আমি একজন ঢাবি ছাত্র। ভালবাসি গল্প লিখতে। মেহগনি গাছের পাতাগুলো একটিও স্থির নেই। সিডরের প্রচণ্ড বাতাসে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে ব্যস্ত তারা। প্রচণ্ড বাতাসে মনে হচ্ছিল গাছের মগডালে শক্ত করে বানানো কাকের বাসাটাও ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে।
কিন্তু কিভাবে যে সেটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাতাসের তীব্র বেগ সয়ে যাচ্ছিল তা শুধু উপর ওয়ালাই জানেন। হয়তবা তিনি চাইছিলেন তাঁর একটা সৃষ্টি যেন দুই দুইটা অন্ধ বাচ্চা নিয়ে অসহায় না হয়ে যায়।
কাকের বাচ্চাগুলো কিছুটা বড় হয়ে যাওয়ায়, ছোট্ট বাসাটিতে বাবা কাকটির জায়গা হচ্ছিল না। তাই সে সকল ঝড় উপেক্ষা করে তার বাচ্চাগুলোকে আরামে থাকতে দিবার জন্য বাসার বাইরে বসে ছিল। আর মা কাকটি মায়ের পরম মমতায় তার দুই ডানা মেলে ধরে বাচ্চাগুলোকে ঝড়ের ঝাপটা থেকে রক্ষা করছিল।
বাবা কাকটি কিছুক্ষণ পর পর বাতাসের তোপে গাছ থেকে ছিটকে পড়ছিল। অনেক কষ্টে আবার উড়ে এসে গাছের ডালে বসছিল। মাঝে মাঝে কা কা করে ডেকে উঠছিল যাতে অন্যান্য কাকের উত্তরে তাদের অবস্থান সে বুঝতে পারে। কিন্তু আজ কপাল মন্দ। সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে বিকেল হল, কিন্তু আজ কোন কাকই তাকে খাবারের সন্ধান দিতে পারলনা।
এই ঝড়ে সকলেরই একই অবস্থা। তাই স্বর কিছুটা নিচু করে করুণ গলায় বাবা কাকটি ডাকছিল। সে আজ তার দায়িত্ব পালন করতে পারছেনা। তাদের ছানা দুটি ক্ষুধার জ্বালায় কিছুক্ষণ পর পরই ডেকে উঠছিল। এ কষ্ট সহ্য না করতে পেরে বাবা কাক খাবারের সন্ধানে এই ঝড়ের মাঝেই উড়াল দিল।
কিছুক্ষণ পরে সে খালি মুখেই ফেরত এলো। বাচ্চাগুলো তাদের বাবাকে ফেরত আসতে দেখেই চেঁচামেচি শুরু করল, বাসা থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসতে চাইল। কিন্তু বাবা কাক কিছু আনেনি। বাচ্চাদের এমন আকুতি দেখে হয়ত তার মনকষ্ট আরও বেড়ে গেল। তাই সে বাসার উল্টো দিকে অবস্থান করল।
ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করেই বাবা কাক চারদিকে চেয়ে খাবার খুঁজতে লাগল। একসময় সে গাছের পাশে বাড়ির বারান্দায় কিছু খাবার দেখতে পেল। তারপরেই সে একটা ডাক দিল। পেছনে মা কাক সে ডাকের উত্তর দিল। হয়তবা বাবা কাকটি কোন কিছুর সংকেত দিয়েছে তাকে।
তারপরেই বাবা কাকটি বারান্দার দিকে উড়াল দিল। সামান্য রাস্তা হলেও তীব্র ঝড় হওয়ায় বারান্দায় যাওয়া কাকের পক্ষে সহজ ছিলনা। সে কোন মতে বাড়ির কার্নিশে এসে বসল। বারান্দায় কোন মানুষ না থাকলেও দরজার পাশে দুটি দুষ্টু ছেলে বসেছিল। কাক তাদের খেয়াল করতে পারেনি তাই বারান্দার গ্রিলে এসে বসল।
ছেলে দুটি ব্যপারটা বুঝতে পারল যে কাকটি খাবার চুরি করতে এসেছে। তাই তারা তাকে তাড়িয়ে না দিয়ে কাকটিকে নিয়ে খেলা করার উদ্দেশ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকল। বারান্দার গ্রিল গলে ভেতরে ঢুকাটা কাকের পক্ষে খুব বেশী সহজ ছিলনা। অনেক কষ্টে সে ভেতরে ঢুকে খাবারের কাছে পৌঁছল। সাথে সাথেই সেই ছেলে দুটি কাকটিকে তাড়া করল।
বাবা কাক ভ্যবচ্যেকা খেয়ে গেল। কিন্তু উড়ে যাবার সময় মুখ-ভর্তি খাবার নিতে একটুকুও ভুল করলনা। যে ভাবেই হোক তার ক্ষুধার্ত ছানা দুটির মুখে খাবার তুলে দিতে হবে। বারান্দার গ্রিলের ফাকা খুব ছোট হওয়ায় সেখান থকে তার বেড় হওয়াটা খুব কঠিন ছিল। তাই সে বারান্দার মধ্যেই ডানা ঝাপটাতে লাগলো।
সে সুযোগে ছেলে-দুটি কাকটিকে ইচ্ছেমত পেটাবার সুযোগ পেল। তাদের আঘাতে যখন সে কা কা রবে প্রচণ্ড চিৎকার করতে লাগলো তখন গাছের উপর থেকে মা কাকটিও তার সঙ্গীর বিপদ বুঝতে পেরে কা কা করে অন্যান্য কাকদের সাহায্য চাইল। প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে প্রায় সন্ধ্যা হওয়াতে কেউ সাহায্যে এলনা। কাক দুটির এমন চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে ছেলে-দুটির বাবা তাদের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। বাবা কাক তাড়াহুড়ো করে গ্রিল গলে বাইরে বেড়িয়ে যেতে গিয়ে তার ডান পাশের ডানাটা ভেঙ্গে ফেলল।
ঝড়ের তোপ কম হওয়ায় সে তার নীড়ে যেতে পারল। কিন্তু এই ঝামেলার মধ্যে তার মুখে যে খাবার অবশিষ্ট ছিল তা দিয়ে একটি ছানাকে খাওয়ানো সম্ভব। ছানাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ছানাটি খাবারের প্রায় পুরো অংশই খেয়ে নিলো, তাই অপরটি রইল অভুক্ত। দুর্বল ছানাটি ক্ষিদের যাতনায় চিৎকার জুড়ে দিল। বাবা কাক তার কষ্ট সইতে না পেড়ে আবার সে বারান্দার উদ্দেশ্যে অবশিষ্ট খাবার গুলো আনতে ছুটলেন।
এবার আর সে ছেলে দুটি ছিলনা। তারপরেও আগের চাইতে তাকে অনেক বেশী কষ্ট করতে হল। কারণ এবার তার ভাঙ্গা ডানাটি নিজের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। অবুঝ প্রাণীর তার বাচ্চার প্রতি কি মমতা, মা এবং বাবা কাক উভয়েই এতটুকু খাবারও গ্রহণ করলনা। তারা তাদের ছোট্ট ছানাদুটির জন্য অভুক্ত থাকল।
এরই মধ্যে সন্ধ্যা নেমে গেছে। কাকেরা এই সময় আর বাইরে বের হয়না। তাই তাদের সারা রাত অভুক্ত থাকার নিয়তিকেই মেনে নিতে হল। এদিকে ঝড়ের প্রকোপ আরও বেড়ে গেছে। বাবা কাকের ভেঙ্গে যাওয়া ডানাটা ব্যথায় টন টন করছে।
সারাদিন ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে না খাওয়া দুর্বল শরীর নিয়ে সে আর পারছিলনা। কিন্তু তার ছানা-দুটোকে কষ্ট দিতে সে কোনভাবেই পারেনা। তাই নীড়ে বিশ্রাম না করে বাচ্চাদের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিলো। এই প্রচণ্ড বাতাসের প্রকোপ সহ্য করতে থাকল। রাত বাড়তেই ঝড়ের বেগ আরও বাড়ল।
এক সময় বাবা কাক বাতাসের বেগ সামলাতে না পেরে গাছের ডাল থেকে পা ফসকে গেল। ডান পাশের ডানা ভাঙ্গা থাকায় সে নিজেকে নিয়ে আর উড়তে পাড়লনা। বাতাস তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে একটি দেওয়ালের সাথে প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা দিল। বাবা কাকটি সামান্য ধর-ফরিয়েই মারা গেল। সে নিজের জীবনকে তাঁর পরিবারের জন্য বিলিয়ে দিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।