আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিজেপির আদর্শিক টানাপোড়েন

প্রথম দফা নির্বাচন শুরুর প্রথম দিনেও কেন বিজেপি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করতে পারল না? নরেন্দ্র মোদির জন্য এই ব্যর্থতা খুবই লজ্জার ব্যাপার। দলটির দৃষ্টিভঙ্গি যে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে, এটা শুধু তাই-ই বোঝাচ্ছে না, মোদিকে নিয়ে বিজেপির ‘ওয়ান ম্যান শো’ ঠিকঠাক চলছে না। নরেন্দ্র মোদির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে ফাটলের লক্ষণ এটি। ইশতেহার প্রকাশিত হতে না পারা মোদির উন্নয়নবাদী গোষ্ঠী আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) সমর্থিত বিজেপির হিন্দুত্ববাদীদের দ্বন্দ্বের প্রতিফলন।
বিজেপির প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার মোদি যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের হুকুমে চলছেন তা বোঝা যায় গরুর মাংস রপ্তানির অনুমোদন দেওয়ার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মোদির আক্রমণে।

আর এই বক্তৃতা তিনি দিয়েছেন যাদব-অধ্যুষিত এলাকায়। বর্ণ-কাঠামোর মধ্যবর্তী স্তরে থাকা যাদবেরা প্রথাগতভাবে গরু পালন করে দুধ জোগানোর গোয়ালার কাজ করেন। কিন্তু এঁদের অনুভূতিকে তোয়াজ করার জন্য মোদি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেননি। তিনি এটা করেছেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরএসএসের দীর্ঘমেয়াদি প্রচারণার অংশ হিসেবে।
একইভাবে, মনিহারি পণ্যের বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিরোধিতা করে দেশীয় বেনিয়া শ্রেণীটিকে খুশি করতে চেয়েছেন।

অথচ বেশি দিন হয়নি, এই মোদিই খুদে ব্যবসায়ীদের বলেছিলেন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত হতে। তাহলেও, ইশতেহার প্রকাশিত না হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে এগুলোই প্রধানতম না-ও হতে পারে।
খুবই সম্ভব যে আরএসএসের নিয়ন্ত্রকেরা ১৯৯৬ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ীর তিনটি সিদ্ধান্ত উল্টে দেওয়ার প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। হিন্দুত্ববাদীরা অযোধ্যায় রামমন্দির বানাতে চান, চান সংবিধানে কাশ্মীরের বিশেষ অবস্থান-সংক্রান্ত ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল এবং চান অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন ঠেকিয়ে রাখতে। সে সময় বাজপেয়ী এই তিনটি প্রক্রিয়াই স্থগিত করেছিলেন।

অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণীত হলে বর্তমানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তথাকথিত নিজস্ব বিধি-ব্যবস্থার জায়গায় বিবাহ ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বিষয়টি সবার জন্য অভিন্ন হবে। কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা এটা করতেই দিতে চান না। এ কারণে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর বিজেপি ১৩ দিন চেষ্টা করেও কোনো ‘সেক্যুলার’ দলকে তাদের সরকার গঠনকারী জোটে আনতে পারেনি। কেবল ওই তিনটি বিষয়ে কট্টরপন্থী অবস্থান থেকে সরে আসার ঘোষণা দেওয়ার পরই তারা ১৯৯৮ সালে অদৃষ্টপূর্বভাবে ২৪ দলের জোট সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। সে সময় বিজেপি পেয়েছিল ১৮২টি আসন।


সবাই জানে যে আরএসএস ও বিজেপির মৌলবাদীরা ‘মধ্যপন্থী’ বাজপেয়ীর এই পশ্চাদপসরণ নিয়ে খুশি ছিল না। হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থী নেতা সাধ্বী ঋথাম্বরা তাই তাঁকে অভিহিত করেছিলেন ‘আধা কংগ্রেসি’ বলে। খুবই সম্ভব যে মোদিকে সামনে রেখে বিজেপির কট্টরপন্থীরা আবার ওই তিনটি স্থগিত ধারাকে বিজেপির কর্মসূচিতে ঢোকাতে চাইবে। মোদি হয়তো তাদের এসব চাওয়ার বিপক্ষে নন। সবকিছুর ওপরে আরএসএসের পুরোনো প্রচারক হিসেবে সহজাতভাবেই তিনি আরএসএসের দিকেই ঝুঁকে থাকবেন।


একই সঙ্গে তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না যে সঙ্ঘ পরিবার ১৯৯০ এর দশকে যে রামজন্মভূমি আন্দোলন শুরু করেছিল, দুই দশক পর সেখানে
ফেরার ফল কী হতে পারে? বিশেষত যখন তিনি চান নিজেকে ব্যবসাবান্ধব উন্নয়নের বিকাশ-পুরুষ হিসেবে ও স্মার্ট শহরের রূপকার হিসেবে উপস্থাপন করতে।
তিনি নিশ্চিত নন, করপোরেট সেক্টরের তাঁর বন্ধুরা বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সংবিধান সংশোধন এবং হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ফরাসিদের শত শত বছরের পুরোনো পারিবারিক আইনে হাত দেওয়ার পরিণতি কী। যেমন সিভিল ম্যারেজের ব্যবস্থা চালু হলে হিন্দুদের আগুনকে সাক্ষী রেখে বিয়ের জায়গায় একমাত্র রেজিস্ট্রি কর্মকর্তা প্রত্যায়িত বিয়ে ছাড়া অন্য বিয়েগুলো আইনি বৈধতা পাবে না। বাজপেয়ীর প্রতিশ্রুতি বদলে ফেললে যে সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হবে, তা করপোরেট কর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, কাউকেই খুশি করবে না।
তার পরও ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে মুরলি মনোহর যোশীকে।

বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় মানবিক সম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী থাকার সময় পাঠ্যপুস্তকের হিন্দুকরণের জন্যই তিনি খ্যাত। সম্প্রতি মোদিকে জায়গা দেওয়ার জন্য তিনি তাঁর পুরাতন নির্বাচনী এলাকা বারানসি ছেড়ে দিয়েছেন। প্রতিদানে তিনি মোদির কাছে কিছু চাইবেন এবং তা হলো, ওই তিন স্থগিত ধারা নিয়ে ছাড়।
পরিহাস এই যে সাধারণ মানুষ দলীয় ইশতেহারের প্রতি সামান্যই আগ্রহী। ইশতেহারগুলো প্রকাশ করা হয় আসলে রুটিন হিসেবে, চাওয়া হিসেবে, বাস্তবায়নের জন্য নয়।

বিজেপির বেলায় ইশতেহার প্রকাশনার অস্বাভাবিক বিলম্বে নির্বাচন কমিশন কেবল ভ্রুকুটি করতে পারে। কিন্তু এটা তার থেকেও বেশি। এর পেছনের কারণ গভীরভাবে বিভক্ত দলীয় বাস্তবতা।

 

গালফ নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
অমূল্য গাঙ্গুলি: ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 



সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.