আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অজিত জিতলে চরণ সিংকে কুর্নিশ করতেই হবে

গাজিয়াবাদ থেকে মিরাট যেতে গেলে মোদি নগরের ওপর দিয়েই যেতে হবে। ভোটের বাজারে যে হাওয়া বইছে, তাতে কারও কারও মনে হতেই পারে, নরেন্দ্র মোদির নামে এই অঞ্চলে আস্ত একটা নগরই গড়ে উঠল বুঝি! সেই ভ্রম কাটাতে বলতে হয়, গুজরমল মোদি নামে এক শিল্পোদ্যোগী ১৯৩৩ সালেই এই নগরের পত্তন করেছিলেন। ইস্পাত, রাবার ও কেমিক্যালশিল্প, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ এমন কিছু নেই, যা ক্রমে ক্রমে এই অঞ্চলে গড়ে ওঠেনি। কালের নিয়মে অনেক অদলবদল ঘটলেও মোদি নগরের বাড়বাড়ন্ত অব্যাহতই থেকেছে।
মোদি নগরের ভৌগোলিক অবস্থান গাজিয়াবাদ জেলা হলেও তার রাজনৈতিক অবস্থান বাগপত সংসদীয় কেন্দ্রে, যে কেন্দ্রটি আবার বেসামরিক বিমান পরিবহনমন্ত্রী অজিত সিংয়ের খাসতালুক।


খাসতালুক মানে এখনো আক্ষরিক অর্থেই খাসতালুক। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার পরিচিতি দিতে গেলে বলা হয়ে থাকে, ‘ধান, আগুরি, মুসলমান, তিন নিয়ে বর্ধমান। ’ বাগপত কিংবা আরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোটা পশ্চিম উত্তর প্রদেশের পরিচিতি তেমনই আখ, চিনিকল ও জাঠ। জাঠভূমির জমিতে ফি বছর সোনা ফলে। আখ ও গম ঘরে ঘরে খুশির হাওয়া বইয়ে দেয়।

৫৮ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে ধারে চিনিকলের ধোঁয়ায় গুড়ের গন্ধ মিশে চরাচর ম-ম করে।
উত্তর প্রদেশের এই পশ্চিমাঞ্চল তো বটেই, পাশের রাজ্য হরিয়ানার লাগোয়া জেলাগুলোতেও যাঁর নাম শুনে মানুষ এখনো হাতজোড় করে কপালে ঠেকায়, সেই প্রয়াত চৌধুরী চরণ সিংয়ের ছেলে রাষ্ট্রীয় লোক দলের অজিত সিং। চরণ সিং ছিলেন জাঠভূমির মুকুটহীন সম্রাট। ছয় মাসের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে, চরণ সিংকে বাদ দিয়ে উত্তর প্রদেশের রাজনীতি তাঁর প্রয়াণের বহুদিন পরেও ভাবা যায়নি।

‘জাঠ অধিপতির’ মাহাত্ম্য ছিল এমনই।
চরণ সিংয়ের একমাত্র পুত্র অজিত সিং অবশ্য বাবার পায়ের ছাপে পা মিলিয়ে চলতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। পশ্চিমবঙ্গের খড়্গপুর আইআইটি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে তিনি চলে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র। আইবিএমে ১৫ বছর কাজ করে একসময় ছুটিতে দেশে এসে ফেঁসে গেলেন। চরণ সিং গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

এই যান-সেই যান অবস্থা। বাবার সমর্থকেরা সব হারানোর আশঙ্কায় ধরে বসলেন অজিতকে। সেটা ১৯৮৫ সাল। আর মার্কিন দেশে ফিরে যাওয়া হলো না অজিতের। পরের বছর ছেলেকে রাজ্যসভায় নিয়ে এসে ১৯৮৭ সালে চোখ বুজলেন চরণ সিং।

জাঠভূমির উত্তরাধিকার বর্তালো অজিতের ওপর। ১৯৮৯ থেকে ছয়বার লোকসভায়। এই বাগপত থেকে।
কিন্তু তাই বলে যদি মনে করা হয়, গোটা বাগপত আজও চরণ সিংয়ের মতোই ছেলে অজিতের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে, তা হলে সেটা হবে গুরুতর ভুল। মোদি নগরকে পাশ কাটিয়ে তিলাপানি কিংবা দেবাঘুয়ার দিকে গেলেই কানাঘুষা নানা কথা শুনছিলাম।

কথাগুলো হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই। এই কথা চালাচালির কারণ গত বছরের সেপ্টেম্বরে মুজাফফরনগরের মারাত্মক দাঙ্গা।
দাঙ্গায় জড়িয়ে যায় যারা, তারা উভয়েই ছিল চরণ সিংয়ের অন্ধ সমর্থক। তাঁর অবর্তমানে তাঁর ছেলেকেও সমর্থনের ঝুড়ি উজার করে দিয়েছে। জাঠ ও মুসলমান উভয়েই।

দাঙ্গা ঘটে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেননি অজিত। মুসলমান শরণার্থী শিবিরগুলোতে গেলে জাঠেরা খেপে যাবে, আবার না গেলে মুসলমানেরা রুষ্ট হবে। শ্যাম না কুল কোনটা রাখবেন ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত অজিত যখন মুসলমানদের শিবিরে গেলেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মুজাফফরনগরের ঢেউ বাগপতে পৌঁছাতে সময় নেয়নি। বাগপতের মুসলমানেরা আজ তাই সরাসরি প্রশ্ন তুলছে, অজিত সিং জাঠ-সঙ্গ ছেড়ে বের হতে পারেননি যখন, মুসলমানদেরও তাই তাঁকে সমর্থনের কোনো দায় নেই।


তিলাপানির মাঠে পাকা গম কাটতে কাটতে রশিদ মিঞা বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন, ‘এত দিন চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে ঘর করেছি। অন্য জেলার মুসলমানেরা রাষ্ট্রীয় জনতা দল ছাড়লেও এই বাগপতে আমরা ওঁদের ছাড়িনি। এবার কিন্তু ভাবার সময় এসেছে। ’
রশিদ মিঞা বললেন বটে, কিন্তু সেখানেও ভাগাভাগি যে নেই তা নয়। ইসলাম জাতপাতহীন হলেও এই বাগপতে জাঠ হিন্দুদের মতো জাঠ মুসলমানও কম নন।

বহুকাল থেকে তাঁরাও চরণ সিংকে তাঁদের প্রথম ও শেষ কথা বলে মেনে আসছেন। বংশপরম্পরায় সেই আনুগত্য থেকে তাঁরা বঞ্চিত করেননি অজিতকেও। এবার তাঁরা কিছুটা ধন্দে ছিলেন দাঙ্গার প্রাথমিক পর্বে। কিন্তু ইউপিএ সরকার শেষ প্রহরে কেন্দ্রীয় অন্যান্য অনগ্রসর তালিকায় (ওবিসি লিস্ট) জাঠদের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়ায় শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগটা হুট করে বেড়ে গেছে। জাঠ মুসলমানেরা তাই অখুশি হতে পারছেন না।

দেবাঘুয়া এলাকার রাসায়নিক সারের বড় কারবারি হাজি জসিমউদ্দিন সে রকমই আভাস দিলেন। তাঁর কথায়, ‘মুজাফফরনগরে দাঙ্গা এই প্রথম। জাঠ ও মুসলমানের মধ্যে এত সদ্ভাব অন্য কোথাও দেখা যাবে কি না সন্দেহ। যা ঘটে গেছে তা তো গেছেই। সে নিয়ে চুলচেরা বিচারে লাভ নেই।

ছোটে চৌধুরীকেও এর মধ্যে টানা ঠিক নয়। বরং জাঠদের জন্য ওঁর সরকার যা করেছে, তাতে আখেরে আমাদের প্রত্যেকেরই লাভ হবে। ’
হাজি জসিমউদ্দিন যা বললেন, তাকে আমল দিতে আবার রাজি নন বিজেপির প্রার্থী সত্যপাল সিং। ভদ্রলোককে এই অঞ্চলের মানুষ বিশেষ একটা চেনে না। কারণ, তাঁর গোটা চাকরি জীবনই কেটেছে মুম্বাইয়ে।

মুম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার পদে ইস্তফা দিয়ে তিনি বাগপতের ভূমিপুত্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এসেছেন। চৈত্রের রোদে সত্যপাল কোথায় ঘুরছেন, মোদি নগরে তাঁর কার্যালয়ের কেউ সেই হদিস দিতে পারেননি। প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো তিনিও জাতে জাঠ কি না, সে কথাও জোর দিয়ে বলতে পারলেন না কেউ। বোঝা গেল, নিজের প্রার্থী সম্পর্কেও তাঁদের হোমওয়ার্ক যথেষ্ট নয়। তবে তাঁদের মধ্যে একজন অতি উৎসাহী, নাম বললেন অজয় সাইনি।

জানালেন, ‘ভাইসাব, সত্যপালজি জাঠ কি বানিয়া তা বড় কথা নয়। বড় কথা, বাগপতের মানুষ এবার মোদির নামেই ভোট দেবেন। ’
পারিবারিক ঐতিহ্য বাদে এমনিতে অজিত সিং যে দারুণ জনপ্রিয়, তেমন মনে করার খুব একটা কারণ নেই। না থাকার বড় কারণ, বারবার তাঁর দল ও আনুগত্য বদল করা। যদিও এসব দোষ-গুণ সত্ত্বেও ১৯৯৮ সাল ছাড়া একবারও তিনি এই কেন্দ্র থেকে হারেননি।

কংগ্রেস এবারও এই পশ্চিম উত্তর প্রদেশে অজিত সিংয়ের রাষ্ট্রীয় লোক দলের সঙ্গে জোট করেছে। ফলে মুসলমানদের একটা অংশ তাঁকে ছাড়লেও কংগ্রেসের কট্টর সমর্থকদের ভোট তাঁর বাড়তি পাওনা হবে। বিজেপি যদিও এসব ধর্তব্যের মধ্যে আনতে রাজি নয়। অজয় সাইনি তাই ঊরুতে চাপড় মেরে বলতে পারেন, ‘আঁধির নতুন নাম মোদি। সবকিছু উড়িয়ে দেবেন।

দেখছেন না, একা বিজেপিকে সবাই দু শর বেশি আসন দিচ্ছে?’
অজিত সিংকে শুইয়ে দেওয়ার মূল হুংকারটা সত্যপাল সিং ছাড়লেও বিএসপির প্রশান্ত চৌধুরী ও সমাজবাদী পার্টির গোলাম মোহাম্মদ চুপ করে বসে নেই। গোলাম মোহাম্মদের সুবিধা হলো প্রথমত, তিনি ভূমিপুত্র, দ্বিতীয়ত, তিনি এই সংসদীয় কেন্দ্রের অন্যতম বিধানসভা কেন্দ্র শিয়ালখাস থেকে নির্বাচিত বিধায়ক। তৃতীয়ত, তিনি বয়সে নবীন এবং স্থানীয় একটি কলেজের অধ্যক্ষ। গোলাম মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বলার মতো কারও কাছে বিশেষ কিছুই নেই। উত্তর প্রদেশে ভোটে জিততে গেলে যেটা দস্তুর, সেই বাহুবলী কিংবা চোরচোট্টা অপবাদ তাঁকে কেউ দেয় না।

সবচেয়ে বড় সুবিধে, প্রার্থীদের মধ্যে তিনি একাই মুসলমান। স্থানীয় আইনজীবী যোগেন্দ্র ঢাকা আম আদমি পার্টির টিকিটে বাগপত থেকে দাঁড়িয়েছেন। এবারই প্রথম নির্বাচনে লড়ছেন। মোদি নগরের প্রান্তে যোগেন্দ্রর কনভয়। কনভয় বলতে দুটি গাড়ি।

গাড়ির সামনে দলের প্রতীক ঝাড়ু লাগানো। মাথায় আম আদমি টুপি সহজেই পরিচয় বাতলে দেয়। যোগেন্দ্রর মুখ্য প্রচারকর্মী রণবীর আহুজা দুটি বিষয় জানালেন। এক, তাঁদের সম্ভাবনা বেশ ভালো। মানুষজন খুব সাড়া দিচ্ছে।

তিন-চারের মধ্যে থাকার আশা করছেন। দ্বিতীয়ত, গোলাম মোহাম্মদকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না। কারণ, ‘গোলামসাবের ছবিটা ভালো। তিনি এমএলএ। তার ওপর তাঁর দল রাজ্যের সরকারে।

অতএব, প্রশাসনিক ও অন্য সুবিধাগুলো তিনি পাবেন। ’ কিন্তু তার চেয়েও বড় সুবিধা একটা রয়েছে। রণবীরের কথায়, ‘তিনিই একমাত্র মুসলমান। বাগপতের পৌনে চার লাখ মুসলমান ভোটার শেষ পর্যন্ত গোলামসাবকে বেছে নিলে কে জানে কার পাত্তা কেটে যাবে!’
মুসলমান ভোট একজোট হলে এককথা। কিন্তু মোদির নামে হিন্দু ভোট এককাট্টা হলে তবে কি সত্যপাল সিং? প্রশ্ন ও উত্তর দুটোই কঠিন।

কারণ, জাঠেরা তো হিন্দু ভোটেরই অংশ এবং এই কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তা ছাড়া প্রবাদ আছে, প্রতিবার ভোটের সময় বাগপতের জাঠ পরিবারের কর্তাদের স্বপ্নে নাকি চৌধুরী চরণ সিং দেখা দেন। লাঠি ঠুকে ঠুকে নাকি বলেন, ‘আমি নেই বলে কি আমার ছেলেটা ভেসে যাবে?’ সেই স্বপ্নই নাকি অজিত সিংকে পার করে দেয়!
এবারের প্রবল মোদি হাওয়াতেও অজিত সিং ভেসে থাকলে জাঠভূমির প্রাণপুরুষকে তাই কুর্নিশ করতেই হবে।

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।