আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিজয়ের ৪১ বছরঃ যা চেয়েছি তা পাই নি

জগতে এমন কোন রাজশক্তি নেই, যা বিপ্লবী জনতার অপ্রতিরোধ্য গতিকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। আপামর জনতা শান্তিপ্রিয়। তবে তারা অধিকার সচেতন। তাই তাদের ন্যায্য অধিকারে কেউ অবৈধ হস্তক্ষেপ করলে তারা তা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারে না। জীবন বাজি রেখে হলেও আন্দোলন চালিয়ে যায় নিজ অধিকার রক্ষার জন্য।

নিজেদের মধ্যাকার সকল ভেদাভেদ ভুলে গড়ে তোলে দুর্বার গণআন্দোলন। আর সেই আন্দোলনের স্লোগানে কেঁপে উঠে অত্যাচারীর মসনদ। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র তাদের স্বজাতি ভাইদের উপর বেইনসাফি করতে কোন কার্পন্য করেনি। সকল ক্ষেত্রেই তারা বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে।

পূর্ব পাকিস্তানিরা যাতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে সুযোগ সুবিধা কম পায়, তার জন্য চালায় পরিকল্পিত কর্মকান্ড। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে কয়টি প্রদেশ হবে, তাও ঠিক করতে পারে নি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। দাবি উঠেছিল ৫টি প্রদেশ করার। আর তা ছিল যৌক্তিক। যদি পাঁচটি প্রদেশ করা হতো তাহলে পূর্ব পাকিস্তান বৃহত্তম প্রদেশ হতো।

তাই তারা ১৯৫৬-তে পাকিস্তানকে দুটি প্রদেশে ভাগ করলো। এতে করে সাংবিধানিকভাবেই পূর্ব পাকিস্তান বৈষম্যের শিকার হলো। পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতেই তারা বাঙ্গালিদের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে উর্দু ভাষা জোর পূর্বক আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাইলো। এভাবে সকল ক্ষেত্রে নির্জাতিত বাঙ্গালি মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। সংগঠিত হলো ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে গনঅভ্যুন্থানসহ ছোট বড় অসংখ্য আন্দোলন।

এভাবে নানা আন্দোলন সংগ্রামের পথ পরিক্রমায় আসে ১৯৭১। শেখ মুজিবর রহমানের সাথে আলোচনা চলছিল ইয়াহিয়া খানের। কিন্তু সে আলোচনা দেখে নি সফলতার মুখ। চোরের মত পালিয়ে যায় ইয়াহিয়া খান। গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবর রহমানকে।

২৫ শে মার্চ ১৯৭১। দিনের শেষে নেমে এলো রাত। আনুমানিক ১ টা। হঠাৎ করে থেমে গেল ঢাকা। বন্ধ হয়ে গেল মানুষের কোলাহল।

শুরু হলো গোলাগোলির শব্দ। মিলেটারির বুটের আওয়াজে অস্থির পুরো দেশ। শুধু রক্ত আর রক্ত। চারদিকে শুধু রক্তের গন্ধ। গন্ধ মিলিয়ে গেল অন্য সব কিছুর।

বাঁচার জন্যে চলে হাজারো প্রচেষ্টা। কিন্তু ব্যর্থ হয় অনেকেই। ঘরে ঘরে চলে নির্বিচার হত্যাকান্ড । যার নাম দেয়া হয় ''অপারেশন সার্চলাইট'' । ঘোষনা করা হয় স্বাধীনতা।

মুক্তিপাগল মানুষ দীর্ঘ দিনের বন্দী দশা হতে মুক্ত হতে যোগ দেয় যুদ্ধে। উচ্চতর প্রশিক্ষন প্রাপ্ত পাকসেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করতেও কুন্ঠিত হয় নি এদেশের মুক্তিপাগল জনতা। তাদের চোখে মুখে মুক্তির স্বপ্ন। দীর্ঘদিনের বন্দীদশা হতে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার সূর্য প্রত্যক্ষ করতে তারা আজ ব্যকুল। ২৬শে মার্চ থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

সেদিন ছিলো পবিত্র জুমাবার। একদিনে শেষ হয়নি এ সংগ্রাম। নানা স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, বেদনা ও সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে চলতে থাকে এ সংগ্রাম-দীর্ঘ নয় মাস পর্যন্ত। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর সৃষ্টি হয় নতুন এক ইতিহাস। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র।

আমরা পাই লাল সবুজের এক পতাকা। স্বাধীনতা কারো ব্যক্তিগত বা দলীয় সম্পদ নয়। এর মালিক দেশের আপামর জনতা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত কিছু লোক এমন আচরণ করছে যেন এটি তাদের ব্যক্তিগত বা দলীয় সম্পত্তি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিছু লোক বিশেষ করে অনেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা প্রান ভয়ে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমায় ভারতের মাটিতে।

তারা যে জনপ্রতিনিধি, যাদের ভোটে তারা নির্বাচিত হয়েছে, তাদেরকে অসহায় অবস্থায় রেখে দেশ ছেড়ে যেতে তাদের একটুও বিবেকে বাঁধেনি। নিজের স্বার্থকেই তারা বড় করে দেখেছে। হায়রে মনুষত্য!! যাই হোক, দেশ স্বাধীন হবার পর দেশে ফিরে এসে তারা আবার দেশ প্রেমিকের অভিনয় শুরু করে। দেশের মানুষের কথা চিন্তা না করে আরম্ভ করে শুবিধাবাদি রাজনীতি। খর্ব করা হয় সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা।

দেশে কায়েম করা হয় এক প্রকার রাজতন্ত্র। রাজনৈতিক দিক দিয়ে যারা তাদের বিপক্ষে ছিল তাদের উপর আরোপ করে ভিত্তিহীন মিথ্যা অপবাদ। ২৩শে ডিসেম্বর ১৯৮৮সালে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় মেজর (অবঃ) এম এ জলিল সাহেবের এক বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে স্বাধীনতার পর যারা এদেশে প্রথম সরকার গঠন করে, তারা একটি বিশেষ বাহিনী গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যাও করিয়েছে। ছি ছি ছি!! ভাবতেও অবাক লাগে!! কোথায় আমাদের দেশপ্রেম!! এখানে দেখুন অনেক স্বাধীনতার শত্রুদেরকে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট। আর অনেক মুক্তিযোদ্ধা আজও পর্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করে আসছে।

মাঝে মধ্যে খবরেরে কাগজের এ সমস্ত রিপোর্ট আমাদের বিবেক বোধকে নাড়া দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান। জাতি আজো তাদের কাছে চির ঋনী। যে ঋন শোধ করা সম্ভব নয় কোন কালে। কিন্তু সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানও আজ নির্ধারিত হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়।

দেশে অনেক অস্বচ্চল মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও তাদের দিকে ঠিক মত লক্ষ্য না করে, লক্ষ্য করা হচ্ছে যত সব ফালতু কাজের দিকে। একটি জাতীয় দৈনিকে দেখেছিলাম এক বছর নাকি স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে শুধু মাত্র আতস বাজিতেই ব্যয় করা হয়েছিল ১০ কোটি টাকা। একটি স্বল্পোন্নত দেশের জন্য যা অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এ টাকা দিয়ে অস্বচ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা যেত। কিন্তু তা না করে করা হয়েছে অহেতুক কিছু কাজ।

বহু প্রানের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা আজ অনেকটাই অরক্ষিত। সীমান্তের প্রতিবেশীর অমানবিক আচরণ দংশন করে বিবেকবানদেরকে। অযোগ্য কিছু দায়িত্বশীল লোকের অদূরদর্শীতার কারনে আজ অরক্ষিত হয়ে পড়েছে আমাদের সীমান্ত। ট্রানজিটের মাধ্যমে প্রভূত ক্ষতি হবার আশঙ্কা করা হচ্ছে আমাদের দেশের। কিছুদিন পরপরই সীমান্তে মানুষ হত্যা বারবারই আমাদের মনে একটি প্রশ্ন সৃষ্টি করছে- আমরা কি আসলেই স্বাধীন!?!?! বি এস এফ কর্তৃক আমাদের দেশের এক যুবককে উলঙ্গ করে নির্মম নির্যাতন করার মত ঘটনা ঘটছে আমাদেরই চোখের সামনে।

এসবের বিরুদ্ধে যখন মানবাধিকার সংস্থা সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে, ঠিক তখনই আমাদের উপরের মহলের ব্যক্তিবর্গদেরকে বলতে শুনা যায়, এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই অথবা এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা অথবা দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ভালো আছে চিন্তার কিছু নেই। সরকার দাবী করে বিরোধীদের মদদে এসব ঘটছে, আর বিরোধীরা দাবী করে সরকারের ব্যর্থতায় এসব হচ্ছে। এগুলোর সমাধানের দিকে আমাদের কোন নজর নেই, মনে হয় আমাদের পুরো নজর অন্যকে দোষারোপের দিকে। দেশ স্বাধীন করার জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে সাধারন জনতা। কিন্তু আজ তারাও বঞ্চিত।

সংসদ ভবনে তাদের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে যতটুকু আলোচনা হয় তার চেয়ে অনেক গুনে বেশি আলোচনা হয় কার লাশ কবরে আছে আর কার লাশ কবরে নেই এ নিয়ে। কে ঠোঁটে লিপিস্টিক দিয়ে এসেছে আর কে লাল ওড়না গায়ে দিয়ে এসেছে এ নিয়ে। রাজনৈতিক ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্য আজ কুখ্যাত চোরকে দেশপ্রেমীক আখ্যা দেয়া হচ্ছে। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা যারা পাচার করছে, উপরের লোকদের মনোরঞ্জনের জন্য প্রকাশ্যে তাদের গুনকীর্তন করতেও কারো ঠোঁট কাঁপে না। আর প্রকৃত গুনী লোক পাচ্ছে না কোন কদর।

যার ফলশ্রুতিতে মেধা পাচার বেড়ে যাচ্ছে। দেশের সম্পদ যারা, তারা পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশের মাটিতে। দেশের প্রতিটি গূরত্বপূর্ন আন্দোলনে যে ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়, আজ সে ছাত্র সমাজকে ব্যবহার করা হচ্ছে নিজেদের সিংহাসন টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে। তাদের হাতে কলমের পরিবর্তে তুলে দেয়া হচ্ছে অস্ত্র। সার্টিফিকেট নিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাউকে কাউকে ফিরতে হচ্ছে লাশ হয়ে।

এসব কারনে মেধাবী ছাত্ররা আজ ছাত্র রাজনীতি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করার চেষ্টা করছে। যার ফলে খারাপ লোকদের হাতে চলে যাচ্ছে দেশের শাসন যন্ত্র। খারাপ কাজকে কৃতিত্ব মনে করা হচ্ছে আজ আমাদের দেশে। ধর্ষনের সেঞ্চুরী উদযাপন কারী তাই মিষ্টি বিতরন করে তার এ কৃতিত্বের সেলিব্রেট করে। তার উপরের লোকেরা তাকে এতে সমর্থন না দিলে কি এ কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব????? কোথায় আছি আমরা!!!!! যেখানে নিজের জীবনের নিরাপত্তা নেই, মান-সম্মানের নিরাপত্তা নেই, সেখানে আর আছে টা কি????? জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করে গেছেন আমাদের অনেক ভাইয়েরা।

একটি দেশের জন্য হাসিমুখে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে দেশ প্রেমের এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তাঁরা। এখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে একে রক্ষা করা। আর তা করতে না পারলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে শোষন, লাঞ্চনা, বঞ্চনা। তাই আসুন, সেই দিন আসার আগেই আমরা সচেতন হই এবং রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতা রক্ষার্থে সচেষ্ট হই। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।