‘আরে সাবরিনের মা, আমার ধানের ভুঁই কো! কালো হাম্বির হইয়া উঠিছিলি ধান। আজ যে বিল ধলা মাইরি গিচে। এত পানি কোইত থাইকি আসলি!’
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির বাইরে এসে চোখ রগড়াচ্ছিলেন কৃষক মুনসুর রহমান। তার পরই এভাবে চিত্কার করে ওঠেন তিনি। যে বিলে এক ফোঁটা পানি ছিল না, হঠাত্ পানিতে সেই বিল ভেসে গেছে।
তলিয়ে গেছে তাঁর জমির ধান।
মুনসুর রহমান বলেন, ‘বছরের পর বছর ভরা আষাঢ়েও বিলে পানি থাকে না দেখে নওটিকা, আরিপুপুর, মোল্লাপাড়া, ধন্দহ, মাউদপাড়া—এই পাঁচ গ্রামের মানুষ এবার বিলের তলায় ধান রোপণ করেছিলেন। এক দিনের বৃষ্টিতে সব তলিয়ে গেছে। ’
বর্ষার এই স্বভাব দেখে শুধু পাঁচ গ্রামের মানুষ নন, পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষই হতবাক হয়ে গেছেন। কারণ রাজশাহীতে গত কয়েক বছরে খরা ছিল চরম।
মানুষ শ্রাবণ-বর্ষণের কথাই ভুলতে বসেছিলেন।
রাজশাহী আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে রাজশাহীতে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১১৫৮ দশমিক ৯ মিলিমিটার। ২০১০ সালে বৃষ্টির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮০৩ দশমিক ৫ মিলিমিটার। ২০১২ সালে বৃষ্টি হয়েছিল ১৮৭ দশমিক ৪ মিলিমিটার। ২০১৩ সালে হয়েছে মাত্র ১৮ দশমিক ৩ মিলিমিটার।
এবারও আষাঢ়ের শুরুতে মনে হয়েছিল বৃষ্টি হবে না। কিন্তু এখন সেই বৃষ্টিই হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিবৃষ্টি।
গত শুক্রবার থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চারদিকে ডোবা-নালা-খাল-বিল পানিতে টলমল করছে। ব্যাঙের ডাকে গ্রামগুলো যেন তার আগের চেহারা ফিরে পেয়েছে।
বাঘা উপজেলার নওটিকা-আরিপুপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দুলারী খাতুন বলেন, যে পুকুরে তাঁরা রীতিমতো মাছ চাষ করতেন, গত চার বছর ধরে সেই পুকুরে একফোঁটা পানি নেই। বোরো ধান চাষের সময় নলকূপ থেকে পানি উঠতে চায় না। সবাইকে বিলের তলায় ধান রোপণ করতে দেখে তিনিও গত সপ্তাহে নওটিকার বিলের তলায় ধান রোপণ করেন।
গত রোববার সকালে দুলারী খাতুনের ধানের জমি তলিয়ে গেছে। তিনি বলেন, আবাদ নষ্ট হলেও তিনি পানি দেখে খুশি হয়েছেন।
অন্তত ভূগর্ভস্থ পানির স্তরটা এবার ওপরে উঠে আসবে। পুকুরগুলো প্রায় ভরে গেছে। তাতে এবার মাছ ছাড়া যাবে।
বাঘা উপজেলার নওটিকা গ্রামের গৃহবধূ সাবিহা খাতুন জানান, সাত বছর হচ্ছে তিনি এই গ্রামে বউ হয়ে এসেছেন। এই প্রথম তিনি বিলে এত পানি দেখছেন।
শুধু গ্রামে নয়, দীর্ঘদিন পর বৃষ্টির এই রূপ দেখে প্রথম আলোর রাজশাহী বন্ধুসভার বন্ধুরা গত রোববার বর্ষা বরণ উত্সবের আয়োজন করেছিলেন। এতে রাজশাহী নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজ বন্ধুসভার উপদেষ্টা ও কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক সাইয়েদুর রহমান দুই দিন আগে থেকে এই অনুষ্ঠানের জন্য ১০০ কদম ফুল জোগাড় করতে বলেছিলেন।
সাইয়েদুর রহমান বলেন, ‘ছেলেরা সারা শহর ঘুরে কোথাও কদম ফুল খুঁজে পায়নি। হঠাত্ রোববার সকালে তারা দেখে সব কদমগাছে ফুল ফুটে গেছে। বৃষ্টি দেরিতে হওয়ার কারণে ফুল ফুটতেও দেরি হয়েছে।
ভারী বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সব গাছে কদম ফুল ফুটে গেছে। ’
তিনি বলেন, গত রোববার বিকেলে প্রথম আলোর রাজশাহী কার্যালয়ে যখন বর্ষাবরণ অনুষ্ঠান চলছিল, তখনই বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছিল। অনুষ্ঠানে সব অতিথিকে কদম ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/ আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান...’ গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুরু হয়।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে নওটিকার বিলে গিয়ে দেখা যায়, বিলে পানি আর পানি।
গ্রামের শিশু-কিশোরেরা কলার ভেলা তৈরি করে বর্ষার উত্সবে মেতে উঠেছে।
গ্রামের যুবক জোবায়ের আহমেদ রাসেল বলেন, এই বিলে একসময় বড় নৌকা চলত। এখন সেসব শুধুই স্মৃতি। ছোটবেলায় তাঁরা কলার ভেলা তৈরি করে বিলে ভেসে বেড়াতেন। এখনকার শিশুরা সেটাও দেখেনি।
তাই তিনি কয়েকজন শিশু-কিশোরকে কলার ভেলা তৈরি করে দিয়েছেন। তারা সারা দিন মজা করে ভেসে বেড়াচ্ছে।
বিলের পানির দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল সেই গান, ‘আষাঢ় মাইসা ভাসা পানি রে...’।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।