নো ওয়ান ক্যান মেক মি ফিল ইনফেরিওর উইদআউট মাই কনসেন্ট! (গতকালকে লিখতে বসেছিলাম এই বিষয়টা নিয়ে। ইচ্ছে ছিল ২০০ শব্দের মধ্যেই পোস্ট সমাপ্ত করে ফেলবো। কিন্তু বাস্তবে ঘটলো ভিন্ন জিনিস – লিখতে বসেই ‘মার-মার, কাট-কাট’ করে বের হয়ে আসতে লাগলো হাজার হাজার শব্দ রাশিমালা! তাই অনিচ্ছাকৃতভাবেই দুইটি পর্বে দিতে হলো পোস্টটা। গতকাল দিয়েছিলাম প্রথম পর্ব , আর আজকে অবশিষ্টাংশ। )
আমার দৃষ্টিতে ইডেন গার্ডেনসের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ পেয়েছে একজনই – সে আর কেউ নয়, বরং মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন।
ইডেন গার্ডেনসের কথা মনে আসলেই অটোমেটিক্যালি আজহারউদ্দিনের নাম চলে আসে – এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত এরা। তার ২২টি টেস্ট সেঞ্চুরীর ৫টিই ইডেনে (অবশ্য লক্ষনেরও ৫টি সেঞ্চুরী আছে ইডেনে)। অভিষেকের প্রথম তিন টেস্টেই সেঞ্চুরী করার যে রেকর্ডটা আজহারউদ্দিন করেছে (যেটা এখন পর্যন্ত কেউ ভাঙ্গতে পারে নি), তার শুরুটাও হয়েছিল কিন্তু ইডেন গার্ডেন থেকেই। সত্যি কথা বলতে, টেস্ট অভিষেক থেকেই ইডেনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে গড়ে উঠেছে আজহারউদ্দিনের ক্যারিয়ার - যার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরন হয়ে আছে ১৯৯৩ সালের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টটি।
প্রথমে একটু প্রেক্ষাপটটা বলতেই হয়।
১৯৯০ সালে আজহারউদ্দিনের অধিনায়কত্ব পাওয়াটা সে সময় ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে। আর আজহারউদ্দিনেরও কপাল খারাপ, তার প্রথম মিশনগুলোর ৯৫%ই ছিল বিদেশের মাটিতে। প্রথমে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ, পরে যথাক্রমে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও সাউথ আফ্রিকার মাটিতে। মাঝে অবশ্য দেশের মাটিতে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে একটি টেস্ট ও জিম্বাবুয়ের মাটিতে একটি টেস্ট। শ্রীলংকার সাথে টেস্টটি জিতলেও জিম্বাবুয়ের সাথে ভারত ড্র করে।
কিন্তু বাকী ৪টি অ্যাওয়ে সিরিজেই তারা পরাজিত হয়। তার মধ্যে অস্ট্রিলিয়ার কাছে ০-৪ ব্যবধানে পরাজয় এবং একইসাথে ১৯৯২ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সেমিফাইনালের আগেই বিদায়ের কারনে সারা ভারত জুড়ে শুধু একটাই রব ওঠে ‘আজহার হঠাও’! তার উপর বছরের শেষে দক্ষিন আফ্রিকায় সিরিজ খেলতে গিয়ে ১-০ ব্যবধানে সিরিজ হেরে আজহারউদ্দিন যখন দেশে ফিরে আসে, তাকে অধিনায়কত্ব থেকে তো বটেই, দল থেকেই বিতাড়িত করাটা সময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছিল।
আবার এর মধ্যেই মাসখানেক বাদে ইংল্যান্ডের সাথে ৩ ম্যাচের সিরিজ, অথচ আজহারের ক্যাপ্টেনসিতে ১৭ টেস্টে কেবলমাত্র ১টি জয়! তাই মিডিয়া তখন বেশ সোচ্চার - আজহারকে সরাতেই হবে, কপিল দেবকে পুনরায় অধিনায়ক করতে হবে। তথাপি নির্বাচকরা আজহারকে একটা শেষ সুযোগ দিতে চাইলো মূলত দুইটি কারনে। প্রথমত, বিদেশের মাটিতে ভারতের পারফরমেন্স সবসময়ই খারাপ হয়, তাই এটা দিয়ে বিচার করলে সেটা একতরফা হয়ে যায়, ফেয়ার চান্স হয় না।
দ্বিতীয়ত, দেশের মাটিতে আজহারের অধীনে একমাত্র টেস্টটি ভারত জিতেছে। তাই দেশের মাটিতে তাকে শেষ একটা সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। অবশ্য আজহারকে কিন্তু পুরো সিরিজের জন্য নয়, শুধুমাত্র প্রথম টেস্টের জন্যেই অধিনায়ক মনোনীত করে নির্বাচকরা প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দেয় - বাছা, এটাই কিন্তু তোমার সর্বশেষ সুযোগ!
আমি আজহারউদ্দিনের ভাগ্যটা ভাল বলবো এ কারনে যে, এর আগে ভারতের ইতিহাসে কোন টেস্ট সিরিজ কখনোই ইডেন টেস্টের মধ্য দিয়ে শুরু হয়নি। কাকতালীয় হলেও সত্য যে, সেবারই সর্বপ্রথম ইডেন গার্ডেনসে টেস্ট অনুষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এই ঐতিহাসিক সিরিজটি (পরবর্তীতে আরেকবার শুধু এরকম ঘটেছে, এবং সেটা পরের বছরেই)। তবে যেটাই হোক, ইডেনের মহানায়ক তার প্রিয় গ্রাউন্ডে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রাপ্ত এই শেষ সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে পারবে কিনা সেটাই হয়ে পড়ে লাখ টাকার প্রশ্ন।
টসে জিতে আজহারউদ্দিন ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখনো এত প্ল্যাকার্ডের ছড়াছড়ি ছিল না, তবে যেসব দর্শকই নিয়ে এসেছেন, সবার হাতেই ছিল প্রায় একই ভাষার প্ল্যাকার্ড - ‘আজহারের অপসারন চাই’। অনেকেই লিখেছে - ‘ব্রিং ব্যাক কপিল এজ ক্যাপ্টেন’। কেউ কেউ আরো একধাপ এগিয়ে বলেছে, ‘শুধু অধিনায়কত্ব নয়, আজহারকে দল থেকেই বহিষ্কার করতে হবে’। এছাড়া বছর দেড়েক ধরে তো মিডিয়ার তীর্যক সমালোচনা আছেই, যেটা গত মাসজুড়ে আরো সুতীব্র আকার ধারণ করেছে।
আমি আমার সারাজীবনে কোন ক্রিকেটারকে এধরনের বিরুপ পরিস্থিতিতে পড়তে আর কখনোই দেখি নাই। এহেন প্রতিকূল পরিবেশে আজহার যখন ব্যাট হাতে মাঠে নামছে তখন ভারতের স্কোর ৯৩/৩। বাকী ইতিহাস?.........শুধুই ইডেনের আশীর্বাদ!
টেন্ডুলকার ক্রিজে ছিল তখন; খুব ধীরে সুস্থে দলকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করার প্রচেষ্টায় রত। উল্টোদিকে আজহার শুরুতে খানিকটা সতর্ক থাকলেও পরে হয়ে উঠে প্রচন্ড মারমুখী - মানসিক অবস্থা এমন যেন ‘ব্রিটিশকে মেরে ইন্ডিয়ানদের শিখানো’-র প্রচেষ্টা! সব সমালোচনা ও কটুক্তির ঝাল যেন মেটাতে লাগলো ব্রিটিশ বোলারদের উপর। ফলে সে যখন তার হাফসেঞ্চুরী (৭৯ বলে) পূর্ন করে তখন টেন্ডুলকারের সাথে পার্টনারশীপে রান হয়েছে মাত্র ৭৫।
লক্ষ্যনীয়, হাফসেঞ্চুরী করার পরেও আজহার কিন্তু দর্শকদের উদ্দেশ্যে ব্যাট উঁচু করে দেখায় নাই, শুধু আকাশের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সর্বশক্তিমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মাত্র। সত্যি বলতে, পুরো ইনিংসেই আজহারের চেহারার অভিব্যক্তিগুলো কখনোই ভোলার নয়; কতটা মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে ছিল সে এই কয়দিন, তা পরিষ্কার ফুটে উঠেছে তার অভিব্যক্তিতে।
যাই হোক, চমক তখনো শেষ হয়ে যায় নি। হাফসেঞ্চুরী করার পরেই সে মারাত্মক চড়াও হয়ে উঠে বোলারদের উপর - যার প্রমান সেঞ্চুরীতে পৌঁছতে তার প্রয়োজন হয় মোটে ৩৫টি বল! হুমম, সেঞ্চুরীটা করার পরেই এই প্রথম দর্শকদের তুমুল উল্লাসধবনি ও অভিবাদনের জবাবে সে ব্যাট উঁচিয়ে সেলিব্রেট করে। এবার কিন্তু চেহারায় ফুটে উঠে পরম স্বস্তির চিহ্ন – অ্যা বিগ রিলিফ!
যাই হোক, আজহারউদ্দিনের এই এপিক ইনিংসটার অবসান ঘটে ১৮২ রানে।
আর আলটিমেটলি এই টেস্টে ইংল্যান্ড পরাজিত হয় এবং ম্যান অফ দ্য ম্যাচও হয় সে নিজেই। তার এই পারফরমেন্সের দরুন পরের দুই টেস্টের জন্যও তাকে অধিনায়ক মনোনীত করা হয়, এবং ইতিহাস হচ্ছে - বাকী দুই টেস্টেও ইংল্যান্ড পরাজিত হয়ে হোয়াইট ওয়াশড হয়ে বাড়ী ফেরে। বলার অপেক্ষা রাখে না আজহারউদ্দিন হয়ে উঠে জাতীয় হিরো, এবং তার অধিনায়কত্ব কয়েক বছরের জন্য হয়ে পড়ে নিষ্কন্টক।
এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসিঃ
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, তাদের চরম বিপদের সময় ভারতীয় ক্রিকেটের এই সাবেক দুই স্তম্ভকে ইডেন গার্ডেনস রক্ষা করেছে তার আশীর্বাদের মাধ্যমে। এবার পালা এসেছে টেন্ডুলকারের - যে কিনা তার ক্যারিয়ারের সবচাইতে বিরুপ সময় অতিবাহিত করছে।
তার অবসর না নেওয়া নিয়ে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে অধিকাংশ ভারতীয়দের মনেই।
আসলে আমিও চাই শচীন অবসর গ্রহন করুক, কিন্তু এভাবে অফ-ফর্মের মধ্য দিয়ে নয়। আমি চাই অবসর গ্রহনের পূর্বে যেন তার ব্যাট আরেকবার জ্বলে উঠে পুরনো দিনের মত। পন্টিং-এর ক্ষেত্রেও খুব চেয়েছিলাম দূর্দান্ত একটা ইনিংস কিন্তু দূর্ভাগ্য, বিদায়পর্বে মনে রাখার মতো কিছুই সে দিতে পারে নাই। তাই অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অবসর গ্রহনের পূর্বে একটা ভাল ইনিংস খেলাটা খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে টেন্ডুলকারের জন্য।
সেটা কি তবে এই ইডেনেই হতে পারে যাকে একসময় সে আখ্যায়িত করেছিল ‘হোম অফ ক্রিকেট’ বলে? তার সাবেক দুই সতীর্থকে যেভাবে বুকে আগলিয়ে রক্ষা করেছিল ইডেন গার্ডেনস, টেন্ডুলকারও কি পাবে সেরকম কোন আশীর্বাদ?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।