লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। পরীক্ষা বিভীষিকা
মোহাম্মদ ইসহাক খান
আজ নীলার পরীক্ষা শেষ হল। টানা এক মাস ধরে পরীক্ষা চলেছে, টার্ম ফাইনাল।
এক সপ্তাহ পর পর একটা করে পরীক্ষা, পাঁচ সপ্তাহ লেগেছে পাঁচটা পরীক্ষা হতে। সারা সপ্তাহ ধরে একটা সাবজেক্টের ওপর প্রস্তুতি নেয়া, তারপর সপ্তাহ শেষে সেটার ওপর পরীক্ষা দিতে বসা, এটা যেন অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো। একসময় সবাই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো, "মরার পরীক্ষা" শেষ হয় না কেন? অবশেষে শেষ হওয়াতে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
এক্সাম শেষ হওয়ার পর সব ছাত্রছাত্রীরই ইচ্ছে করে, পরীক্ষা সাঙ্গ হবার ব্যাপারটা একটু সেলিব্রেট করার। নীলাও তার ব্যতিক্রম নয়।
সে রাত জেগে জেগে একমাস ধরে পড়েছে, দুই চোখের নিচে গভীর কালি পড়ে গেছে। সারা শরীর অবসাদে ভেঙে এসেছে, তবুও একটু বিশ্রাম নিতে পারেনি, পরীক্ষার পড়ার চাপ তাকে ঘুমোতে দেয় নি। এখন সব শেষ, ছুটি, কয়েক সপ্তাহ অখণ্ড অবসর। এখন সে চাইলে সারাদিন ধরে ঘুমোতে পারে, কেউ মানা করবে না, কোন ক্ষতি হবে না।
নীলা ঠিক করলো, সে প্রথমে পুরো এক দিন ধরে সারাদিন, কয়েক দফায় শুধু পড়ে পড়ে ঘুমবে, আর কিচ্ছু করবে না।
শরীরটা ঝরঝরে হলে তারপর অন্য কাজ। অনেক প্ল্যান করা আছে, এই বন্ধে সে কী কী করবে, কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবে।
গরম পানি দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে লম্বা একটা গোসল করে, ভরপেট খেয়ে সে সোজা কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। শোয়া মাত্রই ঘুম। "ভুক্তভোগী" মাত্রই জানে, ভার্সিটির একজন ছাত্র বা ছাত্রী পরীক্ষার পর অবসর পেলে কীভাবে ঘুমোতে পারে।
তাই নীলাও ঘুমিয়ে পড়লো। তার ঘুম হবার কথা অতি গভীর, কালো পর্দার মতো নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ঝুলে থাকার কথা তার চোখের সামনে। কিন্তু ঘুমিয়েই নীলা একটা আজব স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নটা তার সদ্য সমাপ্ত পরীক্ষা নিয়ে।
সে দেখল, প্রথম পরীক্ষা যেটা ছিল, অর্থাৎ ধাতব কৌশল পরীক্ষা, সেটাতে সে রোল নম্বর লেখে নি।
শুধু তাই নয়, সে কোন বর্ষের ছাত্রী, সেটা পর্যন্ত ভুল লিখেছে। সে দুই হাজার নয় ব্যাচের ছাত্রী, কিন্তু সে লিখে দিয়েছে দুই হাজার আট। অর্থাৎ ভুল জায়গায়, বড় ভাইয়া আর আপুদের খাতার সাথে চলে গেছে তার খাতাটা। খুব কম সম্ভাবনা আছে এরপর তার খাতাটার সঠিক জায়গায় ফিরে আসার। অর্থাৎ এই সাবজেক্টে সে পাবে পুরো শুন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম, রোল নম্বর না লিখলে কিংবা ভুল লিখলে, শিক্ষক ঐ খাতা বাতিল বলে গণ্য করতে পারেন।
এই বিষয়টা তাত্ত্বিক, সে খুব কষ্ট করে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করেছিল, মাথার ভেতর থাক থাক করে সাজিয়ে রেখেছিল উত্তরগুলো। লিখেছিলও সব ঠিকঠাক মতো, তার খাতা ভরে গিয়েছিলো গোটা গোটা লেখায়। কিন্তু এ কী ভুল হয়ে গেল? এত লিখেও, সবচেয়ে ভাল পরীক্ষা দিয়েও সে পাবে শুন্য।
ঘুমের মধ্যে নীলা একবার পাশ ফিরল।
তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে।
দ্বিতীয় পরীক্ষা ছিল সংখ্যাতত্ত্বের ওপর। অনেকগুলো ডিরাইভেশন শিখতে হয়েছিলো, অনেকগুলো অংক করতে হয়েছিলো। সিলেবাস ছিল খুব বিদঘুটে, তার ওপর এই সাবজেক্টের টিচার তেমন কিছু পড়ায় নি, ক্লাসে এসেছে আর গেছে বলে নিজেকেই অনেক কিছু শিখে নিতে হয়েছিলো, খাটাখাটনির সীমা ছিল না। তারপরেও সে সাবজেক্টটাকে কব্জা করে ফেলেছিল।
কিন্তু স্বপ্নে নীলা দেখল, যে দুটো লুজ শিট সে নিয়েছিল, সেগুলোর স্ট্যাপ্লার পিন আলগা হয়ে আসল খাতা থেকে খুলে গেছে। আলাদা হয়ে চলে গেছে অন্য জায়গায়। এবং সেই লুজ শিটগুলোতে ওর রোল লেখা নেই। এখন কাগজগুলো "বেওয়ারিশ"।
সবচেয়ে বেশি নম্বর ছিল যে প্রশ্নটাতে, সেটার উত্তর ছিল ঐ দুটো লুজ শিটে।
কিন্তু সেগুলো তো আলাদা হয়ে গেছে, এখন উপায়? নির্ঘাত সে বি কিংবা বি মাইনাস পাবে, এ প্লাস তো দূরের কথা।
নীলা অস্থিরভাবে ছটফট করলো, ঘুমের মধ্যেই।
তৃতীয় পরীক্ষা ছিল "গভর্নমেন্ট", অর্থাৎ সরকার। সবাই মজা করে এটাকে "সরকারী সাবজেক্ট" বলে থাকে। নামের মতোই সাবজেক্টটা, কেউ গুরুত্ব দেয় না; না ছাত্রছাত্রীরা, না টিচারেরা।
ক্রেডিট কম, খাটুনিও কম। ছোট সিলেবাস, ক্লাসে এসে স্যার-আপারা গল্প করতেন, অনেক মজা হতো। পরীক্ষার আগে দু'তিন দিন ধরে "চোথা" নামের বস্তুটি ঝাড়া মুখস্ত করে ফেললেই কেল্লা ফতে। নীলা তাই করেছিল। এবং পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছিলো, আর সবার মতো।
কিন্তু সে স্বপ্নে দেখল, একটা দুষ্টু ছেলে ওর খাতা টিচারের চোখ এড়িয়ে স্যারের রুমে ঢুকে কালো কালির কলম দিয়ে বড় বড় করে দাগ দিয়ে কেটে দিয়েছে। পুরো খাতা ভর্তি লেখা, কিন্তু ছেলেটা নীলার খাতার সব লেখা কেটে দিয়েছে, যাতে মনে হয়, নীলা নিজেই কেটেছে। ছেলেটা নীলাকে ভাল ছাত্রী বলে ঘোর শত্রু বিবেচনা করে থাকে, তাই এই দুর্বৃত্ততা।
এখন নীলা এই সাবজেক্টেও ফেল। শুধু ফেল নয়; জিরো, গোল্লা।
ভার্সিটির ইতিহাসে নতুন মাইলফলক বলা যায়। এই সাবজেক্টে কেউ কোনদিন ফেল করেনি, কিন্তু সে করবে।
নীলা আরও অস্থির হয়ে উঠলো, যদিও ঘুম ভাঙে নি এখনো। বড় বড় নিঃশ্বাস পড়ছে তার।
চতুর্থ বিষয়টি ছিল অংক, গণিত।
তার পছন্দের সাবজেক্ট। প্রথম চার টার্মের প্রতি টার্মেই অংকের একটা না একটা সাবজেক্ট থাকে। নীলার মাথা ভাল বলে অংক সহজেই মেলাতে পারতো। অন্যরা যেখানে উত্তর সম্বলিত নোটবই থেকে অংক "মুখস্ত" করে যায় (এবং প্রশ্ন একটু ঘুরিয়ে দিলেই আকাশ থেকে পড়ে, টিচারদেরকে গালিগালাজ করে), নীলা সেটার ধার দিয়েও যায় না। নিজে নিজে অংক করে।
কাজেই এবার একটু "হার্ড অ্যান্ড ট্রিকি" প্রশ্ন হওয়া সত্ত্বেও নীলা আটকায় নি।
কিন্তু নীলা দেখল, সে দুই নম্বর প্রশ্নের উত্তরে লিখেছে তিন নম্বরের উত্তর, আর তিন নম্বর প্রশ্নের উত্তরে লিখেছে ছয় নম্বরের উত্তর। ভার্সিটির নীতিমালায় আছে, প্রশ্নের নম্বর না লিখলে কিংবা ভুল লিখলে কোন নম্বর না-ও দেয়া হতে পারে। কাজেই নীলা এই সাবজেক্টে পাশ করবে কীনা সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, কারণ দুটো প্রশ্নে চল্লিশ-চল্লিশ করে মোট আশি নম্বর চলে গেছে।
নীলা ঘুমের মধ্যেই অল্প অল্প গোঙানো শুরু করলো, যেন ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
সর্বশেষ পরীক্ষা ছিল বলবিদ্যা, একটু জটিল সাবজেক্ট। বল এবং বস্তুর নানাবিধ সম্পর্ক নিয়ে একটা বিশাল সিলেবাসের সাবজেক্ট। স্যার ক্লাসে এসে এক ঘণ্টা ধরে করাতেন দুই লাইনের অংক (তিনি নিজেও সাবজেক্টটা ঠিকমতো বুঝতেন কীনা সেটা নিয়ে অনেক স্টুডেন্টের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল), ক্লাসটেস্টে দিতেন দশ লাইনের অংক (সময় থাকতো পাঁচ মিনিট), এবং টার্ম ফাইনালে এসেছিলো এক একটা চল্লিশ-পঞ্চাশ লাইনের অংক। তবুও নীলা পেরেছে, সময়মত সব প্রশ্নের উত্তর লিখে শেষ করতে। ভাল মতো প্র্যাকটিস করা ছিল বলে কষ্ট হলেও পেরেছে।
কিন্তু নীলা দেখল, সব ক'টা অঙ্কে ওর উত্তর ভুল এসেছে, একেকটা অংকে আধঘণ্টা ধরে দীর্ঘ সিঁড়িভাঙ্গা সব হিসাব-কিতাব শেষে সে ক্যালকুলেটর টিপে যে উত্তর বের করেছে, তার কোনটাই সঠিক উত্তরের ধারে-কাছে নেই। যেমন একটা প্রশ্নের উত্তর পাঁচ নিউটন, ওর এসেছে মাইনাস চারশো উনিশ দশমিক আট! এখন যদি টিচারের দয়া হয়, তাহলে কিছু "পার্শিয়াল মার্কিং" করলেও করতে পারেন, আর নইলে ... ...
সহসা স্বপ্নটা মুছে যায়। অন্য একটা দৃশ্য চলে আসে। নীলা দেখে, সে গ্রেড শিট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই ভাল রেজাল্ট করেছে বলে অডিটোরিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে লাফঝাঁপ দিচ্ছে, কোলাকুলি করছে, আর সে সবার থেকে দূরে, এক কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
সব সাবজেক্টের পাশে লাল কালিতে লেখা আছে, "F", অর্থাৎ "ফেল"। এই টার্মে সে কোন সাবজেক্টেই সে পাশ করতে পারে নি।
নীলার ঘুম ভেঙে যায়, বিকট চিৎকার করে সে জেগে ওঠে। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, সে ভীষণ হাঁপাচ্ছে। ফ্যানের স্পিড পুরোদমে বাড়িয়ে দিয়েও হাঁসফাঁস ভাবটা কাটতে অনেক সময় লাগে তার, জগ থেকে ঢেলে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে ফেলে, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলো।
কুৎসিত স্বপ্নটার কথা ভেবে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। এই পাঁচটি পরীক্ষা নিয়ে সে যা যা দেখেছে, তার যে কোনটাই তো ঘটতে পারে। অসম্ভব তো নয়।
নীলার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ভয়ের স্রোত নেমে গেল।
(১৮ ডিসেম্বর, ২০১২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।