মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার এম হামিদুল্লাহ খান বীরপ্রতিকের সঙ্গে রেডিও তেহরান এর সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হল।
রেডিও তেহরান : তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আপামর জনগণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। তবে, যুদ্ধের শুরু থেকেই ভারত বিভিন্নভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করে এবং শেষ দিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন ভারতের কাছেই পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করে। এ প্রেক্ষাপটে অনেকেই মনে করেন, পাকিস্তান ভাঙ্গার পেছনে ভারতের ইন্ধন ছিল এবং ভারত নিজের স্বার্থেই পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
এম. হামিদুল্লাহ খান : পাকিস্তান ভাঙার পেছনে এ রকম একটা বিষয় থাকা অস্বাভাবিক নয়। কারণ ভারত চিরকালই বলে এসেছে 'অখণ্ড ভারত মাতা'। আর সে কারণে ভারত বিভক্তির পর তাদের মধ্যে একটা সুপ্ত ক্ষোভ কাজ করছিল। বৃটিশ শাসন থেকে ভারত ভাগের সময় কংগ্রেস নেতা সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল বলেছিলেন, 'ভারতকে ব্রিটিশমুক্ত করার জন্য আমরা বিভক্তি মেনে নিচ্ছি। তবে পাকিস্তান নামক এই অবৈধ সন্তানটিকে গ্রাস করা আমাদের দশ মিনিটের কাজ।
' এর মাধ্যমে ভারতীয়দের ওই বক্তব্য বাস্তবায়নের একটা সুযোগও তৈরি হলো।
পাকিস্তানীরা যখন আমাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করল তখন মানুষ ছুটাছুটি করে ভারতের দিকে পালাতে শুরু করল। আর ভারতীয়রা তাদেরকে আশ্রয় দিল এবং ভারত সরকার পুরোপুরি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। তবে আমাদেরকে খুবই কষ্টের মধ্যে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ভারতীয়রাও সেই সুযোগে আমাদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার করেছে এবং আমাদেরকে তা সহ্য করতে হয়েছে।
শুধু তাই নয়, শেষ দিকে আমাদেরকে সম্পূর্ণভাবে তাদের অধীন করে ফেলা হয়। তারপরও ভারতীয়রা সে সময় আমাদেরকে যে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে সে জন্য অবশ্যই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। তবে, এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু আগে অর্থাৎ নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় ভারত একটি আদেশ জারি করে। সেই আদেশে বলা হয়, সমস্ত মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডে থাকবে।
মুক্তিবাহিনী বলতে কোনো আলাদা বাহিনী থাকবে না। আর এটি ছিল ভারতের চাণক্য নীতির একটি অংশ। আমরা যে মুক্তিযুদ্ধে Participate করেছি এটাকে তারা পুরোপুরি সে সময় এবং আজ অবধি অস্বীকার করে আসছে। তারা ওই যুদ্ধকে বলে 'Indo-Pak War of 1971'.
আমাদের যুদ্ধ করার ইতিহাস কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, কোনো রেকর্ডে নেই। ফোর্ট উইলিয়ামে যে ছবি রাখা হয়েছে তাতে কোনো বাংলাদেশীর ছবি নেই।
কোথাও কোনো বাংলাদেশীর হাত দেখা গেলে তাও মুছে ফেলা হয়েছে। পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পনের দিন জেনারেল ওসমানী সাহেবকে ঢাকায় আসতে দেয়া হয়নি। সেকেন্ড ইন কমান্ড রব সাহেবকেও আসতে দেয়া হয়নি। সুতরাং এটাকে তারা তাদের সেই পলিসির অংশ হিসেবে নিয়েছে। এমনকি আজকাল যে যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেই যুদ্ধাপরাধীদের কিন্তু ভারতের পরামর্শে মাফ করে দেয়া হয়েছিল; শেখ সাহেবকে তাতে সই করতে হয়েছিল।
এছাড়া আরো একটি বিষয় আমি এখানে আনতে চাই। সেটি হচ্ছে, ৭ দফা গোলামীর যে চুক্তি সই করিয়েছিল ভারত- তারই পরিপ্রেক্ষিতে আজ বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। বিডিআরকে শেষ করে দিয়ে, তাদের নাম নিশানা মুছে দিয়ে গর্বিত একটি বাহিনীকে আজ নাইট গার্ডে পরিণত করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে 'র' এর প্রধান ডি রাবন বলেছিলেন, 'বিডিআর একটি ভয়ংকর বাহিনী। আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভয়ানক ক্ষতিকারক একটি ফোর্স।
এগুলোকে রেখে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে ভারত শান্তিপূর্ণভাবে তাদের শাসন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। '
রেডিও তেহরান : স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে ভারত, পাকিস্তান এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের সাথে বর্তমান সম্পর্ককে কিভাবে দেখছেন?
এম. হামিদুল্লাহ খান : দেখুন, স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তান এবং অন্যান্য মুসলিম দেশ বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে যে সম্পর্ক তা কিন্তু বিষ্মিত হওয়ার মত। সব শ্রেণীর মানুষের কাছে ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কতগুলো বিষয়ে মারাত্মক খটকা লেগে যাবে। এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই- সরকার বাংলাদেশের সংবিধান থেকে যদি 'বিসমিল্লাহ' তুলে দিয়ে ভারত প্রীতির কারণে বা অন্য কোন বিশেষ কারণে ধর্মনিরপেক্ষতা এনে শাখা সিঁদুর ও উলুধ্বনি দেয়া এসব সংস্কৃতি বা নীতি আনতে চায় তাহলে দেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠী সে বিষয়টি মেনে নেবে না। অথচ সে রকম একটা চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমাদের নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতি- ঈমান আকিদা, শুক্রবারে জুমা নামাজ আদায় করা- সবার সাথে মেলামেশা বা মোলাকাত করা এসব ত্যাগ করে আমরা যদি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে ফিরে যাই-তাহলে সেটি কি ঠিক হবে আমাদের জন্য? আজ আমাদের এখানে যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয় এবং ভারতীয় সংস্কৃতি প্রীতির কথা বলা হয়- সেক্ষেত্রে আমি বলব- ভারত নিজেও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। তারা এ কথাও বলে না যে আমরা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র আবার এ কথাও বলে না যে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তবে তারা সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলে, আমরাও আমাদের দেশে সব নাগরিকের সমান অধিকারে বিশ্বাসী। তাহলে কেন এবং কাদের পরামর্শে এত চেঁচামেচি করে সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষতা আনব এবং শাখা সিঁদুর পরাবো নিজেদের মেয়েদের ? ভারতীয় মেয়েদেরকে দিয়ে গভীর রাতে নাচানো- এসব আমাদের সংস্কৃতি নয়। তাছাড়া শহীদ মিনারে নাচের মহড়া দেয়া, থার্টি ফাস্ট নাইটে অশ্লীল কর্মকাণ্ড- এসবকে আমি সমর্থন করি না।
সুতরাং- আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে মনে করি, ভারত চায় বাংলাদেশে একটা খোলামেলা সমাজ হোক-এখানে গোয়া বা ব্যাংককের মত অবস্থার সৃষ্টি হোক এবং সেটাই হচ্ছে। তবে আমি এটাকে ঠিক বলে মনে করি না। আমাদের মেয়েদেরকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা এবং ভারত কিংবা পশ্চিমাদের মত উলঙ্গ করা হবে- এটাকে সমর্থন করি না। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ রকমই একটা চিত্র এবং নতজানু বিষয় দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে অন্যান্য মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্ক প্রায় শুন্য অবস্থানে; বর্তমানে বিষয়টি বেশ জটিল ।
রেডিও তেহরান : স্বাধীনতার চেতনা বলে একটি কথা সব জায়গায়ই তোলা হচ্ছে। এই চেতনা বলতে একটি মহল ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধ থেকে দূরে থাকাকেই বুঝাবার চেষ্টা করে। স্বাধীনতার চেতনা বলতে আপনি কি মনে করেন ?
এম. হামিদুল্লাহ খান : দেখুন, স্বাধীনতার চেতনার প্রসঙ্গটি যখন আনলেন তখন এ সম্পর্কে আমি কি মনে করি সে কথা বলার আগে ওরা অর্থাৎ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কি মনে করে সে সম্পর্কে একটু আলোকপাত করতে চাই। তারা মনে করে স্বাধীনতার চেতনা বলতে আমরা ভারতভুক্ত হয়ে যাই। আর তা হলেই স্বাধীনতার চেতনা সফল।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের এমপি মোহায়মেন সাহেবের লেখা বই আছে, দিল্লি থেকে প্রকাশিত বসন্ত কুমার চ্যাটার্জীর 'The Inside Bangladesh Today' নামের বই আছে। সেখানে বাংলাদেশের অনেক তথাকথিত বুদ্ধিজীবী যারা বুদ্ধি বিক্রি করে খায়-তাদের ভাষ্যমতে, সংবিধানের ৩৭১ ধারায় একটি উপধারা সংযোজন করে বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গ করে ফেললেই তারা নিরাপদ বোধ করে। ওই বইয়ে ঠিক এভাবে লেখা আছে। তো আমরা যদি ভারতভুক্তির পক্ষে কথা বলি, ভারতের পক্ষে কথা বলি তাহলে আমরা ঠিক আছি এবং স্বাধীনতার চেতনার পক্ষে। ভারত পানি নিয়ে যাক আর আমরা পানি অভাবে মরে যাই; তারা টিপাইমুখে বাঁধ করুক, তিস্তার পানি নিয়ে যাক, চট্টগ্রাম পোর্ট; মংলা পোর্ট তাদের হয়ে যাক- সেটাও ঠিক আছে, বিনাশুল্কে করিডোর পেয়ে গেল- তাতেও কোন অসুবিধা নেই-তবে এসবের বিরুদ্ধে গেলেই তারা স্বাধীনতা বিরোধী এবং স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী।
দেখুন, আড়াই/তিনশ' বছর ধরে আমরা যুদ্ধ করেছি সংগ্রাম করেছি এ জন্যে নয় যে, ব্রাহ্মণ্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ব, আকণ্ঠ নিমিজ্জত হব। আমরা যুদ্ধ করেছি- আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি সভ্যতা, ধর্ম-কর্ম, ঈমান আকিদা, নীতি আদর্শকে বাস্তবায়ন করব বলে। আমাদের দেশের চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা দেশের নতুন প্রজন্মকে সৎ সুস্থ ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা ছিল। আমাদের মেয়েরা শাখা সিঁদুর ব্যবহার করবে, উলঙ্গপনা করবে এমনটি আমরা চাই না- আর এটিই হচ্ছে আমার স্বাধীনতার চেতনা।
.।
.। .। .। .। .।
.। .। .। .। .।
.। .। .। .। .।
.। .। .। .। .।
.। .। .। .। .।
.। .। .। .। .।
.। .। .। .।
শেষে বলতে চাই ১টা মেয়েকে (বাংলাদেশ) ১ ধর্ষকের (পাকিস্তান) হাত থেকে বাঁচিয়ে নায়ক বনে যাওয়া পুরুষটি (ভারত) যদি নিজেই পরে সেই ধর্ষণ করে তাহলে ফলাফল কি ?
নিচের লিঙ্কে দেখেন আরও আছে ____
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।