তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা আমার মূল লেখাটি এখানে পাবেন
এ পৃথিবীর সবকিছু এবং চলমান সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহ পাকের সৃষ্টি। এসবের মধ্যে বাছাই করে তিনি নির্দিষ্ট স্থান এবং কিছু সময়কে সম্মানিত করেছেন। সময়ের পরিক্রমা উল্লেখ করতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক যে চারটি মাসকে সম্মানিত বলে আখ্যায়িত করেছেন, মুহাররম মাস সেসবের অন্যতম। আরবি পরিভাষায় এ মাসকে আল্লাহর মাস বা শাহরুল্লাহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ইসলামের অনেক আগে থেকেই এ মাস আল্লাহ পাকের কাছে অতি সম্মানিত এবং ফজিলতপূর্ণ।
হাদীসের প্রায় সব কিতাবে মুহাররম মাসের ফজিলত এবং এ মাসের ১০ তারিখ আশুরার রোজা সম্পর্কে রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত একাধিক হাদীস রয়েছে।
পবিত্র কুরআনের সূরা তওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক চারটি মাসকে সম্মানিত উল্লেখ করে এ মাসগুলোতে পরস্পর অন্যায় ও অবিচার থেকে বিরত থাকতে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামপূর্ব যুগেও এ মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে মানুষ বিরত থাকতো। রাসূল (সা.) বলেছেন, রমজানের রোজার পর মুহাররম মাসের রোজা আল্লাহ পাকের কাছে সবচেয়ে বেশি ফজিলতময়। (মুসলিম/হাদীস নং- ১৯৮২)
মক্কায় থাকাকালে রাসূল (সা.) নিজে এ আশুরার দিন রোজা রাখতেন তবে তা পালনে কাউকে আদেশ করেননি তিনি।
মদীনায় হিজরতের পর যখন তিনি ইহুদীদের এ মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখতে দেখলেন, তখন তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। ইহুদীরা জানালো, এ মাসের ১০ তারিখে আল্লাহ পাক মূসা আলাইহিসসালামকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এ তারিখেই ফেরাউন ডুবে মরেছিল। হযরত মূসা নবী এ দিনটিতে রোজা রাখতেন। রাসূল (সা.) তখন বললেন, আমরাও মূসা নবী আলাইহিসসালামের অনুসরণ করবো।
তোমাদের চেয়ে আমাদের অধিকার বরং বেশি। তিনি তখন থেকে মুহাররমের ১০ তারিখ রোজা রাখা শুরু করলেন এবং সবাইকে নির্দেশ দিলেন। (বুখারী/হাদীস নং- ১৮৬৫) সুতরাং মদীনায় হিজরতের পর তার এ আদেশের কারণে আশুরার রোজা সবার জন্য ওয়াজিব হিসেবে গণ্য হতো।
কিন্তু যখন রমজান মাসের রোজার হুকুম নাজিল হলো, তখন আশুরার রোজার হুকুম ওয়াজিব থেকে সুন্নতের পর্যায়ে নেমে এলো। (আরও বিস্তারিত জানতে- মুসলিম শরীফ/হাদীস নং- ১১২৫) রাসূল (সা.) তখন বললেন, যে চায় সে রোজা রাখতে পারে এবং যে চায় না, সে না রাখলেও ক্ষতি নেই।
(বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, দারেমী, বায়হাকী)
রাসূল (সা.) বলেছেন, এ আশুরার দিন (এ বছর আগামী ২৫ নভেম্বর) রোজা রাখার কারণে আল্লাহ পাক বান্দার বিগত এক বছরের গোনাহসমূহ মাফ করে দেন। (মুসলিম/ হাদীস নং- ১১৬২) মুসলিম শরীফের বর্ণনায় জানা যায়, ইন্তেকালের আগের বছর রাসূল (সা.) ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি তবে নয় তারিখেও রোযা রাখবো। এজন্যই আশুরার রোজার সঙ্গে এর আগের দিন রোজা রাখাকে মুস্তাহাব বলেছেন উলামায়ে কেরাম।
প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ হাফেজ ইবনে হাজার হযরত ইবনে আব্বাসের বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, যাতে রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখো। তবে এতে যেন ইহুদীদের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হয়ে যায় সেজন্য এর সঙ্গে মিলিয়ে হয় আগের দিন কিংবা পরের দিনসহ রোজা পালন করো।
মুহাররম এবং আশুরা সম্পর্কে কিছু বিষয় স্পষ্টভাবে জানা থাকা প্রয়োজন-আশুরার দিন ছাড়াও পুরা মুহাররম মাস আল্লাহ পাকের কাছে সম্মানিত এবং ফজিলতপূর্ণ। রমজান মাস ছাড়া অন্যান্য মাসের চেয়ে এ মাসের নেক কাজে বেশি সওয়াব এবং অন্য মাসের চেয়ে এ মাসে কৃত অপরাধের শাস্তিও বেশি।
আশুরার দিন ইসলামের পূর্বযুগ থেকেই মহিমান্বিত দিন। রাসূল (সা.) এর প্রিয়তম দৌহিত্র হোসাইন (রা.) এর শাহাদাতের ঘটান নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক। তবে কারবালার এ ঘটনার সঙ্গে আশুরার ফজিলতের কোনো সম্পর্ক নেই।
কেউ যদি শুধু মুহাররম মাসের ১০ তারিখ রোযা রাখেন এবং এর আগে বা পরে একটি রোজা যোগ না করেন, তবে তা মাকরুহ নয়, বরং এতে মুস্তাহাব বিঘ্নিত হবে। কিন্তু প্রকৃত সুন্নত হলো আগের ৯ মুহাররম (এবার ২৪ নভেম্বর) বা পরের দিনের সঙ্গে ১১ মুহাররম (২৬ নভেম্বর) মিলিয়ে মোট ২দিন রোজা রাখা। যে এ আশুরার দিন রোজা রাখতে পারলো না, তার জন্য কোনো সমস্যা কিংবা আশাহত হওয়ার কিছু নেই। যদি কেউ ৯, ১০ এবং ১১ তারিখ মোট ৩ দিন রোজা রাখেন তবে তা সর্বোত্তম হিসেবে গণ্য হবে। ইমাম ইবনুল কাইয়িম এ মত উল্লেখ করেছেন।
আর আশুরার রোজার ফজিলতে যে এক বছরের গুনাহ মাফ করার সুসংবাদ রয়েছে, তা সগিরা গুনাহসমূহের জন্য প্রযোজ্য। কারণ অন্য এক হাদীসে রয়েছে, কবিরা গুনাহ এর আওতায় নয়। বরং কবিরা গুনাহ কখনোই তওবা ছাড়া মাফ হওয়ার নয়। ইমাম নববী এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়াসহ প্রখ্যাত সব হাদীস বিশারদগণ এ মত ব্যক্ত করেছেন।
মুহাররমের ১০ তারিখে কিয়ামত হওয়ার যে কথা সমাজে প্রচলিত, এর কোনো ভিত্তি নেই।
কুরআন এবং হাদীসের কোথাও এমন বিবরণ তো দূরের কথা, সামান্য ইঙ্গিতও নেই।
আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সবগুলোর সারকথা, এ রোজা আমাদের জন্য বিগত বছরের সগীরা গুনাহসমূহ মাফ করার এক সুবর্ণ সুযোগ। এর পাশাপাশি মুহাররম মাস জুড়ে সম্ভব হলে নফল রোজা এবং সাধ্যমত ইবাদতে লিপ্ত থাকা প্রকৃত মুমিনের কাজ। মুহাররম এবং আশুরার প্রকৃত ইতিহাস ও ফজিলত ভুলে গিয়ে শুধুই কারবালার শোকে মাতম হওয়া কাম্য নয়।
বরং আশুরার দিন রোজার পাশাপাশি রাসূল (সা.) এবং তার পরিবারের জন্য আমরা বেশি করে দরুদ পাঠ করতে পারি। তাঁর পরিবারের জীবন ও আদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করতে পারি। এতেই আমাদের প্রকৃত কল্যাণ রয়েছে।
প্রিয় পাঠক, ইসলাম কখনোই লৌকিকতা এবং নিজের ক্ষতি করাকে সমর্থন করেনি। মুহাররম মাসকে কেন্দ্র করে যে কোনো উৎসব কিংবা শোক মিছিল করা কতোটা যৌক্তিক তা হাদীস-কোরানের আলোকে ভেবে দেখার বিষয়।
নবীযুগ তো বটেই, সাহাবী এবং তাদের পরবর্তী যুগেও এসব নিয়ে আজকের মতো বাহারি আয়োজনে কেউ লিপ্ত হয়নি। তাই এসবের জোয়ারে নিজেকে ভাসিয়ে না দিয়ে আল্লাহ এবং তার রাসূলের (সা.) নির্দেশিত সহজ সরল পথে অবিচল টিকে থাকার নাম সিরাতুল মুসতাকিমের অটলতা।
আশুরার এ দিনে আল্লাহ প্রবল অহংকারী ফেরাউনকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছেন এবং তার নবী মূসা আলাইহিস সালামকে বনী ইসরাঈলসহ মুক্তি দিয়েছিলেন অত্যাচারের কবল থেকে। এতেই প্রমাণিত হয়, অন্যায় ও জুলুমের পরিণতি কখনো শুভ হতে পারেনা। যে কোনো সমস্যা ও বিপদে কখনো হতাশ কিংবা নিরাশা নয়, এক আল্লাহ পাকের অসীম শক্তি ও সাহায্যের ওপর পূর্ণ আস্থা আমাদের একমাত্র সম্বল।
মহান শক্তিমান আল্লাহ পাকের সাহায্য দূর্বলদের সঙ্গে এবং বিজয় আমাদের আসবেই। আজকের দুর্দশাগ্রস্ত মুসলিম বিশ্বের জন্য আশুরার এটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।