হরতাল অবরোধে গাড়ি ভাংচুর করা একটি কালচারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এসব কর্মসূচীতে গাড়ি ভাংচুর করা না হলে কর্মসূচী সফল হয় না। কিন্তু যারা গাড়ি ভাংচুরের মাধ্যমে কর্মসূচী সফল করতে চায় তারা একবার ভেবে দেখে এসব গাড়ি ভাঙচুরের ফলে দেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির দিকটি। তবে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এভাবে গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ফলে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া পরিবহন শিল্পে ক্ষতি, ব্যবসায়ের ক্ষতিসহ সার্বিক অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
দেখা দিচ্ছে পরিবহন সঙ্কট। তাছাড়া যাত্রী দুর্ভোগ ও জীবনের আশঙ্কা তো রয়েছেই।
এ বিষয়ে মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, হরতাল অবরোধে যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। তিনি বলেন, শুধু হরতালেই দেশে গাড়িপ্রতি গড়ে ৫ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আর জ্বালাও পোড়াও ভাংচুর করলে এ ক্ষতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, রবিবার অবরোধের দিনে সারাদেশে যে পরিমাণ গাড়ি জ্বালা পোড়াও করা হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ কোটি কোটি টাকায় শেষ হবে না।
বিপ্লবী সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রাজা জনকণ্ঠকে বলেন, এ শিল্পে যারা কাজ করে তারা শাঁখের করাত। যেতে কাটে, আসতে কাটে। এভাবে জ্বালাও পোড়া করায় প্রতিবছর এ শিল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। সরকার এবং বিরোধী দল তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য আমরা ব্যবহার হচ্ছি।
এর ফলে পরিবহন শ্রমিকদের জীবন হুমকির মুখে পড়ছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার আবার এ কর্মসূচী না মানারও অধিকার জনগণের রয়েছে। কিন্তু জ্বালা পোড়াও করে, গণপরিবহন খাতকে ক্ষতি করে রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করার অধিকার কোন রাজনৈতিক দলের নেই। এ অবস্থার অবসানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারায় ফিরে আসার কোন বিকল্প নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
জ্বালাও পোড়াও করে রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনের ফলে শুধু যে দেশের আর্থিক ক্ষতি হয় কেবল তাই নয়।
ভোগান্তির শিকার হয় লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। পরিবহন না পেয়ে অনেক কষ্ট শিকার করে অফিস-আদালতে যেতে হয়। তাছাড়া এসব কর্মসূচীর ফলে জনমনে সবসময় এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ঢাকা শহরের যে পরিমাণ লোকসংখ্যা বাস করে তার চেয়ে পরিবহনের সংখ্যা অনেক কম। এ সংকটের কারণে সরকারী ছুটি বাদে অন্য যে কোন দিনে এমনিতেই তাদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
বাসে ঝুলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অফিস আদালতে যেতে হয়। কিন্তু জ্বালাও পোড়াও করার কারণে পরিবহনের সংখ্যা অনেক কমে যায়। পরে জনগণের কষ্ট আরও বেড়ে যায়। আবার এভাবে জ্বালাও পোড়াও করা কারণে এ শিল্পে বিনিয়োগ করতে অনেকে নিরুৎসাহিত হয়।
গত রবিবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের রাজনৈতিক কর্মসূচী সারাদেশে কয়েক শ’ গাড়ি অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করা হয়েছে।
বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচীর মধ্যে যে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে তা আগের যে কোন কর্মসূচীর চেয়ে অনেক গুণ বেশি বলে জানা গেছে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীর কথা বলে অবরোধে ডাক দেয়া হলেও রবিবার ভোর থেকে বিভিন্ন জায়গায় তা সহিংসতায় রূপ নেয়। মেতে ওঠে গাড়ি পোড়ানোর মহাউৎসবে। এ ক্ষেত্রে জামায়াত-শিবিরের কর্মকা- আরও একধাপ এগিয়ে ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে দিন দিন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
পুলিশসহ মন্ত্রীদের গাড়িতেও তারা অগ্নিসংযোগ করছে। রবিবারে অবরোধ কর্মসূচীকে তারা মোক্ষমভাবে কাজে লাগিয়েছে। আগামীতে ১৮ দলের ব্যানারে শিবিরের এ কর্মকা- আরও ভয়ানক রূপ নিতে পারে বলে জানা গেছে।
গত রবিবার বিএনপি নেতৃত্বধীন ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচীতে বেপরোয়াভাবে গাড়ি ভাংচুর করা হয়। অথচ আট ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচী শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন ১৮ দল।
কিন্তু শেষপর্যন্ত তা পরিণত হয় গাড়ি ভাঙ্গার মহাউৎসবে। অবরোধ পালনকারীরা মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, সাভার, গাজীপুর, কাঁচপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাসে, ট্রাকে অটোরিকশায় আগুন ও ভাংচুর চালিয়েছে। ফলে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এক কথায় সহিংস কর্মকা-ের মাধ্যমে শেষ হয়েছে অবেরোধ কর্মসূচী। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে শানিত পূর্ণ অবরোধ কর্মসূচীর ঘোষণা দিলেও রবিবার ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই অবরোধকারীদের সহিংস ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে।
অবরোধের আগের দিনও সহিংস আচরণের মাধ্যমে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করেছে।
অবরোধ-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন অবরোধ চলাকালে এসব সহিংস ঘটনার সঙ্গে বিএনপির কোন নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব সহিংস ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপানো হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় অবরোধকারীরা সকাল থেকেই রাজপথ দখল করে গাড়ি ভাংচুরের ঘটনার সূত্রপাত করে। সারাদেশে কয়েক শ’ গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পাওয়া গেছে।
তবে এ গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের সবচেয়ে বেশি সক্রিয় দেখা গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে দাবিতে অবরোধ কর্মসূচীর ডাক দিলেও জামায়াত এটিকে নিজস্ব এজেন্ডার রাজনৈতিক কর্মসূচীতে পরিণত করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের সুযোগ খুঁজছে এসব কর্মসূচীর মাধ্যমে। ফলে তারা রবিবারের অবরোধ কর্মসূচীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল বানচালের সেøাগান দিতে থাকে।
হরতাল অবরোধের নামে এসব গাড়ি ভাংচুর করা হলে এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতিগুলো কখনই বিবেচনায় নেয়নি তারা।
ফলে এসব কর্মসূচীতে নির্বিচারে গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। আর এসব ঘটনার বেশি শিকার হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। যারা বিভিন্নভাবে ধার দেনা ও ঋণের মাধ্যমে গাড়ি কিনেছিলেন। কিন্তু একবার অগ্নিকা- ও ভাংচুরে শিকার হলেও ক্ষতিপূরণ পুষিয়ে নেয়ার ক্ষমতা তাদের কোনদিনই হয় না। ফলে এভাবে একটি পরিবারের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে।
কথায় কথায় গাড়ি ভাংচুর একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে দেশের রাজনৈতিক কালচারের। রবিবারের অবরোধ কর্মসূচীর মধ্যেও দেখা গেছে অনেকে হাতজোড় করে গাড়িগুলোকে রক্ষায় জন্য অবরোধকারীদের কাছে আকুতি জানাচ্ছে। এরপরও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। ফলে নিমিষেই লাখ লাখ টাকার যে ক্ষতি হয়ে গেল তা পুষিয়ে নেয়ার কোন উপায় কোনদিন হবে না। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন প্রতিকার না থাকায় আইনের দ্বারস্থ হতে পারছে না।
ক্ষতিরোধে এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা তাদের জানা নেই। আইনে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার থাকলেও দুর্বল ধারায় মামলা হওয়ার কারণে বেশিরভাগ সময় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে হরতাল অবরোধের মধ্যে গণহারে গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ অভিযোগে গণহারের একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হলে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। ফলে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা কঠিন হয়ে পড়ে।
আবার রাজনৈতিক ঘটনায় মামলা করা হলে অপরাধীরা সব সময় পার পেয়ে যায়। ফলে গাড়ি ভাংচুরের এ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু গাড়ি ভাংচুর নয়, রবিবারের অবরোধ কর্মসূচীর নামে ঝরে গেছে একাধিক প্রাণ। রুটি-রুজির কারণে বাইরে কাজ করতে এসে নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হতে হয়েছে। অথচ এদের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ।
রাজনীতির করুণ পরিণতির শিকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে রাজনীতি মানুষের জীবিকা নির্বাহকে বাধাগ্রস্ত করে, ভাংচুর জ্বালা পোড়ায়ের নামে দেশের সম্পদ নষ্ট করে, যার কারণে সাধারণ জনগণের প্রাণ দিতে হয় তা কারোই কাম্য নয়। দেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের এ ধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তথ্যসূত্র: জনকণ্ঠ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।