আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

থের্মোপিলাইয়ের এবং ম্যারাথনের যুদ্ধ

আমি আঁধারে তামাসায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূন্যতা থেকে শূন্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে। থের্মোপিলাইয়ের যুদ্ধ ছিল ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উত্তর গ্রীসের থের্মোপিলাই নামক এক সঙ্কীর্ণ উপকূলীয় পথে গ্রিক ও পারসিকদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ। পারস্যের রাজা প্রথম খাশয়র্শ ৪৮০-৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিস দখলের যে অভিযান চালান, এটি তারই অন্তর্গত প্রথম বড় যুদ্ধ। যদিও থের্মোপিলাইয়ের যুদ্ধে পারসিকরা জয়লাভ করে, এটি মূলত গ্রিকদের, বিশেষত স্পার্তার সৈন্য ও তাদের রাজা ১ম লেওনিদাসের, বীরত্বের জন্য বেশি পরিচিত। ম্যারাথনের যুদ্ধের মতো থের্মোপিলাইয়ের যুদ্ধের বিবরণের জন্যও প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোদোতুসের রচনাই একমাত্র উৎস।

খাশয়র্শ ১০ বছর আগে ম্যারাথনের যুদ্ধে পারসিকদের পরাজয়ের প্রতিশোধ চাচ্ছিলেন এবং একই সাথে গ্রিস দখল করে পারস্য সাম্রাজ্য বিস্তারও ছিল তাঁর লক্ষ্য। এমনকি থের্মোপিলাইয়ের যুদ্ধের আগেই তিনি শক্তি প্রদর্শন করে কিংবা কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় গ্রিসের এক বিরাট অংশ দখল করে ফেলেছিলেন। গ্রিসের বাকী জনতা স্পার্তা শহরের নেতৃত্বে থেসালীয় সীমান্ত পরিত্যাগ করে এবং এর পরিবর্তে থের্মোপিলাইয়ের পথে অবরোধ সৃষ্টি করে। পথটির একপাশে ছিল সুউচ্চ পর্বত আর আরেক পাশে সমুদ্র, এবং এটি ছিল উত্তর ও দক্ষিণ গ্রিসের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী কৌশলগত একটি পথ। পারস্যের নৌবহরের আক্রমণ প্রতিহত করতে গ্রিকদের নৌবহর স্কিয়াথোস ও মূল ভূখণ্ডের মধ্যবর্তী সাগরে টহল দেওয়া শুরু করে।

হেরোদোতুসের দেওয়া পারসিক সৈন্যের সংখ্যা অবিশ্বাস্য। তাঁর মতে পারসিক বাহিনীতে ২৬ লক্ষ সৈন্য ছিল। অন্যদিকে গ্রিকরা ছিল ৬ থেকে ৭ হাজার। গ্রিক ও পারসিকদের মধ্যে তিন দিন যুদ্ধ চলে। কিন্তু পথটি অত্যন্ত সংকীর্ণ হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ করার মত অবস্থা কোন পক্ষেরই ছিল না।

২য় দিনে গ্রিকদের এক বিশ্বাসঘাতক এফিয়ালতেস খাশ'ইয়রশ'-কে একটি পার্বত্য পথের কথা বলে দেয়, যাতে পারসিকেরা দুই দিক থেকে গ্রিকদের আক্রমণ করতে পারে। ১০ হাজার দক্ষ পারসিক সেনার এক দল রাতের বেলা ঐ পথে রওনা দেয়। যখন গ্রিকদের মূল সেনাদল এর খবর পায়, তখন বেশির ভাগ গ্রিক পলায়ন করে। কিন্তু লেওনিদাসের অধীনে ৩০০ স্পার্তীয়, ৭০০ থেস্পীয় এবং ৪০০ থেবীয় সেনা রয়ে যায়। এরা সবাই পারসিকদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে যুদ্ধ করতে থাকে।

লেওনিদাস নিহত হন। বাকী গ্রিকরা একটি ছোট পাহাড়ের উপরে পালিয়ে যায়, যেখানে তাদেরকে পারসিকেরা জড়ো করে ও সবাইকে হত্যা করে। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও লেওনিদাস কেন পালিয়ে যাননি তার কারণ এখনও অজানা। সম্ভবত রণকৌশলগত কারণে তিনি এটি করেছিলেন, যাতে পারসিকের যুদ্ধে ব্যস্ত থাকে এবং অন্যান্য গ্রিকেরা সহজে পালিয়ে যেতে পারে। তবে স্পার্তার সেনাদের আত্মসম্মানবোধ ও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাবার গৌরবের অভিলাষও এর কারণ হতে পারে।

পারসিকেরা এই যুদ্ধে জয়লাভ করে আথেন্স শহর দখল করে ও ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু ঐ বছরই সালামিসের যুদ্ধে গ্রিক নৌবহর পারসিকদের পরাজিত করে এবং গ্রীসে খাশ'ইয়র্‌শ'-এর সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষের সমাপ্তি ঘটে। ম্যারাথনের যুদ্ধ ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্র অ্যাথেন্সের মূল শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ম্যারাথন নামের এক ময়দানে গ্রিক ও পারসিকদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ। অ্যাথেনীয় এবং তাদের মিত্র প্লাতায়ীয়রা এবং পারস্যের রাজা ১ম দরিয়ুশের সৈন্যদের মধ্যে এই যুদ্ধ ঘটে এবং যুদ্ধে গ্রিকদের জয় হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে গ্রিসের উপর পারস্যের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়।

পারসিকেরা কেন গ্রীসে অভিযান চালিয়েছিল এবং কোন পরিস্থিতিতে ম্যারাথনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সে সম্পর্কিত আধুনিক জ্ঞান পুরোপুরি গ্রিক জনশ্রুতির উপর নির্ভরশীল, যেগুলি যুদ্ধের ৫০-৬০ বছর পরে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোদোতুস লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। হেরোদোতুসের ভাষ্য অনুযায়ী, এশিয়া মাইনর অঞ্চলে ৪৯৯-৪৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন আয়োনীয় গ্রিক শহরগুলি বিদ্রোহ করেছিল, এবং সেই বিদ্রোহে সহায়তা করার প্রতিশোধ হিসেবে পারস্যের সম্রাট দরিয়ুশ গ্রিক শহর অ্যাথেন্স ও এরেত্রিয়ার বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। হেরোদোতুসের মতে পারস্যের লক্ষ্য ছিল সমগ্র গ্রিস দখল করার। আক্রমণের আগে দরিয়ুশ সমস্ত গ্রিক শহরগুলিকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। অ্যাথেন্সের নির্বাসিত স্বৈরশাসক হিপ্পিয়াস এ সময় দরিয়ুশের অভিযান বাহিনীতে ছিলেন, এবং তিনি হয়ত দরিয়ুশকে প্রভাবিত করে থাকবেন।

৪৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দরিয়ুশের ভাতিজা ও জামাই মার্দোনিউসের অধীনে একটি নৌবাহিনী উত্তর গ্রিসের থ্রাকে ও ম্যাসেডোনিয়া অঞ্চলে ঘুরে আসে। তারা ম্যাসেডোনিয়াকে পারস্যের পদানত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আথোস পর্বতের কাছে ঝড়ে পড়ে মার্দোনিউসের নৌবহর ধ্বংস হয়ে যায়। ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারসিক সমরনেতা দাতিস ও আর্তাফের্নেস এজীয় সাগর পাড়ি দেন এবং যাবার পথে সাইক্লাডিক দ্বীপপুঞ্জ দখল করেন। তারা এউবোইয়া দ্বীপে অবতরণ করেন এবং শক্তি দিয়ে ও বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় সেখানকার কারিস্তুস ও এরেত্রিয়া শহরগুলিকে পদানত করেন।

এ সময় আথেনীয়রা সাহায্য প্রার্থনা দিয়ে দৌড়বিদ ফেইদিপ্পিদেসকে স্পার্তা শহরে পাঠায়। এউবোইয়া থেকে পারসিকরা সহজেই অপ্রশস্ত সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে ম্যারাথনের সমভূমিতে পৌঁছে। ম্যারাথনে যাবার অনেকগুলি কারণ ছিল। ম্যারাথন ছিল এউবোইয়া থেকে সমুদ্র পাড়ি দেবার সবচেয়ে সহজ গন্তব্যস্থল। এছাড়া হিপ্পিয়াস হয়ত আত্তিকার পূর্ব প্রান্তের অঞ্চলগুলির কাছ থেকে রাজনৈতিক সহায়তার আশা করেছিলেন।

পারসিকেরা ম্যারাথনের সমভূমিগুলিকে তাদের ঘোড়সওয়ার সৈন্যদের জন্য আদর্শ বলে মনে করেছিল। পারসিকেরা ম্যারাথনে পৌঁছবার পরে কিছুদিন বিরতি দিয়ে ম্যারাথনের যুদ্ধ শুরু হয়। এর আগে অ্যাথেন্সের দশ সমরনেতার মধ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা নিয়ে এক বিতর্ক হয়। শেষ পর্যন্ত মিলিতিয়াদেসের যুক্তি যুদ্ধে যাবার পক্ষে তাদেরকে মত পরিবর্তন করে। মিলিতিয়াদেসের যুক্তি ছিল যুদ্ধ না করলে আথেন্সের ভেতরে বিভাজন ও বিশ্বাসঘাতকতা বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে যুদ্ধে জয়ী হলে গ্রিসের উপর আথেন্সের আধিপত্য নিশ্চিত হবে।

প্রকৃত যুদ্ধের ঘটনাবলী সম্পর্কে নিশ্চিত জানা যায় না। পারসিকদের ছিল অশ্বারোহী সেনাদল, এবং গ্রিকদের এরকম কোন সেনাদল দেখতে না পেয়ে তারা বিস্মিত হয়েছিল। যুদ্ধে প্রায় ১০ হাজার গ্রিক অংশ নেয়। পারসিক সৈন্যের সংখ্যার ব্যাপারে মতদ্বৈত আছে। সমসাময়িক কবি সিমোনিদেসের দেয়া সংখ্যা ৯০ হাজার বিশ্বাসযোগ্য নয়।

একটি আধুনিক হিসাব অনুযায়ী ২৫ হাজার পারসিক সৈন্য যুদ্ধ করেছিল। যা-ই হোক, পারসিকেরা ছিল গ্রিকদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি। কিন্তু তীব্র এই যুদ্ধশেষে পারসিকেরা বড় পরাজয় লাভ করে। ম্যারাথনের যুদ্ধের পর পারসিকেরা জাহাজে করে সৌনিওন অন্তরীপ ঘুরে আথেন্স শহর সরাসরি আক্রমণ করতে যায়। কিন্তু আথেনীয় সেনাবাহিনী সময়মত শহরে ফিরে আসে এবং পারসিকদের এই দ্বিতীয় আক্রমণও প্রতিহত করে।

পারস্যের জাহাজগুলি শেষ পর্যন্ত অভিযানে ব্যর্থ হয়ে ফেরত চলে যায়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.