আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি । শুরুর কথা

রাস্তায় খুঁজে ফিরি সস্তায় ঘুরে ঘুরে এক কাপ চা ‘‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি একটি ভিন্ন ধরণের সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অনেক নেতা-কর্মী এতে যুক্ত থাকার পরও এটা কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন নয়। এটা একটা আন্দোলন। ’’-জাহানারা ইমাম তিন বাক্যে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি সম্পর্কে জাহানারা ইমামের মূল্যায়ন। জাহানারা ইমাম উল্লেখ করেছেন ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’।

শিরোনামে লিখেছি ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’। মূলত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্র প্রতিরোধ মঞ্চ’ ও ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ দুটি আলাদা সংঘঠন। এই দুইটি নির্দলীয় সংঘঠনের সমন্বয়ে ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র সুত্রপাত। সময়ের সাথে আন্দোলনে যুক্ত হয় মুক্তিযোদ্ধা,রাজনৈতিক দল,সাংস্কৃতিক,শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-নারী ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সংঘঠন। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ যারা একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার চায়।

শুরুতে জাহানারা ইমামের প্রয়োজনবোধ করেছিলেন ঐক্যের। এই ঐক্য দেশের সর্বস্তরের মানুষের আর আন্দোলন সংগ্রামের সকল সংঘঠনের একতা। বিরানব্বইের জানুয়ারি থেকে গড়ে এই আন্দোলন। কার্যক্রমের ধরণ হল বিবৃতি,অজস্র বৈঠক,শত মিছিল,অনেক জনসভা,গণ আদালত,ছোটখাটো সংঘর্ষ ও হরতাল। একাত্তরের ঘাতক গোলাম আজমকে যখন জামায়াতে ইসলামী দলের আমীর ঘোষণা করে তখন জাহানারা ইমাম দেশে ছিলেন না।

যুক্তরাষ্ট্রে তিনি গিয়েছিলেন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য। জাহানারা ইমাম দেশে ফিরেন বিরানব্বই এর জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখে। তার অনুপস্থিতিতে বাসায় তার জন্য কোন না কোন একটি দৈনিক পত্রিকা রাখা হত। অনেকদিনের জমে থাকা পত্রিকা গুলো পড়তে পড়তে হটাৎ একটি খবর জাহানারা ইমামের নজর কাড়ল। জামায়াতে ইসলামী গোলাম আজমকে দলীয় আমীর ঘোষণা করেছে।

২৯শে ডিসেম্বর এই ঘাতককে আমীর ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় এর প্রতিবাদের সভা,সমাবেশ,মিছিল হয়েছিল। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সংঘঠন ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদ বিবৃতিও দিয়েছিল এই ঘটনার নিন্দায়। জাহানারা ইমামের ভাষায়, ‘‘সবকিছু দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। বিচলিত বোধ করলাম। ক্ষুব্ধ হলাম।

’’ একাত্তরে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে গোলাম আজম ও জামায়াতে ইসলামের পাকিস্তানিদের সমর্থন,গনহত্যায় সহযোগিতা,লুটতরাজ,ধ্বংসযজ্ঞ,অগ্নিসংযোগ,নির্যাতন-ধর্ষনের কথা জাহানারা কখনো ভুলেননি,সবসময় চেয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। অতীতেও তিনি অনেকের সাথে কথা বলেছিলেন,চেয়েছিলেন আন্দোলন করতে। সোচ্চার ছিলেন ঘাতক,দালাল,রাজাকার,আলবদর,আলশামস,গোলাম আজম,জামায়াত-শিবিরসহ সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে। জাহানারা ইমামের ভাষ্য, ‘‘আমার মধ্যে এই ঘৃণিত শত্রুদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল,ব্যাথা,যন্ত্রণা ছিল। এখনো আছে।

’’ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলো তখন বহুবিধ প্রশ্নে ও বিতর্কে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে একতা ছিল অলীক স্বপ্ন। কয়েক বছর আগেও দেশে ছিল সামরিক দুঃশাসন। জেনারেল এরশাদের শেষদিকে তার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রাম ছিল মুক্তিযুদ্ধের শক্তির ঐক্য গড়ার সুযোগ। রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি তখন ঐক্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

কারন হিসেবে জাহানারা ইমাম বলেছিলেন, ‘‘পেছনে পেছনে একপা-দু’পা করে সামনে আসছিল জামায়াত-শিবির ঘাতক চক্র-অনেকের অগোচরে,অনেকের পশ্রয়ে। ’’ স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর টেলিভিশনের পর্দায় তিনি অন্য স্বৈরাচারকে দেখতে পেলেন। তার মতে, ‘‘ধর্মীয় স্বৈরাচারী জামাতের নেতা ঘাতক আব্বাস আলী খানের চেহারাও ভেসে উঠল খালেদা জিয়া,শেখ হাসিনা,রাশেদ খান মেননের পাশাপাশি। বিচিত্র সব ঘটনা! সংসদ নির্বাচনে তারা আঠারটি আসনে নির্বাচিত হলো। দেশের সাধারণ মানুষের সামনে জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য ছিলনা।

আমরা নতুন প্রজন্মের মানুষদের এই অপশক্তির বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলতে পারি নি। এই অপরাধের দায়িত্ব থেকে আমরা কেউ ক্ষমা পাব না। ’’ জাহানারা ইমাম রুমির মুক্তিযুদ্ধ সাথীদের সাথে একুশ বছর যোগাযোগ রেখেছিলেন এবং তারাও তার সাথে সব সময় সম্পর্ক রেখে আসছিল। তিনি তাঁদের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করলেন। তাঁরা জাহানারা ইমামকে আশ্বস্ত করল সাথে কিছু উদ্যোগের কথা জানালো।

স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে যোগাযোগ হল কর্ণেল কাজী নূরুজ্জামান,শাহরিয়ার কবির,ফতেহ আলী চৌধুরী,মিজান,মুনির সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে যারা ভোলেনি মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো,দুঃসময় আর ঘাতক-দালালদের কথা। ৯ জানুয়ারি প্রথম বৈঠক অনুষ্টিত হয় কর্ণেল নূরুজ্জামানের বাসায়। অনেক আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় কিছু কাজে হাত দেয়ার। তারপর ১১ জানুয়ারি কর্ণেল নূরুজ্জামান আসেন জাহানারা ইমামের বাসায়। তিনিই বেগম সুফিয়া কামালকে আহবায়ক করে একটি কমিঠি গঠনের চিন্তা উপস্থাপন করেন।

ঐসময়কার কথা স্মরণে জাহানারা বলেছিলেন, ‘‘আমরা অতীতেও ‘ফ্যাসিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী কমিটি’ করেছি,জনসভা করেছি,বক্তব্য রেখেছি,মিছিলও করেছি। কাজেই এটা বুঝছিলাম আমাদের প্রাথমিক কাজটি হবে একটি সংগঠন গড়ে তোলা। ’’ দুইদিন পর ১৩ জানুয়ারি তাঁরা বেগম সুফিয়া কামালের কাছে যান। সুফিয়া কামালকে আহবায়ক করে একটি কমিটি গঠনের চিন্তার কথা তাঁকে জানান। সব শুনে সুফিয়া কামাল বললেন, ‘‘আমার শরীর খুব খারাফ।

আমিতো চলাফেরা ভালোভাবে করতে পারি না। আমি সমর্থন করবো,সহযোগিতা করবো। আপনারা জাহানারাকে আহবায়ক করে কমিটি করুন। ’’ সেদিন সবাই তাঁকে অনেক জোরাজুরি করল,বোঝাতে চাইছিলো তার প্রয়োজনীয়তার কথা। কিন্তু সুফিয়া কামাল জানালেন শারীরিক কারনেই তিনি পারবেন না।

তিনি আবার বললেন, ‘‘জাহানারা আমার সঙ্গে মহিলা পরিষদে কাজকর্ম করে, ওর স্বাস্থ্য আমার চেয়ে ভালো,ও শক্ত আছে,কাজেই ও-ই হোক। ’’ মহিলা পরিষদের মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুই নেত্রীঃ বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমাম চলবে... ... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।