বাঙালির বিদেশপ্রীতি ঐতিহাসিক। এর কারণ সম্পর্কে কোনো গবেষণা আছে কিনা জানা নেই। যদিও উপমহাদেশে কয়েকশ’ বছর আগে বিদেশিদের আগমন, তথাপি সে আমলে বিশ্বে উন্নত দেশ বলতে দু’টি দেশকে বোঝানো হতো। একটি চীন আর অন্যটি ভারতবর্ষ। শুরুতে আরবরা এসেছিল।
তাদের পথ ধরে পর্তুগিজ, ইংরেজ, আরমেনীয়, ফরাসি, ডোমিনিকান, ওলন্দাজ। সবাই এসেছিল বণিক হিসেবে, বাণিজ্যের খোঁজে। এই বাণিজ্য ছিল একমুখী। ভারতবর্ষ থেকে পশ্চিমমুখী। আরব বা ইউরোপ থেকে এই উপমহাদেশে আনার মতো কিছুই ছিল না।
পর্যায়ক্রমে পুরো উপমহাদেশটাই দখল করে নেয় ইংরেজ বণিকরা। তাদের প্রায় ২শ’ বছরের শাসনকালে উপমহাদেশের সব উৎপাদন ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিয়ে পুরো ভারতবর্ষকেই তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত করে ফেলে। এরই মধ্যে দেশে তৈরি হলো একশ্রেণীর সাহেব, যাদের গায়ের রং বাদামি। কিন্তু তারা মনেপ্রাণে ইংরেজ হওয়ার আকুল চেষ্টায় রত ছিল। ইংরেজরা নিজ দেশে ফেরত গেছে তাও প্রায় ৬৪ বছর ছাড়িয়ে গেল।
তারপরও আমাদের দেশের একশ্রেণীর মানুষ আছেন যারা এখনো শুধু ইংরেজপ্রীতিই লালন করেন না, উপরন্তু কারণে-অকারণে যা কিছু বিদেশি তার প্রেমে পড়ে যান। সে বিদেশটা পাশের দেশ ভারতও হতে পারে অথবা দূরের যুক্তরাষ্ট্র বা জাপান। অবশ্য বিশ্বায়নের এই যুগে এটি হওয়াটা বিচিত্র নয়। তবে যেটি শঙ্কার বিষয় সেটি হচ্ছে কারণে-অকারণে বিদেশি পণ্য, ব্যক্তি বা অন্য কিছুর ওপর মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি। সম্প্রতি রাজনীতিকরা পর্যন্ত ঝুঁকছেন বিদেশপ্রীতিতে।
ফলশ্রুতিতে রাজনীতির মধ্যেও ঢুকে পড়েছে বিদেশিপ্রভাব। এ পর্যায়ে একটি মজার ঘটনা মনে পড়লো। ঢাকার উপকণ্ঠে একটি বাড়ির সামনে ছোট সাইনবোর্ডে লেখা ‘এই বাড়িটি বিদেশি কুকুর দ্বারা পাহারা দেয়া হয়’। অবস্থা এমন হয়েছে যে আমরা এখন যেন আমাদের কুকুরের পাহারা দেয়ার সক্ষমতার ওপরও আস্থা হারিয়ে ফেলেছি!
রাজনীতি এখন ভারতমুখী
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন ভারতমুখী। ভারতবিরোধী রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়িয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সহযোগিতার অঙ্গীকারের পর তাদের সহযোগি জন্মগতভাবেই ভারতবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর মুখেও এখন ভারতের প্রতি সহমর্মিতা।
আর সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার ভারত সফরে দেয়া প্রটোকলে ‘চিন্তিত’ হয়ে পড়া আওয়ামী লীগ সরকারকে আশ্বস্ত করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে ভারত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জরুরি তলবে ঢাকার হাইকমিশনার জানিয়েছেন, এটা কূটনৈতিক আস্থা অর্জনের সরকারি প্রক্রিয়ার বাইরে আর কিছুই নয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এতে খুব একটা আশ্বস্ত হতে না পারায় দ্বিতীয় দফা দিল্লি থেকে বার্তা পাঠিয়ে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের জন্মগত সম্পর্ক। এর পরই অন্যদের প্রসঙ্গ। জানা যায়, বেগম জিয়ার ভারত সফরের বিষয়ে সবকিছুই হয়েছে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে।
এ সফরে আন্তরিক প্রটোকলও পেয়েছেন বেগম জিয়া। আলোচনায় খালেদা জিয়ার অবস্থান ছিল কূটনৈতিক। তিনি ভারতের বড় দাবি মেটানোর আশ্বাস দিয়েছেন। সেটি হলো, ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেয়ার বিষয়ে অঙ্গীকার। এতে ভারতের কয়েক যুগের চিন্তার অবসান হতে পারে।
এজন্য বিএনপি নেত্রীর প্রতি যে কোনো সহানুভূতি দেখাতেও প্রস্তুত ভারত। অপর দিকে, বেগম খালেদা জিয়ার ভারত সফরের আগমুহূর্ত থেকেই বিএনপি নেতারা বলছেন তারা ভারতবিদ্বেষী ছিলেন না। ভারতের বিভিন্ন ‘অপকর্মের’ সমালোচনা যখন আওয়ামী লীগ করেনি, বিএনপি তখন করেছে। এর মানে বিএনপি ভারতবিদ্বেষী নয়। এ বিষয়ে বিএনপি সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপটেই বিএনপির সম্পর্ক হয়তো কাক্সিক্ষত পর্যায়ে ছিল না।
ভোটের রাজনীতির জন্য ভারতবিরোধী মনোভাব রাখা যাবে না। বিএনপি চায় এ দূরত্ব নিরসন করতে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ভারত এখন বুঝতে পেরেছে কোনো বিশেষ দলের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়। এজন্য তারা নতুন নীতি ঘোষণা করেছে। প্রণব মুখার্জিও বাংলাদেশে এসে একই কথা বলেছিলেন।
বিরোধী দলীয় নেতার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে এর প্রকাশ ঘটেছে। কোনো বিশেষ দলের ওপর নির্ভর করতে চায় না বলেই ভারত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ভারত এক পা এগিয়েছে, আমরা আরেক পা এগিয়েছি। এখন সম্পর্কের নতুন দুয়ার খুলে যাবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.) বলেন, বিএনপি এখন সঠিক অবস্থানে এসেছে।
জামায়াতসহ দলের ভেতরের একটি অংশের জন্য বিএনপির যে ভারতবিরোধী অবস্থান ছিল তা থেকে এখন সরে এসেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত নেতারাও ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের ভারত সফরকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ভারতবিরোধী জামায়াত নেতারা। ট্রানজিটেও বিরোধিতা করবেন না বলে একমত তারা। এমনকি আমন্ত্রণ পেলে জামায়াতও ভারত সফরে যেতে পারে দলটির নীতি-নির্ধারকেরা ইঙ্গিত দিয়েছেন।
দলটির নির্বাহী সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ এমপি বলেন, কখনো ভারতবিরোধী ছিলাম না। দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করতেই বিভিন্ন কর্মকা-ের বিরোধিতা করতে হয়েছে। এখন ‘জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী’ শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করতেই বেগম জিয়াকে ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এজন্য এ সফর অবশ্যই ইতিবাচক। ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় জামায়াত-বিএনপি সম্পর্ক নষ্ট হবে না বরং খালেদা জিয়ার সফরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের ‘একক সম্পর্ক’ কমবে।
জামায়াতের এক মজলিসে শূরা সদস্য বলেন, দেশের ইসলামী শক্তি বন্ধুত্ব চায়। ভারতকে এখন তার আন্তরিকতা প্রমাণ করতে হবে। তবে এ পথে ভারত কিছুটা এগিয়েছে। ভারত কাকে আমন্ত্রণ জানাবে, কাকে জানাবে না তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তারা জামায়াতকেও আমন্ত্রণ জানাতে পারে।
সরকারকে ভারতের দুই দফা বার্তা
বিএনপির সঙ্গে আন্তরিকতা ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকের খবর ঢাকার গণমাধ্যমগুলোতে প্রধান শিরোনাম হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডাক পড়ে হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের। অবশ্য গণমাধ্যমকে এ বৈঠকের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়েছিলেন পঙ্কজ শরণ। হাইকমিশন সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী ভারতের অবস্থান জানতে চান। এ বিষয়ে যা হচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগ যে খুশি নয় সে বার্তাও হাইকমিশনারকে দেয়া হয়। হাইকমিশনার বলেন, ঢাকা-দিল্লির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে বেশি অবদান আওয়ামী লীগের।
ভারতের ভূমিকায় যাতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয় এ বিষয়ে নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে বলে জানান পঙ্কজ শরণ। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ বৈঠকেই ভারত থেকে গ্যাস আমদানির বিষয়টিও জানান হাইকমিশনার। নয়াদিল্লির প্রস্তাব উল্লেখ করে তিনি জানান, ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে গ্যাস আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। শিলিগুড়ি ও রংপুর দিয়ে এই গ্যাস আনা যেতে পারে উল্লেখ করে আলোচনার প্রস্তাব দেন হাইকমিশনার।
তবে সরকারের নীতিনির্ধারণী একটি সূত্র জানায়, হাইকমিশনারকে আওয়ামী লীগের অবস্থান স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বন্ধু ভারতের এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আওয়ামী লীগের এমন কড়া বার্তার পর নয়াদিল্লির শীর্ষ পর্যায় থেকে আবার বার্তা পাঠানো হয়। বলা হয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক জন্মগত। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ভারত প্রকৃত বন্ধু হিসেবে প্রমাণ করেছে।
অন্য পক্ষগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের আগে অবশ্যই আওয়ামী লীগের স্বার্থকে গুরুত্ব দেয় ভারত। আওয়ামী লীগের ক্ষতি হয় এমন কাজ ভারত করবে না। বেগম খালেদা জিয়ার সফর দেশের কূটনৈতিক প্রক্রিয়ারই অংশ বলে উল্লেখ করে ভারতীয় সরকার। প্রটোকলও দেয়া হয়েছে সে অনুসারেই। এরপরও কংগ্রেস সভানেত্রীর সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ না হওয়ার বিষয়েও ইঙ্গিত দেয়া হয় সর্বশেষ বার্তায়।
খালেদার সফর, নানামুখি মূল্যায়ন
আগামী নির্বাচন সামনে রেখে খালেদার ভারত সফর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মোড় এনে দিয়েছে। হঠাৎ করেই ‘চরম ভারতবিরোধী’ বলে পরিচিত দল ও রাজনীতিকে ‘প্রবল ভারতমুখী’ করার মিশনে নেমেছেন খালেদা জিয়া। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা ঐতিহাসিক সম্পর্কের ভাগিদার হতে ‘চরম ভারতবিদ্বেষী’ অবস্থান থেকে সরে আসারও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ভারত প্রশ্নে প্রবল সন্দেহপূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ সম্পর্ক নিয়ে থাকা খালেদা জিয়ার এমন বৈপরীত্য অবস্থানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দু’দেশের রাজনৈতিক মহলে। নির্বাচনকালে ‘ভারত জুজু’র ভয় আর নিজ দেশে ভারতবিরোধী মনোভাব চাঙ্গা রেখে ‘ভারতবিরোধী’ অংশের ভোটপ্রাপ্তির নির্বাচনী অস্ত্র এখন তেমন কার্যকর না হওয়ায় বিষয়টি বুঝতে পেরেই কৌশল পাল্টিয়ে রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত স্রোতে হেঁটে খালেদা জিয়া ভারতের সঙ্গে অবিশ্বাসের সম্পর্ক জোড়া লাগাতেই এবার অধিক মনোযোগী হয়েছেন।
তাই ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের চেয়ে তিনিই (খালেদা জিয়া) ভারতের প্রত্যাশা বেশি পূরণ করতে পারবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সে দেশের সরকারকে। ভারতের সমর্থন শুধু আওয়ামী লীগের দিকে না থাকে, সেজন্যই ‘ভারতবিরোধী কার্ড’ ফেলে দিয়ে ভারত প্রশ্নে খালেদা জিয়ার এমন রাজনৈতিক কৌশল।
বিশ্লেষকদের মতে, আগামী জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই দেশের প্রধান দু’দলই বিশ্বের ক্ষমতাবান দেশগুলোর নিকট ধরনা দিচ্ছে। সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন।
শুধু ভোটের রাজনীতির কারণেই এবার হয়তো নিজ অবস্থান পাল্টাতে চাইছেন খালেদা জিয়া। তাই ভারতে গিয়ে তিনি সে দেশের সরকারকে আশ্বস্ত করেছেন যে, ক্ষমতায় গেলে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেবে না বাংলাদেশে। খালেদা জিয়া এও বলেন, আমরা পেছনের দিকে নয়, আগামীতে তাকাতে চাই। সামনের দিকে তাকাতে চাই।
এদিকে, ভারতও চাইছে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিটি পক্ষের সঙ্গেই বোঝাপড়া মজবুত করতে।
নিজস্ব কিছু স্বার্থ বা পছন্দ-অপছন্দ থাকলেও বাংলাদেশের কোনো একটি রাজনৈতিক পক্ষের প্রকাশ্য পক্ষপাত না দেখিয়ে নয়াদিল্লি চাইছে এই সুযোগে দু’পক্ষের কাছ থেকেই অধিক প্রত্যাশা পূরণে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে। তাদের মতে, ভারত সফরে গিয়ে খালেদা জিয়া যে কথা বলেছেন, এটি সত্যিই তার দলগত অবস্থান কিনা, তা তাকেই প্রমাণ করতে হবে। খালেদা জিয়াকেই প্রমাণ করতে হবে তার ঐতিহ্যগত ভারতবিরোধী অবস্থানেই অনড় থাকবেন, না সত্যিই ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টিতে তার নীতির পরিবর্তন করবেন? আওয়ামী লীগের তরফে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, আমরা আনন্দিত যে, তিনি (খালেদা) ভুল স্বীকার করেছেন। তার সরকারের যে ভুল নীতি ছিল তাও তিনি স্বীকার করেছেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের অবস্থান সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী এর আগে যখন ক্ষমতায় ছিলেন সব সময় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছেন।
আজ সেই কথা তিনি ভারতের কাছেও স্বীকার করেছেন। খালেদা জিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, তার (খালেদা জিয়া) ভ্রান্তনীতি অনুসরণের কারণে জাতি হিসেবে বিশ্বে আমরা নিগৃহীত হয়েছি, আমাদের নেতিবাচক পরিচিতি হয়েছে। এজন্য সারা বিশ্বে তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। সরকারি দলের এমন অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে বিএনপি। দলটির যুগ্ম মহাসচিব ও জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের পররাষ্ট্রনীতি কী এবং কেমন হবেÑ সে কথাই ভারত সফরে গিয়ে খালেদা জিয়া পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
আমরা সব সময়ই প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। তবে নতজানু পররাষ্ট্রনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি না। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে’ এমন কোনো কথা খালেদা জিয়া কেন বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ কখনই বলেননি।
পাল্টাপাল্টি এমন অভিযোগ করা হলেও, ভারত প্রশ্নে বাংলাদেশের রাজনীতি নাটকীয় মোড় নিতে চলেছে এটা সবাই একবাক্য স্বীকার করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে খালেদা জিয়া ও তার দলের সম্পর্ক কোনোদিনই মধুর ছিল না।
নির্বাচন এলেই খালেদা জিয়ার সাম্প্রদায়িকতাপুষ্ট ও চরম ভারতবিরোধী হয়ে ওঠার ঘটনা ছিল প্রকাশ্য। বিশেষ করে ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া প্রতিটি নির্বাচনী জনসভায় ভারতবিরোধী টার্মকার্ড ব্যবহার করে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ফেনীসহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ভারত হয়ে যাবে। মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শোনা যাবে। দেশ থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ২০০১ সালের ওই নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরূপ দেখেছে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ।
নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর টার্গেট করে যে হামলা-নির্যাতন, বিশেষ করে সংখ্যালঘু মহিলাদের এমন নারকীয় ও সুপরিকল্পিত নির্যাতন চালানো হয়েছিল তা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল। আর এটি করা হয়েছিল শুধু আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার সাহস প্রদর্শনের ‘অপরাধের’ শাস্তি হিসেবে। এসব কারণে খালেদার সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে আওয়ামী লীগের হতাশ হওয়ার কোনোই কারণ নেই। আগামী নির্বাচনে প্রতিবেশী দেশের আর্শীবাদ পেতে বিএনপির পাকিস্তান প্রেম ছেড়ে হঠাৎ ভারতপ্রেমী হয়ে উঠায় দেশটির নেতৃত্ব বাগবাকুম নাচবে না। কেননা, ২০০১ সালের নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে খালেদার ভারত সফরে খালেদা ভারতকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারলে তারা ভারতকে গ্যাস দেবে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হলেও ভারতকে গ্যাসের বদলে তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে দশ ট্রাক অস্ত্র দিতে চেয়েছিল। বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদের এক সাবেক মন্ত্রীর জনসংযোগ দেখে মনে হচ্ছে, আগামীতে বিএনপির ক্ষমতা নিশ্চিত করতেই খালেদা ভারত সফরে গিয়েছেন এবং ভারত তাতে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ও দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৎপরতা
এদিকে বর্তমানে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও সাম্প্রতিক ভারতের গৃহীত নীতিতে দলগতভাবে কম-বেশি উদ্বিগ্ন। খালেদা জিয়ার ভারত সফর-পরবর্তীতে ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলবের পাশাপাশি দিল্লির সাথে সরকার সতর্ক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।
সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী সম্প্রতি ভারত সফর করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. হওহর রিজভীসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা শীঘ্রই ভারত সরকারের নীতি-নির্ধারকদের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে ভারত সফরের পরিকল্পনা করছেন বলে জানা যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতপ্রীতির মূল কারণ
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির গতি-প্রকৃতিতে কারণে-অকারণে প্রভাবশালী বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি দেশীয় রাজনীতিকদের দৌড়ঝাপ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। মধ্যপ্রাচ্যসহ চীন, ভারত, আমেরিকা এবং যুক্তরাজ্য এদেশের রাজনীতিতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। তবে সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকা চীনকে মোকাবেলার কৌশল হিসেবে ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
এদিকে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় চীন ভারতের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ। ফলে অভিন্ন স্বার্থগত কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-আমেরিকা সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আর এ কারণে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে উপমহাদেশে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত সাম্প্রতিক সময়ে মূল ভূমিকা পালন করছে। ফলে এদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলো দৃশ্যত তাদের মতাদর্শগত অবস্থানের কথা ভুলে ভারত প্রেমের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
ভোটের পাল্লা কোন দিকে ঝুঁকছে
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এদেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশী প্রভাবশালী রাষ্ট্রের আনুগত্য লাভের প্রতিযোগিতায় নেমেছে বলে সমালোচনার ঝড় বইছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশীদের হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়ার কারণে বড় দলগুলোর সমালোচনা করছে ছোট দলগুলোর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। তারা মনে করছেন, এদেশের পরবর্তী সরকারপ্রধান কে হবেন ভোটের মাধ্যমে তা ঠিক করবে এদেশের জনগণই। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত বিদেশী নির্ভরতা কমিয়ে গণমানুষের সমর্থনের প্রতি ঝোঁকা। এতে করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী রাষ্ট্রের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসবে। জনগণ যেন স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সেই পরিবেশ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকদেরই তৈরি করতে হবে।
নতুবা সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ নেবেই। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।