আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশে ভ্যালেরি এ. টেইলর এর ৪০ বছরের পথপরিক্রমা

আমি পেশায় একজন স্পীচ থেরাপিষ্ট কিন্তু ব্লগ পড়া আমার নেশা। আর একটা নেশা আছে সেটা হল মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস প্রতিটা মানুষের কাছে পৌছে দেয়া। আমি সে চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। আমি কোন ভালো লেখক নই কিন্তু আমি একজন ভালো পাঠক। শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালের শরৎকালে।

তখন আমি ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে ‘ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিজ’-এর (ভিএসও) হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনার পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত ক্রিশ্চিয়ান হাসপাতালে কাজ করতে এসেছিলাম। আমার কাজ ছিল জেনারেল হাসপাতাল ও এর কাছের কুষ্ঠ হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি দেওয়া, পাশাপাশি আমার অবর্তমানে ভবিষ্যতে এ কাজ করার জন্য একজন সহকারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা। আমার সহকারী ছিলেন এক তরুণ, সুবিলাশ চন্দ্র চাকমা। পরে ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় অন্য ভিএসও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে আমাকেও সরিয়ে নেওয়া হয়, অবশ্য পরে আমি আবার ফিরে আসি।

আর তাই ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম দেখার সৌভাগ্যের অংশীদার হতে পারি। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত সেই দিনটিতে একজন রোগীরও ফিজিওথেরাপি নেওয়ার দিকে মন ছিল না। সুবিলাশ আবার কাজে যোগ দিলেন, ফিরে এলেন আরও অনেকেই। চন্দ্রঘোনার সেই হাসপাতালে কাটানো তিন বছরই আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময়। এর চেয়ে সুন্দর পরিবেশ কল্পনাও করা যায় না।

বিদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাহাড়ের ওপর বাঁশ দিয়ে বানানো বাংলোয় থাকতেন, সেখান থেকে তাকালেই হাসপাতাল দেখা যেত। হাসপাতালের পাশ ঘেঁষেই বয়ে চলা কর্ণফুলী আর দূরে দিগন্তরেখায় মিলিয়ে যাওয়া পাহাড়ের সারি। শীতের দিনগুলোতে পাহাড় বেয়ে নামতে নামতে নদীর বুকে সাম্পানের দাঁড় ফেলার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনা যেত কিন্তু সাম্পান দেখা যেত না। হঠাৎ করে কুয়াশা ভেদ করে কোত্থেকে যেন সাম্পানটা চোখের সামনে ভেসে উঠত। অদ্ভুত সুন্দর সে দৃশ্য।

ধানখেতের ওপর সন্ধ্যাবেলা মিটমিট করে জোনাকিরা দলবেঁধে জ্বলে উঠত, সশব্দে ব্যাঙ ডাকত। আর আমার ঘরে সব সময়ের সঙ্গী হয়ে স্থান করে নিয়েছিল একটি ১৫ ইঞ্চি লম্বা গিরগিটি। অপূর্ব সুন্দর পরিবেশ, চমৎকার কিছু মানুষ আর কাজের প্রতি আমার উৎসাহ—সবকিছু মিলিয়ে জীবনে এক অপরূপ ছন্দ সৃষ্টি হয়েছিল। আমি এর আগে কখনো কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসা করিনি। তাঁদের জন্য ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জারির ব্যাপারটা আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

যেসব কুষ্ঠরোগী চোখ বন্ধ করতে পারতেন না, অথবা যাঁদের হাত কিংবা পা অকেজো হয়ে পড়েছিল, তাঁরা এই সার্জারির মাধ্যমে সেরে উঠতেন। আমাদের এই সার্জারি খুবই ভালো ফল দিচ্ছিল আর সার্জারি-পরবর্তী চিকিৎসা হিসেবে ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন হতো, যাতে রোগীরা সঠিকভাবে তাঁদের সার্জারি করা অঙ্গটি ব্যবহার করতে পারেন। এ দেশে আসার পর আমি বরিশালে মাত্র দুই মাসের জন্য খুবই প্রাথমিক বাংলা শেখার কোর্স করেছিলাম। কারণ, লন্ডন ভিএসওর সঙ্গে আমার চুক্তিই ছিল মাত্র ১৫ মাসের। একটা ব্যাপার খুব শিগগিরই বুঝতে পারলাম যে আমার ‘বাংলিশ’ ভাষায় রোগীদের সঙ্গে ভালোভাবে কথাবার্তা চালানো না গেলেও রোগীরা এতে বেদম হাসছে।

আমার একটা ভুল তো আমাকে প্রায় বিখ্যাত করে তুলেছিল! ফিজিওথেরাপি ইউনিটে একদিন আমি এক রোগীকে আলট্রাভায়োলেট রশ্মি চিকিৎসা দেওয়ার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমি কী করছি। আমি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলাম যে আমি রোগীটিকে ‘আলু’ দিচ্ছি। বলাই বাহুল্য যে আমি ‘আলো’ আর ‘আলু’, এ দুটো শব্দ গুলিয়ে ফেলেছিলাম। জেলারেল হাসপাতালের তিন নম্বর ওয়ার্ডে প্রথম দিকে মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের রাখা হতো। আমি ইংল্যান্ডের ম্যান্ডেভিলেতে ন্যাশনাল স্পাইনাল ইনজুরিস সেন্টারের খুব কাছেই বড় হয়েছিলাম, তাই সেখানকার সেবার সঙ্গে এখানকার সেবার পার্থক্যটা খুব ভালোভাবে চোখে লাগত।

যুক্তরাজ্যে এ ধরনের মেরুদণ্ডে আঘাত পাওয়া রোগীদের শুধু যে হুইলচেয়ার দেওয়া হতো তা-ই নয়, বরং হাত দিয়ে চালানো যায় এমন ছোট্ট একটা গাড়িও পেতেন তাঁরা। চন্দ্রঘোনায় তখন কোনো হুইলচেয়ার ছিল না, যথেষ্ট ভোকেশনাল ট্রেনিংয়েরও অবকাশ ছিল না, যার ফলে দুর্ঘটনার পর অনেক পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তির জীবনে আশার আলো প্রায় নিভে যেত। এমনই একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর বিছানায় বসে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তাঁদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমি কিছু করার চেষ্টা করব। ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে আমি বাংলাদেশের পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের জন্য একটি পুনর্বাসনকেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিলাম। দুই বছর সেখানে কাটিয়ে ১৯৭৫ সালে আবার ফিরে এলাম বাংলাদেশে।

বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন নিয়ে, পর্যাপ্ত বিদেশি সাহায্য জোগাড় করে সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি) প্রতিষ্ঠা করে পুরোপুরি কাজ শুরু করতে লেগে গেল আরও চার বছর। এই সময়ে সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা চারজনের দলটি ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কাজ করে গেছে। সেখানেই দুটো সিমেন্টের স্টোররুমে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের সেবাদানের মাধ্যমে সিআরপির যাত্রা শুরু। প্রথম ১১ বছরের মধ্যে সিআরপিকে জিপসিদের মতো তিনবার এখান থেকে ওখানে স্থানান্তর হতে হয়েছে। অবশেষে ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সিআরপি তার স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে পায় সাভারে, যেখানে এখন সিআরপির হেড অফিস অবস্থিত।

ইতিমধ্যে সিআরপি একটি বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যা একই সঙ্গে— ১. একটি প্রতিষ্ঠান, যেটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের পাশাপাশি সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুদের মায়েদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের (শিশুদের) চিকিৎসাসেবা দেয়। পাশাপাশি স্নায়বিক ও অস্থিবিকৃতির লক্ষণ রয়েছে এমন রোগীদের জন্য ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপির ব্যবস্থা করে। ২. একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র, যার নাম বাংলাদেশ হেলথ প্রফেশনস ইনস্টিটিউট। এখানে ১১টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ৩. একটি উদ্যোগ, যা শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দলগতভাবে এলাকাভিত্তিক পুনর্বাসনকে উৎসাহিত করে।

বর্তমানে বাংলাদেশের আটটি জেলায় এ কার্যক্রম চলছে। সিআরপির ভবিষ্যৎ কী? ৩০ বছর পূর্তির মাধ্যমে সিআরপি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। আমরা এখন ফিরে তাকাচ্ছি, ফেলে আসা দিনগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী ৩০ বছরের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এই দীর্ঘ সময়ে সিআরপি পুনর্বাসন বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা লাভ করেছে। আমাদের পরিকল্পনা সারা বাংলাদেশে এই জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া।

১০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি সেন্টার নিয়ে সিআরপির পক্ষে দেশজুড়ে যত পক্ষাঘাতজনিত দুর্ঘটনা ঘটে, তার চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা অসম্ভব। আমরা যদি স্বল্প পরিসরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে স্যাটেলাইট স্পাইনাল ইনজুরি ইউনিট বসাতে সক্ষম হই, তা হলে আশা করা যেতে পারে এ ধরনের উদ্যোগ আরও প্রসার লাভ করবে। যদি দুর্ঘটনায় পতিত রোগীকে বাড়ির কাছেই প্রাথমিক সেবা দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে পরে হয়তো তাঁকে ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের জন্য মানিকগঞ্জে সিআরপির নতুন ট্রেনিং সেন্টারে স্থানান্তর করা যাবে, এমনটিই আমাদের আশা। যেসব প্রতিবন্ধী আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তাদের পক্ষে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে রাজধানীতে এসে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই সিআরপির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হলো ছয়টি বিভাগীয় শহরে একটি করে থেরাপি সেন্টার গড়ে তোলা।

ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি, অর্থোটিক্স অ্যান্ড প্রসথেটিক্স এবং সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ফলোআপ প্রদানকারী একটি দলের সহযোগিতায় রোগীরা তাদের এলাকা থেকে খুব দূরে না গিয়েই প্রয়োজনীয় সেবা পাবে। এখনো অনেক পথ পেরোনো বাকি, অনেক বাধা ডিঙানো বাকি। কী ভালোটাই না হবে যদি আমরা কবিরাজদের সিআরপিতে ট্রেনিং দিতে পারি, যাতে তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ এলাকার আনাচকানাচে পৌঁছে গিয়ে সাধারণ মানুষের সেবা করতে পারেন। কী দারুণ হবে যদি পরের দশকে আর কোনো প্রতিবন্ধীকে হুইলচেয়ারের অভাবে হাতে কিংবা পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলাফেরা করতে না হয়। প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন, যাতে প্রতিবন্ধীরা জীবনে সমান সুবিধা ভোগ করতে পারে।

এখন প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানের হার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য আমাদের আরও আশান্বিত করে তুলছে। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রোগী, সেবক, দাতা, পৃষ্ঠপোষক—সবাই মিলে ‘একসঙ্গে কাজ করা’ই হয়তো সিআরপির পরবর্তী ৩০ বছরের স্লোগান হবে। আমাদের সবাইকে নিজের নিজের অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সবার প্রতি তাই আমাদের আহ্বান, এই উদ্যোগে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে এগিয়ে আসুন। ইংরেজি থেকে অনূদিত  ভ্যালেরি এ. টেইলর: প্রতিষ্ঠাতা, সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি)।

যুক্তরাজ্যের নাগরিক। বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। সুত্র - দৈনিক প্রথম আলো (২৪ - ১১ - ২০১২)  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.