আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণজাগরণ মঞ্চের বাংলা পরীক্ষা

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চ যে যাত্রা শুরু করেছিল তা ছিল অভিনব, অভাবনীয়, অশ্রুতপূর্ণ, অচিন্তনীয়। সেই সময় চ্যানেল ২৪-এর টকশো 'মুক্তবাকে' আমি গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক তিনজনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। একজন ব্লগার বলেছিলেন, কাদের মোল্লার রায়ের পর আমরা স্বভাবতই বিক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। আমাদের ফেসবুকে পোস্টিং দিয়েছিলাম এ রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শাহবাগ চত্বরে জমা হতে। সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সেখানে ৫০ জনের মতো লোক জমা হয়েছিল।

আমরা তো হতাশই হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু কি হলো, ভোর হতে না হতেই হাজার হাজার লোক আসতে শুরু করল। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল শাহবাগ চত্বর। এ জন্যই বলছিলাম বিষয়টি ছিল অভাবিতপূর্ণ। কবির কথার মতো- 'কেউ কি দেখেছে এমন স্বদেশ কভু?' কেউ কি ভেবেছিল বাংলাদেশের এই প্রজন্মের বুকের মধ্যে দেশের জন্য এত ভালোবাসা ছিল।

আর শুধু তরুণ প্রজন্ম কেন, ধীরে ধীরে প্রজন্ম চত্বর তথা শাহবাগ চত্বর হয়ে উঠেছিল নবীন-প্রবীণ নির্বিশেষে সবার ক্ষোভ এবং শ্রদ্ধা, দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভালোবাসা জানানোর জায়গা। এখনো মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যে মানুষের ভালোবাসা আছে তা যদি সরকার আগেই জানত তবে কি কাদের মোল্লার রায় এমন হতে পারত? পারত ফাঁসির আসামি বাচ্চু রাজাকার বন্দী থাকা অবস্থায় দেশ থেকে পালিয়ে যেতে? কিন্তু আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ সংগঠন। তারা জানে কীভাবে জনতার ঢলে ঢুকে যেতে হয়। তারা ভুল করে ভুল করেনি। তারা জেনেশুনেই ভুল করেছিল এবং জনতার ঢেউ যদি ক্ষমতার তটে পৌঁছে যায় তাহলে সে ভুল সংশোধন করে নিয়েছিল।

কিন্তু সে ভুল স্বীকার করেনি।

শাহবাগ যে তরুণ প্রজন্মের বিদ্রোহ ছিল, সে বিদ্রোহ পরাভব মানে না, নতিস্বীকার করে না, তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে তারা অবিরাম স্লোগান দিয়েছে, ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই। বেগম সাজেদা চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদের মতো আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের কাউকে মঞ্চেই উঠতে দেয়নি। কাউকে বোতল মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে।

কিন্তু তাতে অভিমান করে মাঠ ছেড়ে দেওয়ার দল আওয়ামী লীগ নয়। তারা বুঝেছে এই প্রজন্ম বিরুদ্ধে চলে গেলে, তারা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যবসা করে তা হাতছাড়া হয়ে যাবে। অতএব খোদ প্রধানমন্ত্রী তার অনুগত ব্যবসায়ীদের ডেকেছেন। বলেছেন, শাহবাগে যাও, দেখ ওদের কি লাগে। টাকা-পয়সা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা যা লাগে তা-ই কর।

নিজে সংসদ অধিবেশনে বক্তৃতা করেছেন- আমি এই সংসদে অবস্থান করছি কিন্তু আমার মন পড়ে আছে ওদের ওইখানে, যারা শাহবাগ চত্বরে রোদে পুড়ছে।

ব্যাপারটা বুঝতে হবে। এই কি আওয়ামী লীগের আসল চেহারা? তারা শেষ পর্যন্ত সংসদে প্রস্তাব পাস করল, আপিলের ব্যবস্থা করল, কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হলো এবং সে রায় কার্যকরও হলো। অনেককেই তখন বলতে শুনেছি আওয়ামী লীগ বলেই তো এটা হলো। বিএনপি হলে কী হতো? এ প্রশ্নের জবাব আমার মতে নেতিবাচক।

বিএনপি হলে এটা হতো না। কিন্তু আওয়ামী লীগ বলেই এটা হয়েছে তা কি ঠিক? গণজাগরণ মঞ্চ যদি না হতো তাহলে কি এটা হতো? সে প্রশ্নের জবাব, আমার মতে হতো না।

স্বাধীনতার পর থেকে যুদ্ধাপরাধ তথা ধর্মের নামে রাজনীতির বিষয়টি একটি প্রশ্নহীন বিতর্কের মধ্যেই ঝুলে ছিল। এর উপরে বিস্তারিত তাত্তি্বক ও রাজনৈতিক বিতর্ক করা যাবে। আওয়ামী লীগ সেই দার্শনিক বিতর্কে কখনো ঢুকতে চায়নি।

তারা কেবল জনমতের সঙ্গে থাকতে চেয়েছে। পপুলার পার্টিগুলো এ ধরনের পপুলিজমে ভোগে। কিন্তু কখনো কখনো যে সাহস করে সত্যের পাশেও দাঁড়াতে হয় সেটা তারা করে না। গণজাগরণ মঞ্চ সেই কাজটি করেছিল। আওয়ামী লীগ সেটি হজম করেছিল।

কিন্তু এই যে আরেকটা শক্তি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তারুণ্যের শক্তি, যৌবনের শক্তি, যা তাদের আজ্ঞাবহ নয়, সেটা গলধকরণ করতে তাদের কষ্ট হয়েছে। এই কষ্টটা তারা মনেও রেখেছে। ৪ এবং ৫ এপ্রিল দুই দফা গণজাগরণ মঞ্চকে পেটানো হয়েছে। প্রথম দিন পিটিয়েছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর পরের দিন পিটিয়েছে পুলিশ। তাও একবার নয়, দুবার।

হতাশ হয়েছে অনেকে, কষ্ট পেয়েছে খুব। বিশেষ করে যারা গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানে আশাবাদী হয়েছিলেন তাদের হতাশাই বেশি। তারা যেন বিমূঢ় হয়ে প্রশ্ন করছেন এও কি সম্ভব? অথচ এটাই সম্ভব হয়েছে। শাহবাগে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করতে আসা গণজাগরণ মঞ্চের দুই অংশের কর্মীদের একটি অংশকে বিশেষভাবে লাঠিপেটা করেছে পুলিশ। গত শুক্রবার বিকালে এ ঘটনায় লাকী আক্তারসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।

এ হামলা কেন? গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার এ প্রসঙ্গে বলেন, 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দীর্ঘায়িত করা নিয়ে আমরা কথা বলছি। লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য ইসলামী ব্যাংকের টাকা নেওয়ার বিরুদ্ধেও বলেছি। এসব কারণে সরকার আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভাবছে। এ জন্য এ হামলা।

আসলে ঘটনা কি? পত্রিকার খবরে প্রকাশ, বেশ কিছু দিন ধরেই গণজাগরণ মঞ্চের একটি অংশ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের বিরোধিতা করছে।

ইমরান এইচ সরকার অগণতান্ত্রিক আচরণ করছে বলে তারা অভিযোগ করেন।

সাংগঠনিকভাবে গণজাগরণ মঞ্চের গড়ে ওঠার বিষয়টি আমাদের ভালো করে বোঝা দরকার। মূলত এটি ব্লগারদের একটি সমন্বিত সংগঠন। ২০-২২ বা ততধিক যুবককে নিয়ে গঠিত হয় এর কমিটি, যাদের নাম কোনো সময় পত্রিকায় ঘোষিত হয়েছে বলে দেখিনি। সম্ভবত এরা সবাই মিলে ডা. ইমরান এইচ সরকারকে তাদের মুখপাত্র নির্বাচন করেন।

আবার শুরু থেকেই বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, যার মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, তারাও এটার সঙ্গে যুক্ত ছিল। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে সভা-সমাবেশে যত বক্তৃতা হয়েছে সেখানে এই ছাত্র নেতাদেরই আমরা বক্তৃতা করতে দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম কেন্দ্রীয় সংসদ ও গৌরব '৭১ নামের বিভিন্ন সংগঠনও গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত ছিল। এরা মূলত আওয়ামী লীগের সমর্থক। এ ছাড়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এর মধ্যে রীতিমতো কর্তৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

লক্ষ করার বিষয়, প্রথমোক্ত সংগঠনগুলোই ইমরানের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনে। 'গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকবৃন্দ' নাম দিয়ে তারা সংবাদ সম্মেলন করে ডা. ইমরান এইচ সরকারকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এটা যেদিন ইমরানের ওপর হামলা হয় তার পরের দিনের ঘটনা। হামলার পর ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরও গভীর হয়। অভিযোগ করা হয়, ইমরান বেপরোয়া চাঁদা উঠিয়েছেন, বেহিসেবী জীবনযাপন করছেন।

এমনও বলা হয় যে, ইমরান জামায়াতে ইসলামী থেকে টাকা নিয়েছেন। এসব অভিযোগের বেশ কিছু অংশে ছাত্রলীগও গলা মেলায়।

পাঠকবৃন্দ, আমি বলেছি এ ঘটনায় অনেক মানুষ আছেন যারা মর্মাহত হয়েছেন। প্রবাস থেকে অনেকে আমাকে ফোন করে তাদের বেদনার কথা জানিয়েছেন। জানতে চেয়েছেন এরকম কেন হলো? আসলে হয়েছে কী?

আমি কীভাবে বলব আসলে কী হয়েছে? ইমরান কি জামায়াতের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন? আমি দেখিনি।

কেউ কি দেখেছে? কারও কাছে প্রমাণ আছে? ইমরানবিরোধী অংশ অবশ্য ৬ তারিখ বলেছে, এ ব্যাপারে তারা ৭ এপ্রিল প্রমাণাদি হাজির করবেন। কিন্তু মনের মধ্যে প্রশ্ন উঁকি দেয়, জামায়াত ইমরানকে টাকা দেবে কেন? ইমরান জামায়াতের পক্ষে কিছু করেছেন এখন পর্যন্ত? আমি তো পত্রিকায় দেখলাম, সরকার যে ইসলামী ব্যাংকের টাকা নিয়েছে তিনি তার বিরোধিতা করেছেন। এ সংগঠকরা সে সম্পর্কে কী বলবে?

ইমরানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তারা করেছে সেগুলো তারা কমিটিতে আনুক। দোষ প্রমাণ করে তাকে মুখপাত্রের দায়িত্ব থেকে বের করে দিক। তা না করে তার গায়ে হাত দেওয়া হলো কেন? গণজাগরণ মঞ্চের একটি নাম হয়েছিল এ জন্য যে, ফাঁসির দাবিতে তারা একটি সত্যিকার অহিংস আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা পর্যন্ত এই জন্য গণজাগরণ মঞ্চের প্রশংসা করেছেন। ডা. ইমরান এবং তার সঙ্গীদের ওপর মঞ্চের আরেক অংশের হামলা গণজাগরণ মঞ্চের এই পজিটিভ ইমেজটা ধ্বংস করে দিল।

আমি খুব দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, যারা গাজোরী করে, পেশিশক্তি ব্যবহার করে, তারা গণতন্ত্রের শক্তি হতে পারে না। ইমরানদের কোনো দোষ নেই তা আমি বলছি না। আসলে আছে কি নেই তা আমি জানি না।

কিন্তু তাদের ভুল আছে। এটা শুরুতে বলিনি। কিন্তু এখন বলা দরকার বলে মনে করছি। সরকার এবং সরকারি সংগঠন সম্পর্কে তাদের ধারণা কী ছিল? তারা কি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দল মনে করেন? এখনো?

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে, এত বড় জুয়া চুরির পরেও? তাদের অন্যতম সংগঠক, বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক স্লোগানকন্যা বলে পরিচিত লাকী আক্তার এ নিয়ে দুবার মার খেলেন। তার কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন আপনারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন চান তো শুধু যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলছেন কেন।

দুর্নীতি, গণতন্ত্র এসব ব্যাপারে বলবেন না? লাকী আক্তার জবাবে বলেছিলেন, এখন বাংলা পরীক্ষা চলছে। এখন বাংলা পড়ি, ইংরেজি পরীক্ষা পরে। তখন ইংরেজি পড়ব। এখন লাকী আক্তার বা ইমরান সরকাররা কী মনে করেন? বাংলা পরীক্ষা কি শেষ হয়েছে? ইংরেজি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবেন? নাকি বাংলাতেই থাকবেন?

লেখক : রাজনীতিক, আহবায়ক নাগরিক ঐক্য।

ই-মেইল :mrmanna.bd@gmail.com

 



সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.