
তাছাড়া, বড় মহানগরীগুলোতে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহ নাগরিক সেবা প্রদান এবং উন্নয়নে কাজ করে। সেসব ক্ষেত্রে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসমূহ সঠিকভাবে সমন্বয় বজায় রাখতে পারেনি। এর পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক দূর্বলতা এবং অদূরদর্শিতা বেশি দায়ী।
UDD এর অধীনে প্রণয়নকৃত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে সমস্যা থাকার কারণে, ২০০৪ সাল থেকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রনালয়ের অধীনে LGED (স্থানীয় সরকার প্রোকৌশল অধিদপ্তর) উপজেলা শহর, জেলা শহর (উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বহির্ভূত এলাকায়) এবং পৌরসভা পর্যায়ের “Upazila Towns Infrastructure Development” প্রকল্পের আওতায় মহাপরিকল্পনা, ভূমি ব্যবহার মহাপরিকল্পনা, ড্রেইনেজ মহাপরিকল্পনা এবং ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করে যা ২০১৪ সাল নাগাদ শেষ হবে (তথ্যসূত্রঃ LGED ওয়েবসাইট, ২০১৪)। এই প্রকল্পের আওতায় কুমিল্লা এবং রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নীতি নির্ধারকগণ, রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ পরিকল্পিত নগরায়ন এবং উন্নয়ন বিষয়ে সচেতন নয়। সেখানে কর্মরত/দায়িত্বরত জনবলের নগর পরিকল্পনায় কোন প্রশিক্ষন নেই। যেহেতু LGED দীর্ঘদিন স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে জড়িত, সেহেতু, সেখানকার নীতি নির্ধারক, কর্মকর্তাগণ এবং সাধারণ মানুষ ‘নগর পরিকল্পনা’ বা ‘মহাপরিকল্পনা’ বলতে শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বোঝেন। সঠিকভাবে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রনে তাদের কোন ভূমিকা নেই বা দেখা যায়নি বা দেখা যাচ্ছেনা। অধিকাংশক্ষেত্রে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিকল্পনাবিদের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা হয়েছে/ হচ্ছে।
অথচ কোন এলাকায় অবকাঠামোগত যেকোন ধরনের উন্নয়ন প্রস্তাব অনুমোদনের ক্ষেত্রে এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা দেয়া, বিকল্প প্রস্তাব বিশ্লেষণ এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিধি-বিধান প্রয়োগে পরিকল্পনাবিদের পরামর্শ নেয়া এবং সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। যেহেতু স্থানীয় সরকার পরিচালিত হয় রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ দ্বারা তাই তাদেরকে সঠিকভাবে মহাপরিকল্পনার ভূমিকা এবং প্রয়োজনীয়তা সেই সাথে পরিকল্পনাবিদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না করা হলে পূর্বের মহাপরিকল্পনাসমূহের মত, নতুন মহাপরিকল্পনাগুলোও বাস্তবায়নের মুখ দেখবেনা। অথবা নগর পরিকল্পনার সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প নেয়ার ফলে, বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে বেশিরভাগ শহর এবং অঞ্চল।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রনালয়, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ২০০৫ সালে প্রথম শ্রেণির প্রতিটি পৌরসভার জন্য একজন করে পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ দেয়ার কাজ শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে সর্বমোট ৩ টি ব্যাচে এই নিয়োগ কার্যক্রম বজায় থাকে।
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভাগুলোতে কোন পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ না দিয়েই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা মহানগরীতে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পরিকল্পনাবিদ রাখার বিধান করা হলেও অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনগুলোতে (কুমিল্লা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর) ১ জন করে পরিকল্পনাবিদ রেখে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভবপর নয়। এমনকি কোন কোন সিটি কর্পোরেশনে কোন পরিকল্পনাবিদ নেই। এরফলে, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন অতীতের মত আবারো মুখ থুবরে পরবে বলেই ধারনা করা যায়।
এছাড়া, যে শকল শহরে পরিকল্পনাবিদ আছেন, তাদের সংখ্যাও প্রয়োজন এবং চাহিদার তুলনায় স্বল্প।
ইতোমধ্যে, স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যার কারণে (কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, স্বাধীনভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাঁধা, কাজের সুযোগের অভাব ইত্যাদি) চাকুরি ছেড়েছেন বহু পরিকল্পনাবিদ। তাছাড়া, এসকল প্রতিষ্ঠানে পরিকল্পনাবিদকে কাজ করতে হয় প্রকৌশল বিভাগের অধীনে, এর ফলে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ব্যহত হয়। পরিচ্ছন্নতা বিভাগ এবং বস্তি উন্নয়ন বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগের সাথেও থাকে সমন্বয়হীনতা।
এসকল বিষয়ে লক্ষ্য না করা হলে এবং অতিসত্তর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গৃহীত না হলে, কোন পরিকল্পনাই সঠিকভাবে আলোর মুখ দেখবেনা, সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এক্ষেত্রে, Bangladesh Institutes of Planners (BIP) কিছু উদ্যোগ নিতে পারে যেমন, স্থানীয় পর্যায়ে advocacy planning এর মাধ্যমে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, সকল পর্যায়ে পরিকল্পনাবিদের প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে পরিকল্পনা বিষয়ে ভিন্ন বিভাগ স্থাপনে সরকারের সাথে negotiation করা, পরিকল্পনাবিদদের যোগ্য নেতৃত্বদানে সহায়তা করা, মিডিয়ায় প্রচারণা বাড়ানো ইত্যাদি।
পাশাপাশি, পরিকল্পনাবিদগণ নিজেদের জ্ঞান এবং কাজের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয়তা, দক্ষতা তুলে ধরতে পারেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।