আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তোমাকে খুব মিস করি, বাবা, খুউব মিস করি ।। রেজা ঘটক

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা... বাবা, তুমি কী জানো, এখনো মহাকাশে সন্ধ্যাতারার মেলায়, আমি তোমাকে দেখতে পাই। আদমসুরাতে তোমার পাকা চুল কেমন চিকচিক করে। হঠাৎ কোত্থেকে ভেসে আসে তোমার উচ্চহাসীর ঢেউ। অথচ চারপাশে নেই তখনো কেউ। গোটা বলেশ্বর পাড়ের মানুষ জানে তুমি তাদের কতোটা আপন।

কথায় কথায় তারা তোমার নাম উচ্চারণ করে। আর মায়ের মৃত্যুর পর, হাতে গড়া তোমার পরিবারে চলে ভাগ-বাটোয়ারার আদিম মিছিল। বিশ্বাস করো বাবা, আমি ওই মিছিলে কখনো যাই না। এক কাপ চা আর এক পিস পাউরুটি দিয়ে আমার তখন দিব্যি চলে যায়। ঠিক বারো বছর ৩৭ দিন পর তোমার কাছে গেল মা।

এখন তো তবু তোমার পাশে মাকে পাচ্ছো। তোমার সবচেয়ে আদরের ধন অকাল কলেরায় নিথর হয়ে যাওয়া ছোট ছেলে দুই বছরের রাজুকে পাচ্ছো। তোমার প্রথম যৌবনে পাওয়া আকাশের মানিক অকাল ডায়রিয়ায় ম্লান হয়ে যাওয়া সবচেয়ে বড় ছেলে এক বছরের ইস্কান্দরকে পাচ্ছো। তোমার মুখে হাসি ফোটানো হারানো রতন অকালে পানিতে ডুবে বোবা হয়ে যাওয়া মেজে ছেলে আড়াই বছরের ইউসুফকে পাচ্ছো। তোমার যাবারও পঞ্চাশ বছর আগে, প্রসব বেদনায় অ-ভূমিষ্ট শিশুসহ নিশ্চল হয়ে যাওয়া তোমার সোনামুখী হারানো মাকে পাচ্ছো।

তোমার বদমেজাজী বাবাকে পাচ্ছো। তোমার চেয়ে দুই বছরের ছোট, তোমার ছোটবেলার খেলার সাথি তোমার আদেরর ছোট বোন মরিয়মকে পাচ্ছো। তোমার চেয়ে সাড়ে চার বছরের ছোট, তোমার কোলে পিঠে বড় হওয়া তোমার অতি আদরের ছোট বোন বেলাকে পাচ্ছো। তোমার কাছে সবচেয়ে বুদ্ধিমতী আদর্শ আর প্রাজ্ঞের উদাহরণখ্যাত তোমার আদেরর ছোট বোন তোমার পরামর্শদাত্রী আছিয়াকে পাচ্ছো। তোমার সৎ মায়ের মেয়ে, যাকে তুমি আছিয়ার মতো বড় করলে, তোমার অতি প্রিয় আদরের বোন মোমেনাকে পাচ্ছো।

গ্যাস্ট্রিক-আলচারে তোমার চেয়ে দশ বছর আগে নিরুদ্দেশ হওয়া তোমার সৎ মায়ের একমাত্র ছেলে তোমার আদরের লাঠিয়াল আমার সেজো কাকাকে কাছে পাচ্ছো। দিনে দিনে তোমার চারপাশে আবার সবাই ভিড় করছে, বাবা। এরা সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসতো, বাবা। তোমার প্রিয় বন্ধু মহেন্দ্রকে নিয়ে তুমি এখন যখন খুশি তখন যেখানে সেখানে রাত বিরাত ঘুরতে যেতে পারো। তোমার বন্ধু আর চির প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুস সাত্তার কাকার সঙ্গে এখন যখন খুশি তখন তুমি নাওয়া খাওয়া ভুলে তর্ক বিতর্ক জুড়ে পারো।

তোমার বন্ধু নূর মোহাম্মদ কাকাকে তুমি এখন যখন খুশি তখন সাত্তার কাকার বিপক্ষে ইলেকশানে দাড় করিয়ে জিতিয়ে দিতে পারো। তোমার বন্ধু ডাক্তার আলাউদ্দিন নানাকে নিয়ে তুমি এখন যখন খুশি তখন ইনজেকশান নেবার নাম করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে পারো। তোমার বন্ধু আবদুর রাজ্জাক নানার সঙ্গে তুমি এখন যখন খুশি তখন গ্রাম্য শালিসীতে বিপক্ষ দলে আইনি লড়াই করতে পারো। তোমার বন্ধু যোগেশ হালদার কাকার সঙ্গে তুমি এখন যখন খুশি তখন দীঘিরজানের হাট থেকে ফেরার সময় অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতে পারো। তোমার বন্ধু আলাউদ্দিন মাস্টারের সঙ্গে এখন তুমি যখন খুশি তখন বরইবুনিয়ার স্কুল মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখতে পারো।

তোমার বন্ধু দীন মোহাম্মদ মাস্টারের সঙ্গে এখন তুমি যখন খুশি তখন গিয়ে তোমার দুই ছেলের পড়াশুনার অগ্রগতির খোঁজখবর নিতে পারো। তোমার বন্ধু শাহজাহান মামার সঙ্গে তুমি এখন যখন খুশি তখন নতুন ধানের ফলন নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শলাপরামর্শ করতে পারো। এরা সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসতো, বাবা। ১৯৯৬ সালের ৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় তুমি অজানা রহস্যময় জগতে চলে গেলে। তোমার জন্যে ইনজেকশান আনতে আমি নাজিরপুর গেলাম।

ঢাকায় তোমার ডাক্তার নিউরো সার্জন প্রফেসর আহসানউল্লাহকে ফোন করলাম। ডাক্তার বললেন, তোমার পাশে যেনো অক্সিজেন রাখি। আর নতুন আরেকটা ইনজেকশান ফরমায়েশ করলেন। ওটা নাজিরপুর পাওয়া গেল না। ফার্মেসি থেকে আমাকে বললো, পিরোজপুরেও পাওয়া যাবে না।

খুলনায় পাওয়া যাবে। আমার হাতে থাকা ইনজেকশানটা তোমাকে দিয়ে আমি আবার খুলনা যাবো এমনটা ভাবতে ভাবেত বাড়িতে ফিরছিলুম। দীঘিরজান বাজার ক্রোশ করে হেডস্যারের বাড়ি ফেলে সামেনর ফাঁকা জায়গায়টায় হেডস্যারের ছেলে বাপীদা'র সঙ্গে দেখা। বাপীদা খালে ঝাকি জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন। আমাকে আসতে দেখে তোমার কথা জানতে চাইলেন।

বললেন, বাবায় তোমাদের বাড়িতে গেছে, কাকুরে দেখতে। আমিও আসতেছি। তুমি যাও। ইনজেকশানটা দাও। কয়েক মিনিট পর সামনে পরলো আক্কাস ভাইজান।

তোমার সেজো মেয়ের জামাই। রুনুর হাজব্যান্ড। জিজ্ঞেস করলাম, ভাইজান কই যান? আক্কাস ভাইজান বললো, বাজারে যাইতেছি ভাইডি। তুমি যাও। ওষুদগুলো পাইছো? কইলাম, একটা ইনজেকশান পাওয়া যায়নি।

খুলনা যেতে হবে। আমি বাড়ির দিকে আগাচ্ছি। আক্কাস ভাইজান উল্টো পথে দীঘিরজান বাজারের দিকে যাচ্ছে তোমার কাফনের কাপড় কিনতে। আর আমার কানে ভেসে আসছে মাইকের একটি ঘোষণা- একটি শোক সংবাদ। একটি শোক সংবাদ।

কণ্ঠসরটি কাঁপাকাঁপা। কারণ, কাঁচা রাস্তায় রিক্সাভ্যানে ঘুরে ঘুরে ওই ঘোষণাটি দিচ্ছিল আমার বন্ধু স্বপন। উত্তর বানিয়ারী নিবাসী, বিশিষ্ট সমাজসেবক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, গরীব-দুঃখী মানুষের প্রাণের বন্ধু, অত্র এলাকার অসাম্প্রদায়িক সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম প্রণেতা জনাব জয়নাল আবেদীন হাওলাদার আজ সকাল সাড়ে দশটায় নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। মরহুমের নামাজের জানাজা বাদ আছর অনুষ্ঠিত হবে।

একটি শোক সংবাদ। একটি শোক সংবাদ... শোক সংবাদটি আমি বারবার শুনেছি, বাবা। কিন্তু ঠিক কার নাম উচ্চারণ করছে স্বপন, আমি বুঝতে পারছি না। অনেক বার চেষ্টা করেও স্বপনের মাইকে ঘোষিত হওয়া ওই শোক সংবাদ থেকে মরহুমের নাম আমি বুঝতে পারছিলাম না। স্বপন যখন নামটি উচ্চারণ করে আমার কান তখন রহস্যময় কোনো অজানা কারণে অসার হয়ে যায়।

ঘোষণার বাকী অংশের পুরোটাই ঠিক ঠিক শুনেত পাই। কেবল নামের অংশে আমি কেমন আশ্চার্যরকম বয়রা হয়ে যাই। ওই ঘোষণা শুনতে শুনতে পরান মৃধার বাড়ি ছেড়ে হালদার বাড়ি রেখে যখন মাঠের ফাঁকা অংশে আসি, তখন দেখি আমাদের বাড়ির দিকে পুরো গ্রামের নিরব মিছিল। সেই মিছিলে আমি গত দুই দিন আগে থেকে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। ঢাকা থেকে আসার পর থেকেই ওই নিরব মিছিল আমি দেখেছিলাম।

কিন্তু আজকের ওই নিরব মিছিলের যে আরো অনেক ভিন্ন মানে তা আমি বুঝতে পারিনি, বাবা। সবাই আমাদের বাড়িতে যাচ্ছে তোমাকে শেষবারের মতো এক নজর দেখার জন্যে। আমি আমাদের পূর্বপাশের বাগানভিটার মধ্যে থেকে ঘরের পেছন থেকে বাড়িতে ঢুকতেই মা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবাই আমাকে ধরে নিয়ে তোমার পাশে যায়। ততোক্ষণে ওরা তোমাকে সামনের বারান্দায় মাটিতে নতুন বিছানায় শুয়ে দিয়েছে।

ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন কাপড় সরিয়ে তোমার মুখ দেখালো আমাকে। ওটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম কোনো লাশের মুখ দেখার অভিজ্ঞতা। দীর্ঘ বারো বছর ৩৭ দিন পর ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি আমি আরকেটি লাশের মুখ দেখেছিলুম। সেটি ছিল আমার দ্বিতীয়বার কোনো লাশের মুখ দেখা। সেটি ছিল পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয়মুখ আমার মায়ের মুখ।

আজ পর্যন্ত আর কোনো দিন আমি কোনো লাশের মুখ দেখিনি। লাশের মুখ দেখার অস্ফূট কষ্ট পৃথিবীর কোনো ভাষায় অনুবাদ করা যায় না। কোনো ভাষায় সেই কষ্টের কথা প্রকাশ করা যায় না। সেই কষ্ট কেবল বুকের অন্তহীন গহীনে কোনো অন্ধকার প্রকষ্টে ঘাপটি মেরে থাকে। বোবা কান্নায় যা কেবল সময়ে অসময়ে নিরব দংশন করে।

অন্য কারো সঙ্গে সেই কষ্ট কখনো শেয়ার করা যায় না। যার সেই কষ্টের অভিজ্ঞতা নেই, তাদের সেই রহস্যপুরীর অবয়বহীন অদৃশ্য বোবা কষ্টের তীল নমুনাও বোঝানো সম্ভব নয়। বাবা, তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। তুমি ছিলে আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। আজ আমার পরম বন্ধু আমার বাবার ষোলতম মৃত্যুবার্ষিকী।

বাবা, আজ তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। তোমাকে খুব মিস করি, বাবা, খুউব মিস করি। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.