আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হয়েছিলাম পথভ্রষ্ট, নষ্ট জীবনে তাই কষ্ট, তবুও স্বপ্ন দেখি হবো শ্রেষ্ট।।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ধাপটি এই বিজয়ের মাসেই শেষ হচ্ছে। ভাবছি কী পেলাম আর কী হারালাম। ভাবছি কেমন হতে পারতাম আমি, কেমন হতে পারত আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। তবে যা হবার তা হয়েছে এখন ভেবে কোন লাভ নেই জানি। তবুও কিছুটা লাভ খুঁজতে চাইলে কিন্তু পাওয়া যায়।

অতীতের শিক্ষা ভবিষ্যতে কাজে লাগানো যায়। আমি হকার (ছদ্মনাম) ২০০৫ এ এস.এস.সি. এবং ২০০৭ এ এইচ. এস. সি. পাশ করে ২০০৭ - ০৮ সেশনে ভর্তি হই ঢাবিতে। যে বিষয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, সে বিষয়টিকে আমি খুব ভালবাসতাম কিন্তু সমাজের মানুষের ভ্রু কুঁচকানোর স্বভাবের কারনে সেই বিষয়টি ছেড়ে ২০০৮ - ০৯ সেশনে ভর্তি হই অন্য একটি বিষয়ে। এখন মানুষ ভ্রু কুঁচকায় না, বলে ভালো সাবজেক্ট। ২০০৫ সাল।

অজ পাড়া গাঁয়ের একটা স্কুল থেকে এ. এস. সি পাশ করে ঢাকায় আসলাম। 'ন' ভাই তখন ঢাবির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে, শহীদুল্লাহ হল ছেড়ে, বড় মগবাজারে বাসা ভাড়া নিয়েছে। তাই ঢাকা শহরে এসে আমার থাকার কোন চিন্তা করতে হয়নি। ২০০৫ থেকে ২০০৭ এই ছিল আমার কলেজ লাইফ। কলেজ লাইফে আমার কাজের পরিধি ছিল কলেজে যাওয়া, কলেজ থেকে বাসায় ফেরা, বাজার করা আর বুয়াকে ইনস্ট্রাকশন দেওয়া যে ''কখন কী রান্না করতে হবে।

" তেমন ভালো কোন বন্ধু পাইনি কলেজ লাইফে। নরম কাদা-মাটির গ্রাম ছেড়ে শক্ত ইট-পাথরের শহরে এসে দেখলাম যে এই শহরের মানুষগুলো খুব যান্ত্রিক। এক প্রকার একা একা বন্দি জীবন কাটিয়েছি কলেজ লাইফে। ঠিক যেন ছুটি গল্পের ফটিকের মতো। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ত।

ক্রিকেট পাগল ছিলাম। তাই মন পড়ে থাকতো হাইস্কুলের খেলার মাঠে। ২০০৭ - ০৮ সেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলাম। ''ন'' ভাই তখন পি.এইচ.ডি. করার জন্য দেশের বাইরে চলে গেল। আর এই যান্ত্রিক শহরে আমি হয়ে গেলাম একা।

একটা ম্যাচ ঠিক করলাম। কিন্তু প্রতিদিন বাসে করে ভার্সিটিতে যাওয়া - আসা কিছুতেই ভাল লাগলো না। তাছাড়া বাড়ি থেকে যে টাকা পাই তাতো সবই চলে যায় আবার মাস শেষে পড়ে যায় টানাটানি। পরের বাড়ি যেয়ে টিউশনি করতে আমার কখনই ভাল লাগেনি। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং এ ক্লাস নেওয়ার কথা চিন্তা শুরু করলাম।

যখন আমি কোচিং করতাম, তখন ভাবতাম আমিও ক্লাস নেব। ভাবলাম হলে উঠব। এক বন্ধুর সাথে পরামর্শ করলাম। বন্ধুটি আমাকে হলে উঠানোর ব্যবস্থা করলো। রাজনৈতিক আশ্রেয়ে হলে উঠলাম কেননা বৈধ ভাবে ছেলেদের হলগুলোতে কোন ছাত্র উঠতে পারে না।

আমার হলের রুম নং ২০৮। ৪ বেডের এই রুমে মোট ২৫ জন থাকে। আমাকে দিয়ে সদস্য সংখ্যা হলো ২৬ জন। রাত আসল, হল জীবনের প্রথম রাত ৪ বেডে থাকবে ৮ জন, মেঝেতে থাকবে ১৪ জন, বাকি ৬ জন থাকবে রুমের বাইরে, যেখানে সেখানে। হল জীবনের প্রথম রাত, আল্লাহর নাম নিয়ে মেঝেতে একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম।

অন্য পাশে ঘোরার আর কোন উপায় নেই। খুব চাপাচাপি। নিচের হাত পা ব্যথা হয়ে গেল। হটাৎ করেই শুরু হলো ছারপোকার কুটকুট কামড়। ঘুম হলো না।

উঠে গেলাম বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম। ভাবলাম বাসায় কত্ত না মজায় থাকতাম। খুব কান্না পেল। মায়ের কথা কেন জানি খুব বেশি মনে পড়লো। আমার যখন অনেক কষ্ট হয় তখন কেন জানি মায়ের কথা খুব বেশি মনে পড়ে।

রুমে নতুন সদস্য দেখে আমার দিকে কেমন কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো সবাই। কেউ কেউ খারাপ ব্যবহার করাও শুরু করলো। বন্ধুটির সাথে বিষয়টি বললাম। সে বলল '' এক্টিভ রাজনীতি কর, এখানে জোর যার মুল্লুক তার, দেখবি আর কেউ তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করছে না। ভাল ভাবে থাকতে পারবি, ঘুমাতে পারবি।

কী আর করা শুরু করলাম রাজনীতি। এক্টিভ রাজনীতি। একবোরে পলিটিকাল হয়ে গেলাম। রাজনীতির কারনে অনেক বন্ধু, বান্ধব বেড়ে গেল। তারাও রাজনীতি করে।

অনেক ধরনের মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়ল। সিগারেট, গাঁজা, মদ, পতিতা এই নোংরা শব্দগুলোও পরিচিত হয়ে গেল আস্তে আস্তে। হলে আমাকে সবাই এক নামেই চেনে এবং জানে। ক্যাম্পাসেও অনেকটাই পরিচিত হয়ে গেলাম আস্তে আস্তে। কেননা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে রাজনৈতিক কালচার ( মিছিল করা, মধুতে আড্ডা দেওয়া, টিভি রুমে মাস্তানি করা, ক্যাম্পাসে মারামারি, গ্যানজাম করা, সিনিয়রদের কে অসম্মান করা এমনকি গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ না করা, ক্যান্টিনে বাকি খাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি) আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে শুরু করলাম।

যখন একটু সিনিয়র যখন হয়ে গেলাম দেখলাম জুনিয়ররা সালাম দেয়, সিনিয়ররা ডেকে জিজ্ঞাসা করে ''কেমন আছ''? বুঝতাম এক প্রকার ভয় থেকেই তারা এগুলো করে। মুখে তারা ভাল ব্যবহার করছে কিন্তু মনে মনে গালি দিচ্ছে। হলে যারা আমার ইয়ারমেট কিন্তু নন পলিটিকাল ছিল তারা কখনই আমার সাথে হাই হ্যালো ছাড়া কোন কথা বলতো না। ভাবতো পাছে যদি কোন বিপদ হয়। সহপাঠিারাও ছিল ওরকম।

এক পর্যায়ে যখন পাগলা কুত্তার মতো রাজনীতির পেছনে ছুটতে থাকলাম ঠিক তখনই বহিষ্কার হলাম ঢাবি থেকে ১ বছরের জন্য। বুঝলাম বিপদে পড়েছি। যাদের হয়ে রাজনীতি করলাম তারা পাশে কেউ দাড়ায়নি তখন। আমি যাদের জন্য মারামারি গ্যানজাম করলাম, অস্ত্র ধরলাম, তারা আমাকে দলের ছেলে হিসেবে স্বীকার করলো না। যেন অথৈ সাগরে পড়লাম।

কোন মুখ নিয়ে বাবা মা ভাই বোনের সামনে দাড়াব, ভাবতেই নিজেকে ধীক্কার দিতে ইচ্ছে করে। অনেক দৌড়াদৌড়ি করলাম বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য। কিছুতেই কিছু হলো না। মা অনেক কেঁদেছিল ছেলের এমন নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা শুনে। বাবা বলেছিল '' নিজের জীবনকে এভাবে নষ্ট করে দিলে? ভাই বোন ব্যথিত রিদয়ে বলেছিল '' চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে, রাজনীতি আর হল ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনার মনোনিবেশ হ।

" রাজনীতি ছাড়লাম, পড়াশোনায় মনোনিবেশ করলাম কিন্তু হল ছাড়লাম না। কারন আমি চেয়েছি যারা আমাকে খারাপ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল তারাই আমাকে একদিন ভাল বলবে। আজ দুই বছর হয়ে গেল আমি মিছিল করি না। মধুতে যাই না। টিভি রুমে যাই না।

বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই না। গ্যানজাম, মারামারি থেকে দূরে থাকি। রুমেই থাকি সব সময়। নিজেই রান্না করি রুমে। ২১৬ নং রুম, আমি আর আমার বন্ধু ''রাশেদ" থাকি এই রুমে।

আমি এখন একজন আবাসিক ছাত্র। পড়াশোনা করি। সময় পেলেই ফেসবুকে বসি আর ব্লগ লিখি। রুমেই টিভি কার্ড আছে, মন চাইলে টিভি দেখি। এখন আমাকে আর বাড়ি থেকে টাকা নিতে হয় না।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং এবং প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ কোচিং এ ''বাংলা'' ক্লাস নিই। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সহায়িকা হিসেবে একটি ''বাংলা'' বইও লিখেছি। অনেকেই প্রশংসা করেছে। ডিপার্টমেন্টের পড়াশোনায় মন দিয়েছি। সিজিপিএ ৩.০০ থেকে ৩.৩২ এ নিয়ে এসেছি।

খুব ছোটবেলা থেকেই একজন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। এখনও সেই স্বপ্ন দেখি। এখন আমাকে কেউ খারাপ ছেলে বলে না।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.