নবীন মারাত্মক বন্ধু প্রিয় মানুষ! তার প্রথম পছন্দে থাকে হাসির ঝুড়ি নামে আখ্যায়িত বন্ধুরা। বাবা মা আর তার সহকারে ছোট সাংসার। বোনদের কথা বললেই নয়, তিন তিনটি বন তার। অবশ্য সব্বাইই গ্র্যাজুয়েট। বিবাহিত বটেই! কিন্তু কিছুটা গোছানো নেই বললেই চলে।
এই যে বড় বোনটা, তার আবার ডিগ্রি কমপ্লিট করা, কিন্তু সেটা ১৯৯৬ সালে। বিয়ে হয় ২০০০ সালে। তার জামাইবাবু এডভোকেট সাহেব। সৎ মানুষ বটে! মক্কেলরা কাজ করায় কিন্তু, যখন তাদের আচার ব্যবহারে বুঝেন যে গরীব, নাই বললেই, উত্তেজিত হয়ে বিচলিত হন না। তাদের বলেন, আচ্ছা ঠিক আছে! মক্কেলরা কেউ কেউ তার আচার-ব্যবহারে নিজের ধানি জমির ২ বা ৩ কেজি চাল বা অন্যান্য শস্যাদি দিয়ে যান।
কেউ বা মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দেন। তাই এডভোকেট সাহেবের দিন চলাটাও একটু কষ্টকর। পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন। এডভোকেট সাহেবের এখন ২ ছেলে। শিক্ষিত বউটা অলস প্রকৃতির, বাসার কাজ করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
তাই বর্তমানে পরিবারের আভিজাত্য জীবনধারাটা নাই বললেই চলে।
নবীনের মেজ বোনটা নবীনদের পরিবারের জন্য একটি বড় ছেলে হিসেবেই শ্রেয়। তার না আছে মেয়েরূপি সঙ্কচ বোধ, না আছে তার আভিজাত্য। নিতান্তই শিক্ষিত এবং গুণী একটি মেয়ে। অনার্স মাস্টার্স সবকিছুই সেকেন্ড ক্লাসে পাওয়া।
বিয়ে হয় ২০০৬ সালে। মাস্টার্সের এক বছর পরই তার বিয়ে হয়। সুন্দর জীবন তার। সুখী জীবন। জামাই তার ওষুধ কোম্পানির জ্যেষ্ঠ মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ।
হোন্ডায় করে আসে যায় মায়ের বাসায়। এক্সিকিউটিভ সাহেব, তার বউকে অন্যরকম ভালবাসেন। তার এই ভালবাসা এতটাই যে, বউ যখন অন্ত্বসত্তা, মায়ের বাসায়, তখন বউকে কামুক বার্তা মুঠোফোনে পাঠাতে, উদগ্রিব। রাতে তার ভাল লাগে না, সময় কাটে না।
কয়েক মাস পরই এক্সিকিউটিভ সাহেবের ঘরে একটি কন্যা সন্তানের আগমন।
অনেক সুন্দর জীবন। মেয়েকে একদম পুতুলের মত করে সাজিয়ে বের হয় মেজাপা। তাকে নানান কবিতা, রম্যগীতি, ছড়া, ঠাকুরমার ঝুলির গল্প, নানা ভাইয়ের গল্প, মামার গল্প, নানুর গল্প, দিদার গল্প, দাদা ভাইয়ের গল্প বলে বলে খাওয়াতে হয়। এযুগের বাচ্চাগুলা বোধয় এমনি হয়। নানা নাটকের আর বিনোদনের মধ্য দিয়ে তাদের খাওয়াতে হয়।
পুরো সুখী পরিবার। কিন্তু হঠাৎ এক রাতে মেয়ের বাবা, এক্সিকিউটিভ সাহেব প্রচণ্ড রকমের শক্তি দিয়ে বউয়ের হাতটা ধরে বললেন, টুনির মা, আমার বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমার বুকটা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। বউ, শঙ্কায় ফোন দেয় তার ভাই, বাবা এবং তার নন্নস কে। কান্না, চিৎকার করে কান্না।
এই কান্নায় মেয়ে টা ঘুম থেকে উঠে যায়। বুঝতে পারেনা সে কি হচ্ছে। সেদিন এক্সিকিউটিভ সাহেব বেচে যান। কিন্তু ধরা পড়ে হৃদযন্ত্রে ব্লক বলে একটা রোগ। অনেক রকম পরীক্ষা এবং এঞ্জিওগ্রাম করে দেখা যায় তিনি মোটামুটি সুস্থ।
বউের ভাই থাকে রাতে, দিনে শ্বশুর বাড়ির মানুষ। এক্সিকিউটিভ সাহেব এখন সুস্থ। ট্রান্সফার নিলেন চাঁদপুরে। শিফটও হয়ে গেলেন।
সুন্দর ছোট একটা ছিমছাম শহর।
এখানেই একটা বাসা ভাড়া নিলেন এক্সিকিউটিভ সাহেব। বউ মেয়েকেও নিয়ে আসলেন। বউ জামাই মিলে বাজারে যান, মেয়ে হোন্ডার সামনে বসে, বউ পেছনে। তিনজন মিলেই চটপটি ফুচকা খেতে হোন্ডা করে যান। মেয়ে ধীরে ধীরে কথা বলা প্রায় শিখে ফেলল।
বাবা আমাত দোনো তুতুল নিয়ে আতিও, আইক্কিম, তক্লেত, তোতো তো আনিও। বাবা খুশি, মেয়ে আবার ফোন দেয়, বাবা, তুমি তোতায়? তুমি তাতারি আত। বাবা হাসেন মেয়ের নতুন কথা শুনে। দিন যায় মেয়ে কথার ঝুরি থেকে নতুন নতুন কথা বলে।
রাতে মেয়ের ঘুম দেখে বউ জামাই কুচিকি হাসি হাসেন।
চুমু দেন মেয়ের কপালে। শুয়ে পড়েন তাড়াতাড়ি। রাতে আবারো এক্সিকিউটিভ সাহেবের প্রবল শক্তি দিয়ে বউয়ের হাত ধরে আর্তনাদ। ব্যথা, প্রচণ্ড রকমের ব্যথা। কুঁকড়িয়ে কাঁদছেন তিনি, বিছানার চাদর মুঠো করে ধরছেন, আবারো বউের হাত, ডান পাশে উফ বলে বলে কাতরাচ্ছেন।
আবারো চিৎকার করে কান্না, মেয়ের ঘুম ভাঙে, কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না......
এক্সিকিউটিভ সাহেব কে চাঁদপুরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হল। অবস্থা তেমনটা ভাল না। ডিসিশন নেয়া হল ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। বউয়ের ভাই আসল, বাবা আসল, মেয়েটাকে নিয়ে আসল চট্টগ্রামে তার মামা। নানা ভাই থেকে গেল মা বাবার কাছে।
এক্সিকিউটিভ সাহেব কে পরেরদিন রাতেই ঢাকা নিয়ে যাওয়া হল। ভর্তি করা হল বারডেম হাসপাতালে। হার্টে রিং বসাতে হবে। খরচ হবে লাখ তিনেক টাকা। নানা ভাইয়ের অতটা টাকা নেই, না বাবার আছে জমানো।
মা একটা ডিপোজিট চালায়, কিন্তু তাতে হাজার বিশেক টাকা আছে। সমস্যা নাই, পুরো শ্বশুরবাড়ি এবং অন্যান্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন থেকে আপাতত দুই লাখ টাকা মেনেজ হল। ডাক্তার সাহেব বলে দিলেন, বাকি এক লাখ টাকা অপারেশনের মধ্যকার সময়ে দিয়ে দিবেন কিন্তু। ডাক্তার সাহেবের সিগারেট টানা টা শেষ দিকে। সিগারেটও শেষ হল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে।
ওটি তে ঢুকানো হল এক্সিকিউটিভ সাহেব কে। বাইরে রয়ে গেলেন তার শ্বশুর, বউ আর ভাইএর একটি দল।
ফোন দেয়া হচ্ছে মানুষকে আর একটা লাখ টাকা লাগবে। ব্যবস্থাটাও হয়ে গেল। কিন্তু টাকা টা পেতে পেতে দুপুর ২টা হবে, তার পর এস এ পরিবহনে কি আধুনিক এক পদ্ধতিতে ফ্যাক্স নামক যন্ত্রের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হবে।
কিন্তু এখন দুপুর ১২.৩০ টা। অপারেশন এর প্রায় মধ্যকার সময়, ওটির সামনে শ্বশুর আর বউ দাঁড়ালেন আবার, শুধু ডাক্তার যদি অপারেশন বন্ধ করে দেন? ঠিক ঠিক, ডাক্তার সাহেব আসলেন, দেখলেন, তারা দাঁড়ানো, হাসি দিয়ে বললেন, কি খবর? বউ আগ বাড়িয়ে বলে, স্যার, টাকাটা মেনেজ হয়ে গেছে, শুধু ট্রান্সফার করা বাকি, আপনি অপারেশন শেষ হবার সাথে সাথেই টাকাটা হাতে পেয়ে যাবেন। এইবার ডাক্তার সাহেব একটু ক্ষেপেই গেলেন। উনি ওটি থেকে বের হয়ে আসলেন, বললেন, দেখুন আমার টাকা না এটা, আমি রিস্ক নিতে পারবনা,আপ্নি টাকা দিবেন তারপর আমি অপারেশন শেষ করব। আবারও কান্নার শব্দ।
আমার বাবা হতপিতালে, ডাক্তার ইন্দেকশান দিত্তে। খুব বেতা, কত্ত, আমি মার কাতে দাব, বাবার কাতে দাব। মেয়ে টা সকাল থেকে কিছু খাচ্ছেনা। শুধু বাবার কাছে যাবে নয়তো মার কাছে যাবে। বড় খালামনি তাকে জুস, চকলেট এনে দিল।
বশে আসেনা। বাইরে ঘুরতে নিয়ে গেল, প্রথমে একটু ভাল ছিল, আবারও সেই মা না হয় বাবার কাছে যাবে। কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পরল বুড়িটা।
স্যার আপনার পায়ে পড়ি, আমরা আপনার টাকাটা হাতেই দিয়ে দেব, আপনি আল্লাহর দোহাই লাগে অপারেশন টা শেষ করুন। আপনারা আমাকে বিরক্ত করছেন কেন? টাকা টা ট্রান্সফার করতে এতক্ষন লাগে? বাঙ্কে ডিপো করে দিলেই তো পারেন।
স্যার আজকে শনিবার, স্যার প্লিজ, আমার স্বামীর অপারেশনটা করেন না। আবারও চিৎকার করে কান্না। পাশের কলিগ ডাক্তার বলেন, করে দেন না, এদের দেখে মনে হয় না পলটি মারবে। ডাক্তার সাহেব বললেন, ঠিক আসে, আমি করে দিচ্ছি, কিন্তু টাকাটা প্লিজ তাড়াতাড়ি দিয়ে দিয়েন।
অপারেশন সাকসেসফুল।
ডাক্তার ওটি থেকে বের হলেন, হার্টে রিং পড়ানো শেষ। টাকা হাতে পেয়ে তার রুম এর কোন এক মানুষকে দিয়ে কি যেন বললেন। স্যার, অসংখ্য ধন্যবাদ, আপ্নি দয়াবান, ইংরেজিতেও বলল "থ্যাংকস এলট এগেইন"। ডাক্তার বললেন, আরে সমস্যা নাই।
শ্বশুর মহাশয় এক্সিকিউটিভ সাহেবের পাশেই থেকে গেলেন, রাতে ওয়ার্ডের বাইরে বিছানার চাদর পেতে ঘুমান, মেয়ে থাকে জামাইয়ের পাশে।
এইতো, পরশু দুপুরেই পেশেন্টকে ছেড়ে দিবে হাসাপাতাল।
শ্বশুর পরেরদিন রাতে রওনা দেন। পথে ফোন আসে, বাহবা দেয়া, মেয়ের জামাইয়ের জন্য তার নিরলস পরিশ্রম, মেয়েকে আবারও সুখ এনে দিল। সবই আল্লাহ্র ইচ্ছা। ঘুম দিলেন শান্তির।
রাতে হঠাৎ ফোন এক্সিকিউটিভ সাহেবের নাম্বার থেকে, ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই চিৎকার করে কান্নার শব্দ.........
মেয়ের ঘুম ভাঙে, সকালের আলোটা তার মুখে পড়ে, রাস্তা চোখে পড়ে তার, গাড়ি ছুটে চলছে, সে যার কোলে সে তার মা নন বাবা নন, কিন্তু তারাও কাঁদছে। গাড়ির মানুষগুলোর একজনের মোবাইল বেজে ওঠে, রিসিভ করে ফুঁপিয়ে কান্না করে বলে ওঠে, মতিন মারা গেসে বুবু, মতিন আর নাই...... বুঝে উঠতে পারেনা মেয়েটা... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।