আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মূর্ত মরণ মায়া (শেষের অংশ)

এক শব্দহীন শব্দের শাব্দিক অনুভূতি পড়ন্ত বিকেলে সন্ধ্যার ছাঁয়া ছাঁয়া পরিবেশে চিন্ময়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত এক আবেশী দ্যোতনা এনে দেয় আলপনার মনে। ড্রাইভ করছে আর মৌ্ন বিহঙ্গমার মত ডানা মেলে উড়ছে কল্পরাজ্যে। অঞ্জন নামটি মাঝে মধ্যে মনের কোনে উঁকি ঝুঁকি দিলেও হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে স্বপ্নলোকে। জীবন চলার পথে কত কিছু এলো গেলো। স্মৃতির পাতায় এখন শুধু শূণ্যতা।

আকাশটাকে শুধু বুকে লালন করে গেলো, পারেনি সেখানে উড়াতে কোন স্বপ্নের ঘুড়ি ! বাসায় ফিরে দেখে হাসিব আগেভাগেই অফিস থেকে ফিরে এসেছে। মুখের উপর পেপারটা রেখেই জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ? -কোথাও না তেমন, শুধু ঘুরে বেড়ালাম এদিক সেদিক। ‘ বলেই আলপনা সাওয়ার নেওয়ার জন্য ঢুকে গেল বাথরুমে। হাসিব এ ক’বছরে আলপনাকে বেশ ভাল করে চিনে ফেলেছে। নিশ্চয়ই মনের অবস্থা ভালো নেই।

তাই বেশী কিছু জিজ্ঞেস না করে এবারেও বরাবরের মত ছেড়ে দি্ল‌ তার মত করে। যখন আলপনা স্বভাবিকতার মধ্যে ফিরে আসে তখন হাসিবও কেমন করে সব কিছু ভুলে যায়। আর আলপনা শরতের আকাশের মত নীলাভ ছড়িয়ে লুটিয়ে পড়ে হাসিবের বুকে এক বুঁনো হাঁসের মত। এতটুকুর পরম পাওয়াতে হাসিবের বুকটা যতটা না ভরে তারচেয়ে বেশী ভরে উঠে চারিপাশটা আনন্দ উচ্ছ্বাসের ফুয়াড়া ছড়িয়ে। সাওয়ার সেরে মাথায় টাওয়াল পেঁচাতে পেঁচাতে হাসিবের কাছে এসে বসে জিজ্ঞেস করলো, কি খাবে ? চা নাকি একেবারে রাতের খাবার খেয়ে নিবে? -নাহ শুধু চা দাও।

আজ রাতে আর কিছু খাবো না। - কেন, কি খেয়েছো আজ? -অফিসে লাঞ্চ পার্টি ছিলো। প্রচুর খাওয়া হয়ে গেছে। আলপনা আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো কিচেনে। কিছুক্ষণ পর দু’কাপ চা হাতে করে নিয়ে এসে আবারো হাসিবের পাশে এসে বসলো।

হাসিব তখনো নিবিষ্ট চিত্তে পেপার পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে হোম ফোনটা ক্রিং ক্রিং করে উঠলো। রিসিভারটা কানে তুলে ধরতেই ওপাশে কান্না জড়ানো কন্ঠ,-আপা আমি দিপ্তী। -দিপ্তী, কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেনো? উদবিগ্নতার সাথে জিজ্ঞেস করলো আলপনা। -আপা, ভাল লাগছে না।

এতক্ষণ মায়ের সাথে কথা বলছিলাম। -তাই? তোমার মা কেমন আছেন? -ভালো। আপা, আজ সারাদিন যে সূর্যটা দেখলাম , সেই সূর্যটাই তো মা এখন দেখছে তাই না? -সূর্য কয়টা পৃথিবীতে, দিপ্তী? -আমি ত জানি একটা । - তাহলে? -না। এমনিতেই।

মাকে বললাম আমার সূর্যটা এখন তোমার কাছে যাচ্ছে আর সাথে সাথেই মা কেঁদে ফেললো। বলেই দিপ্তী আবার কাঁদতে শুরু করলো। আলপনা একটু রাগত স্বরেই বললো,- দিপ্তী, তুমি কিন্তু তোমার মাকে ভালো থাকতে দিচ্ছোনা। এভাবে রাত জেগে কথা বললে তোমার মা কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়বে। তখন তুমি এতদূর থেকে কিছুই করতে পারবে না।

-হুমমম। আপা তোমাকে কখন দেখবো? -চলে এসো এক সময় বাসায়। আমি এখন রাখবো। ভালো থেকো। আর মনটাকে শক্ত করো দেখবে সব কিছু ঠিক হয়ে যাচ্ছে।

বাই নাও। আলপনা ফোনটা রেখে হাসিবের পাশে এসে বসলো। দেশছাড়া মানুষগুলোর মনের অবস্থা যে কতটা করুন তা দিপ্তীর অবস্থা দেখলে বেশ বুঝা যায়। হাসিবও প্রথমদিকে প্রচন্ডরকমে ভেঙ্গে পড়েছিলো। শুধু একটা কথাই বারবার বলতো, কী যে ভুল করেছি ! কম্পিউটারের সামনে বসে মা, বোন ভাই বন্ধুদের সাথে চ্যাট করতো আর চোখের জলে ভাসতো।

নতূন দেশে , নতুন বেশে জীবনকে খাপ খাওয়াতে অনেক দক্ষিন এশিয়ো মানুষগুলোকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। ভাষা, সংস্কৃতি, আবহাওয়াগত বিস্তর পার্থক্যের কারনে বিশেষ করে মধ্যবয়সী মানুষগুলোর দূরাবস্থার কথা বর্ণনাতীত। হতাশাগ্রস্ত হয়ে ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষগুলো রোগে ভোগে শোকে জীবনটাকে কোনরকমে পার করে দিচ্ছে, হচ্ছে সরকারের সাহায্য সহযোগিতার শরণাপন্ন । ফিরে যাওয়ার কোন পথ থাকে না বলেই এভাবে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়ে উঠে। আর পাশাপাশি বাড়তে থাকে মানসিক রোগের সংখ্যা, ঘর ভাঙ্গার ঘটনা, অনিবার্যকারনে একে অন্যের উপর থেকে বিশ্বাস, সততা, আস্থা হারাতে শুরু করে যার ফলে ঘটে যত অমানবিক ঘটনা।

এ সমস্ত অস্বাভাবিক বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ করে মাথাটা টন টন করে উঠে। কোন কথা না বলে সোজা চলে যায় বেডরুমে। আলোটা নিভিয়ে চোখ বুজে ঘুমের চষ্টা করলো মাত্র, কিন্তু ঘুমাতে পারলো না। ঘুমের রাজ্যে এ কিসের আলামত অস্থির করে তুলছে !পাহাড়ের বুক চিরে এক হৃদপিন্ড ধেয়ে আসছে, রক্ত ঝরছে টপ টপ করে। বাতাসে বেতাল উন্মত্ততা, ডালপালাগুলোর বিকট মড় মড় শব্দে আলপনা হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসে।

- উফ, অসম্ভব !ঘুমানো সম্ভব না। চিৎকার করে হাসিবকে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারলো না। কন্ঠরোধ করা স্বরধ্বণি জড়তার আড়ষ্টে ঝিমিয়ে গেলো। ভোরের মৃদু আলোয় ঘুম ভাংতেই আলপনা নিজেকে আবিষ্কার করলো হাসিবের বুকে। কখন যে হাসিব এসে শুয়েছে বুঝতে পারেনি।

পরম আশ্রয়ের আস্বাদন নিতে নিতে আড়মড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে গেল। হাসিব তখনো গভীর ঘুমে নিমগ্ন। আরো কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারবে হাসিব। ততক্ষণে সকালের কর্ম সারতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো আলপনা। হাসিব হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে দেখে সময় আর বেশী নেই অফিসে যাওয়ার জন্য।

তারাহুড়ো করে সাওয়ার শেষ করে সাথে সাথে ড্রেস আপ করে নাস্তার টেবিলে আসতেই দেখে আলপনা গরম গরম নাস্তা নিয়ে বসে আছে। এক নতুন সকালের সতেজ আমেজের শুদ্ধ পরিপাটি পরিবেশ। দিনের শুরুতে সূর্যটা কী নতুন বার্তা দিতে চায়? সে যাই হোক। এখন এই মুহুর্তে হাসিবের খুব ইচ্ছে করছে আলপনার কপালে আদরের রেখা এঁকে দিতে । কিন্ত্য পারলো না।

যদিও আলপনাকে সকালের মিষ্টি আবেশে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে, তারপরেও কোথায় যেন একটা ধাক্কা খেলো। নাস্তা সেরে হাসিব অফিসের দিকে রওনা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি আজ অফিসে যাবে না? --যাবো আরো কিছুক্ষণ পর। --ওকে, আমি যাচ্ছি। আলপনা হাসিবকে বিদায় দিয়ে টিভিটা অন করে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সোফায় এসে বসতেই চোখটা গিয়ে পড়লো বাইরের ছোট্ট ব্যালকনিতে যেখান থেকে এক চিলতে আকাশ দেখা যায়। আকাশে যেন আজ বেশী নীলের ছটা।

নীলের মাঝে শাদা মেঘের আনাগোনা দেখে আলপনা আনমনা হয়ে উঠে। শাদা মেঘগুচ্ছ ছবি আকঁছে আকাশে। দৃশ্যটা চমৎকার। । কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রজাপতির মত মনটা পাখীর পাখায় ভর করে মনটা উড়তে উড়তে কোথায় যে চলে গেলো ! স্মৃতির পাতা হাতড়াতে হাতড়াতে তলিয়ে যাচ্ছে তৃষ্ণার সাগরে! মৃতপ্রায় ছাইচাপা বাসনাগুলো টালমাটাল জীবনে আজো বাজে অজানা সুরে কি বেসুরে, সে সুর ধরে প্রার্থনালয়ে শুধুই অলস ঘন্টা বাজে মুক্তি পাবার ছলে ।

মুক্তি কী আর হয় কোন কিছুতে ?বাঁধন শুধু আকড়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে। এভাবে ঝুম মেরে কতক্ষণ বসেছিলো আলপনা , ঠিক মনে করতে পারছে না। আজ আর ইচ্ছে করছে না অফিসে যেতে। একটা কল করে জানিয়ে দিবে কিনা ভাবছে । এমন সময় হাসিবের ফোন এলো, কি করছ, অফিসে যাবে না? --ভাবছি যাবো না।

একটা ফোন দিয়ে জানিয়ে দিবো। --ঠিক আছে, রেষ্ট নাও। বলেই ফোনটা রেখে দিলো হাসিব। আলপনা আজ আর গেলো না অফিসে। রাজ্যের অলসতা এসে ভর করছে শরীরে।

তারপরেও বাসায় যখন আছে তখন একটু আধটু সংসার ধর্ম পালন করতে হবে। ভাল মন্দ কিছু রান্না করবে বলে মন স্থির করলো। আলপনা বাসায় থাকা মানে হাসিবের রসনা বিলাসারে স্পৃহা প্রকট হওয়া। আবহাওয়াটাও চমৎকার আজ। একটু একটু ঠান্ডা ভাব আছে ।

এই আবহাওয়াতে ইলিশ পোলাও রান্না করলে মন্দ হয় না। হাসিবের খুব প্রিয়। যেই না ভাবনা আর অমনি শুরু হয়ে গেলো রন্ধন কাজের প্রস্তুতি। ঘর সংসারের টুকিটাকি কাজ আর রান্নার ফাঁকে ফাঁকে আলপনা ভাবছে আজ বিকেলটা কিভাবে কাটাবে। অনেকদিন হাসিবের সাথে সময় কাটানো হয় না।

বিভিন্ন ছুঁতা নাতায় , কাজের ফাঁকে আর হাসিবের পাশে বসা হয় না। ভাল মন্দ কোন কথাও হয় না তেমন। তাই ভাবনা দিয়ে মনটাকে সাজাতে লাগল আলপনা। পুরো বিকেল , সন্ধ্যা, রাতটায় হাসিবের একান্ত অন্তরঙ্গে থেকে কাটাবার পায়তারা করছে মনটা। হাসিব আলপনার জীবনের পুরোটাই জুড়ে আছে।

যতটা না সহজ করে আলপনাকে পড়ে ফেলে, ঠিক ততটাই হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে বুঝে ফেলে আলপনাকে। ভাবতে গেলে সত্যি অবাক লাগে। এটা কী শুধু ভালোবাসার কারনে নাকি মানুষকে চিনার এক দূর্বার শক্তি হাসিবের ভিতর কাজ করে ?তবে মানুষকে সে চিনতে পারে গভীরভাবে। মাঝে মাঝে এ বিষয়টা আলপনার কাছে রহস্য হয়ে ঠেকে। সদা হাস্যচ্ছ্বোল, প্রাণোচ্ছ্বল এমন অভাবনীয় বিরল ব্যাক্তিত্বের জন্য এই মানুষটির প্রতি আলপনার ভালোবাসাটা দিনের পর দিন গাঢ়ো হতে থাকে।

কিন্তু একটা সমস্যা আছে হাসিবের, তাহলো আলপনার সমস্ত কিছু তার নখদর্পণে থাকতে হবে, জানতে হবে তার চুলচেরা বিশ্লেষন। কোথায় গেলে, কি করলে এতক্ষণ, কার সাথে ছিলে এ যাবতীয় খুঁটিনাটি সকল কিছু হাসিবের জানা চাই, যা আলপনাকে মাঝে মাঝে বিরক্তিকর অবস্থায় ফেলে দেয়। অতিষ্ট হয়ে তখন সব কিছু ছেড়েছুড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে বহু দূরে। এটা কি সত্যই ভালবাসার জন্যে , নাকি অন্য কোন কিছু? আলপনা ঠিক বুঝতে পারে না। যদিও মাঝে মধ্যে কি যে হয় আলপনার , সে নিজেও বুঝে না কেমন এক অস্থিরতা ঝেকে বসে।

তখন আর কোন কিছুই ভালো লাগে না। চির পরিচিত মানুষগুলোকে বড়ই অপরিচিত মনে হয়। এক আলো আধাঁরিতে দুলতে দুলতে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে কোন এক খোলা প্রান্তরে। আকাশের নীচে শুঁয়ে বুকভরা নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শূণ্যে ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে । ইচ্ছে করে ভার মুক্ত হই সকল জঞ্জাল থেকে।

অকারন এই যন্ত্রণাগুলো মাঝে মাঝে আলপনাকে পাগল করে তোলে। এই পাগলামীর পরিনতিতে শেষ পর্যন্ত হাসিবের বুকেই এসে আছড়ে পড়তে হয়, আর বুকের গভীর উষ্ণতায় ডুব দিয়ে জীবন আনন্দে আবার মেতে উঠা , জেগে উঠা পূর্ণ উদ্যমতায়। তারপরেও কেমন এক একাকিত্ব পেয়ে বসে মাঝে মাঝে ! এই একাকিত্ব দংশন করতে থাকে প্রতিটা মুহুর্ত। যেমনটা হচ্ছে গত দুদিন ধরে। তবে আজ এখন মনটা বেশ ফুরফুরা।

কানাডায় মানুষের মনের মতি গতি অনেকটা আবহাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলে। ঝরঝরা এমন আবহাওয়ায় মনটা শুধু উদাস হতে চায় । কিছু একটা করার জন্য মনটা উসখুস করতে থাকে ! এই মুহুর্তে হাসিবকে নিয়ে ভাবতে ভীষন ভালো লাগছে। কাছে পেতে ইচ্ছে করছে ভীষন। বাইরের মৃদু মন্দ হাওয়া ব্যালকনিতে খেলার ছলে জানালার পর্দা গলে ঢুকে পরছে ঘরের চৌহদ্দিতে।

ঝিরি ঝিরি বাতাসের শীতল আমজে আলপনার মনে আবেগি দ্যোতনায় ধ্রুপদীর সুর খেলে যায়। রোদেলা দুপুর গড়িয়ে সূর্যটা যখন বিকেলের বুকে ঢলে পড়লো তখন ঘড়ির কাটা বিকেল পাঁচটা ছুঁই ছুঁই করছে। সব কাজ কম্ম শেষ ৬ করে তড়িৎ গতিতে সাওয়ার নিয়ে শুভ্র বসনে ভিজা এলো চুল পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে বিস্মিল্লাহর সানাই এর সুর ছেড়ে দিলো মৃদু লয়ে্ আর অপেক্ষা করতে লাগলো হাসিবের জন্য। হাসিব অফিস থেকে বের হওয়ার মুখেই দেখতে পেলো কমলকে। বেশ অনেকদিন পর কমলের আবির্ভাবে হাসিব উৎফুল্ল হয়ে বললো–তুই এখানে, কি ব্যাপার ! -এ পথ দেয়েই যাচ্ছিলাম , তাই ভাবলাম তোকে একটু দেখে যাই।

-ভালো করেছিস, হাতে সময় থাকলে বা কোন কাজ না থাকলে চল বাসায় যাই। বোধ হয় ভালো মন্দ কিছু রান্নাবান্না আছে। কারন আলপনা আজ বাসায়। -তা যাওয়া যেতে পারে। -চল।

বলেই হাসিব কমলের গাড়ীতে গিয়ে উঠে বসল। হাসিব সাধারানত গাড়ী ড্রাইভ করে না। ডাউনটাউনে পার্কিং এর ভীষন ঝামেলা, এই বিরক্তিকর ঝামেলাটা এড়ানোর জন্যই হাসিব সাবওয়েতে অফিসে যাওয়া আসা করে। কলিংবেল বাজামাত্রই দরজাটা খুলেই আলপনা দরজার অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ প্রকৃতির সৌম্য সাজে আলপনাকে দেখে হাসিবের চোখে এক প্রশান্তির ঢেউ খেলে যায়।

নির্মল এক হাসির রেখা ঠোঁটের কোণে এনে জিজ্ঞেস করলো—কি ব্যাপার ! আলপনাও তেমনিতে সলাজ ভঙ্গীতে বলল---না কিছু না। এমনিতে। হাসিবের পিছনে কমলকে দেখে আলপনার বুকের ভিতর আনন্দের ফোয়ারাটা হঠাৎ করে থমকে গেলো। একা নিভৃতে থাকার প্লানটা বুঝি ভেস্তে গেলো। ঘরের ভিতর প্রবেশ করতে করতে কমল একটু হোচট খেলো ।

এ যেন অন্য জগতে প্রবেশ করছে। সবকিছুতে কাব্যময়তার ছড়াছড়ি । বিসমিল্লাহের সানাই এ কেমন মন্ত্রমুগ্ধতার আবেশ। তার উপর আলপনার শুভ্র সৌম্য সাজ যেন সাক্ষাত প্রতিমা। অনেক পরে জিজ্ঞেস করলো—কেমন আছেন আপনি? --ভালো, আসুন, বসুন।

বলেই বসার রুমটা দেখিয়ে দিল আলপনা। খাবারের সুগন্ধ হাসিবের নাকে এসে বাড়ি লাগলো। কি ব্যাপার , কি রান্না করেছে আলপনা! ভাবতে ভাবতে চলে গেলো কিচেনে। খুশীর এক অস্পষ্ট স্বরধ্বণি শুনতে পেলো আলপনা। ---ওয়াও ! ইলিশ পোলাও ! আনন্দে আত্মহারা হয়ে আলপনাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও ধরলো না কারন পাশের রুমে বসে আছে কমল।

এই হলো আলপনা যাকে ইচ্ছেমত আঁকা যায় , যেভাবেই আঁকুক না কেন, আলপনা, আলপনাই থেকে যায় হাসিবের একান্ত নিজ ভূবনে। যদিও মাঝে মধ্যে আলপনাকে খুঁজে পাওয়া যায় না, কোথায় যে ছুটে চলে আলপনার মন, সেটা বুঝা বড়ই মুশকিল। তারপরেও আলপনাকে যখন খুব নিজের করে পায় তখন পৃথিবীর সব আনন্দ যেন উপচে পড়ে। ডাইনিং টেবিলে রসনা বিলাসের সমাহার দেখে কমলের চক্ষু চড়ক। সব সৌন্দর্য্যের রসধা যেন উপচে পড়ছে অপরপ্রান্তে বসা আলপনার উপস্থিতিতে।

মনে মনে ভাবলো কমল, হাসিব বেশ আছে । খেতে খেতে এক সময় কমল আলপনার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো—বীচে অঞ্জনের সাথে আপনার দেখা হয়েছিলো, তাই না? আলপনা নিষ্প্রভ নির্লিপ্ত উত্তর দিলো—হ্যাঁ দেখা হয়েছিলো। হাসিব বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো---বীচে! কখন গেলে ! --কাল অফিস থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। যেখানটায় আমরা সব সময় বসি। সেই জায়গায়টায়।

-তো অঞ্জনকে কোথায় পেলে ? -উনি ওখানেই ছিলেন। আমাকে দেখে পিছু নিলো। -ও...আর কোন কথা না বাড়িয়ে হাসিব চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলো। হাসিবের প্রশ্নের পর প্রশ্ন করা দেখে আলপনা একটু অপ্রস্তুত হয়ে উঠছিলো, আবার কিছুটা বিব্রত বোধও করছিলো। বিষয়টা স্বাভাবিক মনে হলো না আলপনার কাছে।

এ যেন অন্যরকম মানুষ!এরকম পালটা প্রশ্নপ্রশ্নিটা ঠিক যেন তার স্বভাবের সাথে যাচ্ছে না ! সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকারের ছাঁয়া যখন নেমে এলো তখন কমল বিদায় নিলো। কমল চলে যাওয়াতে আলপনা একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলো । কমলের উপস্থিতি কেনো জানি আলপনা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছিল না। অযাচিত কোন মানুষকে আর ভালো লাগে না। শুধু শুধু কারন ছাড়া কোন মানুষের আগমন নির্গমন বিরক্তির উদ্রেক ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না।

আজকাল সব কিছুতে আলপনা অর্থ খুঁজে বেড়ায় । গঠনমূলক কোন কিছু আছে কিনা তার সূত্র হাতরিয়ে বেড়ানো একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু হাসিবের কি হলো? হাসিবকে এমন লাগছে কেন? একটু অন্যরকম, অপরিচিত, অস্বাভাবিক লাগছে। জগদ্দল এক প্রস্তর খন্ডের মত ঠায় পড়ে আছে। এমন রূপতো কখনো আলপনা দেখেনি !কি হয়েছে হাসিবের ? হাজারো প্রশ্নের ভিড় মগজে কিলবিল করছে।

ভিতরে ভিতরে আলপনা ভড়কে গেলেও নিজেকে আবার সামাল দিয়ে উঠছে। এক সময় হাসিবের খুব কাছে এসে বললো, আমি তোমার পাশে একটূ বসবো। হাসিব চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে বললো কি ব্যাপার ? বসবেতো, এভাবে বলছো কেন? আলপনা কাচুমাচু খেয়ে হাসিবের পাশে বসতে বসতে বললো—নাহ , তুমি কেমন চুপচাপ আছোতো, বুঝতে ঠিক পারছি না। কিছু নিয়ে কি খুব ভাবছো? খুব কাছে ঘেষতে ঘেষতে আবারো বললো,--কি হয়েছে তোমার? হাসিব একরকম অবহেলার ভঙ্গিতে গম্ভীর কন্ঠে বললো, না , কোন কিছু নিয়ে ভাবছি না, আর আমার কোন কিছু হয়নি। চুপচাপ পাশাপাশি দুজন বসে থাকলো আর ভাবনার জগতে দুজন দুভিন্ন মাত্রায় দুই পথে হারিয়ে গেলো।

সরল গতিতে জীবন গড়াচ্ছে ঠিকই তবে কোথায় যেন একটা কঠিন জটিলতা সৃষ্টী হচ্ছে। সেই জটিলতার আবর্তে আজ হাসিব আর আলপনার সংসার জীবনে কালো মেঘের ঘনঘটা। কাল বৈশাখীর তান্ডব নৃত্য করছে হাসিবের মগজে। আলপনাকে পাগলের মত ভালোবেসে বিয়ে করেছিল হাসিব। জীবনের সর্বস্বটুকু দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে প্রতিনিয়ত ।

হাসিব আজ পর্যন্ত আলপনাকে বুঝে উঠতে পারেনি। মাঝে মাঝে আবার অনেক কিছু না চাইতেই পেয়ে যায় আলপনার কাছ থেকে । অনেকটা অবচেতন মনে কেমন করে বুঝে ফেলে হাসিবের চাওয়া পাওয়ার দিকগুলো। যেমনটি আজ খাবারের আয়োজনটা একদম হাসিবের মনের মত ছিল যদিও হাসিব আগে ভাগে কোন কিছুই বলেনি। তখন হাসিব নতুন করে আলপনাকে নিয়ে ভাবতে বসে।

ভরিয়ে দিতে চায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভালোবাসা দিয়ে। কিন্তু অসহনীয় সমস্যা যেটা হাসিবকে তিলে তিলে নিঃশ্বেষ করে দিচ্ছে তাহলো আলপনার হঠাৎ হঠাৎ বেহিসেবী মন খারাপের বিষয়টা যা প্রতিটাক্ষণ ব্যাতিব্যাস্ত করে তুলছে। বেশ কয়েকবার আলপনা বাসা ছেড়ে চলেও গিয়েছিলো। কোথাও খুঁজে না পেয়ে পাগলপ্রায় হাসিব পুলিশকে ইনফরম করে। শেষ পর্যন্ত খুঁজে পায় বীচে পানির পাশে ঠিক সেই পাথর খন্ডের উপর বসা অবস্থায়।

তবে কী আলপনা সুখী নয় হাসিবকে নিয়ে? আর কত , কিভাবে হাসিব আলপনার ছন্নছাড়া পাগলামীগুলো আগলে নিয়ে বয়ে বেড়াবে ! প্রায় একটা যুগ এত কাছাকাছি থেকেও আজ মনে হচ্ছে হাসিবের, আলপনা তার নয় ! তাহলে আলপনা কি নিয়ে এত ভাবে? ও কি অন্য কাউকে ভালোবাসে? যদি তা না হয় , তবে হঠাৎ হঠাৎ আলপনা এত দূরে সরে যায় কেন? গত দুদিন আলপনাকে ছুঁতে গিয়েও ছুঁতে পারেনি। কোথায় যেন একটা বাঁধা! এ কিসের বাঁধা? হাসিব নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করে। আলপনার ব্যাক্তিত্বে একধরনের সম্মোহন শক্তি আছে। যা অতি সহজেই মানুষকে আকর্ষন করে। ছোট, বড়, নারী, পুরুষ সবার কাছে, কি ভালোবাসায়, কি আদরে , কি ভক্তি, কি শ্রদ্ধ্যায় সব অবস্থায় সমানভাবে সমাদৃত এই আলপনা।

যেখানে যায় সেখানেই অল্প সময়ের মধ্যে মধ্যমনি হয়ে উঠে । তার নির্মল হাসির বর্ণছটায় প্রকৃতিও যেন হেসে উঠে আর মৃদুলয়ের কন্ঠস্বরে অনুরণিত হয় বসন্তের মাদকতা। আলপনার বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের চাইতে বুদ্ধিমত্তার স্বতুঃস্ফূর্ততার আলো মানুষকে আকর্ষন করে অতি দ্রুততার সাথে। চলনে বলনে আভিজাত্যের অবয়বে ফুঁটে উঠে তার ব্যাক্তিত্ব। আলপনার নান্দনিক চরিত্রের বহির্প্রকাশে অনেকের কাছে হয়ে উঠে শিল্পিত নির্যাসের কল্পনারী।

যা দিয়ে হতে পারে কবির কবিতা, হতে পারে শিল্পির রঙের আচঁড়ে এক বিমূর্ত শৈল্পিক চিত্র , হতে পারে তাবৎ সৃষ্টির শৈল্পিক অনুষঙ্গ। যারফলে অনেকেই কথা বলতে যত না ব্যতিব্যাস্ত থাকে তারচেয়ে বেশী আগ্রহ থাকে আলপনার সঙ্গ পাওয়ার। সেখানে শুধু মনোস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষনের মাধ্যমে তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলো জানার আগ্রহই প্রাধান্য পায় বেশী। যাদের মধ্যে হাসিবের কিছু কবি বন্ধুদের পাগলামীও কোন অংশে কম ছিল না। এই মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহের কারনে হাসিবের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক হয়।

আর সেই সাথে বুঝতে চেষ্টা করে আলপনার মানসিক অবস্থা। যার কারনে হাসিবকে প্রতিটা মুহুর্ত আলপনার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে থাকতে হয়। মনের ভিতর এক ধরনের ভয়েরও সঞ্চার হয়। যদি কখনো আলপনাকে হারাতে হয়? হাসিবের পক্ষে কখনো কোন অবস্থায় আলপনাকে হারানো সম্ভব নয়। শুধু একমাত্র মৃত্যুই তাকে ছিনিয়ে নিতে পারে হাসিবের কাছ থেকে।

এই হবে ভবিতব্যের সমাধান। কিন্তু আজ হাসিবের মাথায় সন্দেহের বিষক্রিয়া হচ্ছে চূড়ান্তভাবে। যেন সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। গত সন্ধ্যায় বাসা ফিরাটা আজ আর স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। অঞ্জন ওখানে কেন ছিল? কেন এ কথা আলপনা হাসিবের কাছে গোপন করলো? উহ, আর ভাবতে পারছে না ।

এভাবে জীবন চলতে পারে না। জীবনের একটা অর্থ থাকা উচিৎ। এ কেমন জীবন সারাক্ষণ আলপনাকে নিয়ে ব্যাপৃত! যার মূল্যায়নের কোন ব্যাখ্যা নেই। এসব স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা করতে যাওয়া মানে নিজের কাছে নিজে ছোট হওয়া বা অন্যের কাছে হাসির পাত্র হওয়া। এই বিষয়টা মাথায় রেখেই হাসিব ধীরে সুস্থ্যে, ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করেছে।

যার অনেকটা আলপনা বুঝে আবার বুঝেও না। প্রকৃতির সমস্ত সরলতা আলপনার মাঝে বিরাজমান। সহজ সরল যোগ বিয়োগে জীবনের অংক কষে ফেলে। যেমনটি এখন বুঝতে পারছে না হাসিবকে । আলপনার সারাদিন ধরে সাজানো স্বপ্নগুলো একটু একটু করে চূর্ণ হতে শুরু করে।

হাসিবের এমন কঠিন ভীতিরূপ আলপনার মধ্যে আতঙ্কের ঝঙ্কার তোলে। পুরো সন্ধ্যা গড়িয়ে গভীর রাতের অন্ধকার নেমে এলো চারিদিকে। দুজনের মধ্যে কোন টুশব্দটি নেই। পিনপতন নীরবতার মধ্যে কখন যে এত রাত হয়ে গেলো দুজনের কেউই তা টের পায়নি। এক সময় হাসিব উঠে বেডরুমে চলে গেলো।

আলপনাও তার পিছু নিলো । খাটে পাশাপাশি দুজনে শুঁয়ে পড়লো। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সারাদিনের ক্লান্তিতে আলপনার চোখ বুজে এলো। কিন্তু হাসিব চোখের পাতা এক করতে পারলো না। এ কী ধরনের অস্থিরতা হাসিবকে পাগল করে তুলছে? পাশ ফিরে দেখে আলপনা অঘোরে ঘুম।

সত্য ভালোবাসার অপর পৃষ্ঠে থাকে সন্দেহ, হিংসা, হীনমন্যতা; এসবের বিষকৃয়ায় ভালোবাসা হতে থাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ। এমনই মানসিকতায় বিদ্ধ হাসিব। কেন আলপনাকে আর সহ্য হচ্ছে না ? কেন ইচ্ছে করছে পৃথিবীটাকে ভেঙ্গে চূড়ে চূড়মাড় করতে ! এ কেমন আদিমতা হাসিবকে পেয়ে বসে! সে কী বিচ্ছেদের, ক্ষুধার নাকি মৃত্যুর ? ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। উন্মত্ততার নেশায় হাসিব কিছু একটা হাতের কাছে হাতরিয়ে বেড়ায়! ভঙ্গুর জীবন, শ্বাস প্রশ্বাসে ব্যর্থতার গ্লানি, তাপে অনুতাপে অস্থির চিত্ত ! জিঘাংসার এক দুর্মর নেশা পেয়ে বসে আজ হাসিবকে। হঠাৎ করে আলপনা কেঁপে উঠে।

আচমকা নিঃশ্বাস আটকে আসছে কেন? মনে হয় পুরো পৃথিবীর ভার আলপনার উপরে এসে পড়ছে। পাহাড় সমান কিছু একটা বুকের উপর চেপে আছে। রাতের সমস্ত অন্ধকার আলপনাকে গ্রাস করছে ক্রমে এবং ক্রমে। নিঃশ্বাসের উঠানামায় কেঁপে উঠছে প্রকৃতি। তলিয়ে যাচ্ছে শূন্য থেকে শূন্যের গহবরে।

ক্ষীণকন্ঠ, অনুর্ধ্বদৃষ্টীর চক্ষু যেন ঈশ্বরকে খুঁজছে। কোন ঈশ্বরের খোঁজে আলপনা এখন শূন্যে ভাসছে? পরের দিন সকাল; প্রকৃতির নিয়মে ভোর হলো ঠিকই তবে পৃথিবীটা আজ অন্যরকম। চারিদিকে এখন শান্ত, নিথর, নিস্তব্ধতা। গম্ভীর করুন বন্দনায় কেঁপে উঠে স্তম্ভিত আকাশ। স্তব্ধ পৃথিবী অক্লান্ত সুরে নিগূঢ় নির্মম মন্ত্রের শেষ শ্লোক বাজায় একাকী উৎসাহে... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।