আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অন্ধকারের ফেরেশতা।

ডান হাতটা প্রসারিত করতেই একটা নিথর শীতল হাতের স্পর্শ লাগে লুবনার হাতে। ভালোভাবে ধরে দেখে। পুরুষালি হাত। হাত আরও প্রসারিত করে নিথর হাতটা ধরে বুকের দিকে যায়। বুকপকেটে হাত ঢুকায়।

কয়েকটা কাগজের মত জিনিস পায়। নাকে ধরার পর বুঝতে পারে ওগুলো টাকা। টাকার গন্ধ মাত্র দুই রকম হয়। নতুন নোটের আর পুরাতন নোটের গন্ধ। কিন্তু মানুষের শরীরের অনেক রকম গন্ধ।

লুবনা মনে করতে থাকে ওর মায়ের বুকের একরকম গন্ধ, বাবার গলার গন্ধটা আরেক রকম। আতাউররেরটা আরেক রকম। ওর ধারণা ওর ছেলের গায়ের গন্ধটাও আরেকরকম হবে। লুবনা আরেকবার টাকার গন্ধ নেয়। পুরাতন নোট।

হাত ভর্তি রক্ত আর ময়লা তাই নোটটা দিয়ে ডান চোখটা পরিষ্কারের চেষ্টা করে। ও জানে পরিষ্কার করেও এই অন্ধকারে কিছুই দেখতে পারবে না, তবু একটা ক্ষীণ আশা কাজ করে ওর মধ্যে। বিল্ডিংটা ধ্বসে পড়ার পরেও চোখ দু'টো ভালো ছিলো লুবনার। ও তেমন আঘাত পায়নি তখন। দু'টো খুলে আসা ইট লেগেছিলো পিঠে আর নিতম্বে আরেকটা বয়লারের পাইপ লেগেছিলো উরুতে।

এই। অন্ধকারে যখন সবার মৃত্যু যন্ত্রনা শুনছিলো তখন অনেকবার ধন্যবাদ দিয়েছিলো আল্লাহকে। আল্লাহ ছাড়া এমন রহমত পাওয়া সম্ভব না। আশেপাশে যারা ছিলো, আলম, কলি, রুনাপা', মঞ্জুদি', তাদের কেউই বেঁচে নেই অথচ ওর গায়ে তেমন কিছু লাগলোই না। বিল্ডিংটা ভেঙে পড়ার আগে অনেকক্ষণ কেঁপেছিলো।

তখনই ও একটা টুল নিয়ে পেটটাকে সাপোর্ট দিয়ে পশ্চিম দিকে এসে দাঁড়িয়েছিলো। পেটে ওর সাত রাজার ধন। আতাউর একবার বলেছিলো, পশ্চিম দিক হলো আল্লাহ'র দিক। এই দিকে গেলে সূর্যও তার তাপ কমিয়ে দেয়। কথাটা বেশ মনে ধরেছিলো লুবনার।

লোকটা মাতাল হলেও মাঝে মাঝে ওর গ্রামের উত্তর পাড়ার ওসমান পীরের থেকেও মূল্যবান কথা বলে। দেয়ালটা ভেঙেছে পূর্ব পাশে। ওর কোনার পিলারটা না পড়ায় ওর কিছু হয়নি তখন। চেয়ারটাও পেটটাকে বাঁচিয়েছে। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।

কতক্ষণ পরে লুবনা জানে না, হয়তো এক দিন বা তারও বেশি পরে একটা কঙ্ক্রিট ধ্বসে পড়ে। ওটা পড়েছে ওর বাম হাতের উপরে। তখন কয়েকটা ইটের টুকরো এসে চোখে লেগেছে। বাম চোখটা অবশ হয়ে আছে। ঠেতলে গেছে হয়তো।

ডান চোখেও লেগেছিলো। কিছু হয়নি। বাম হাতটা ব্যথাও করছে না আর। অবশ বলেই। লুবনা ওটা ছাড়িয়েও আনতে পারছে না।

একবার ভেবেছিলো ইট দিয়ে হাটটা ভেঙেই ছাড়িয়ে আনবে। সাহসে কুলায়নি। ডান চোখ কঁচলাতে গিয়ে নিজেই কিছু ধুলা ঢুকিয়ে দিয়েছে ও। সেটা পরিষ্কার করতেই পুরানো টাকার নোটগুলো ঘষছে চোখে। চোখটা পরিষ্কার করতেই হবে।

বাচ্চাটাকে একবার দেখতেই হবে। লুবনার বিশ্বাস অন্ধকারেও ও বাচ্চাটাকে দেখতে পাবে। আল্লাহ বাচ্চাটার গা থেকে আলো বের করে হলেও ওকে একবার দেখাবে। এজন্যই আল্লাহ ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। হলঘরটার প্রায় সবটা ভেঙে গেছে।

ভাগ্যক্রমে ও যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো ওই জায়গাটা ভাঙেনি। ওর বদ্ধমূল ধারণা পেটের বাচ্চাটাকে বাঁচাতেই আল্লাহ নিজের হাতে ওই জায়গাটা ধরে রেখেছিলো। পরে লুবনা মেপে দেখেছে, তিন হাত জায়গা। মানুষ মরার পরে সাড়ে তিন হাত জায়গা পায়। ওর চারপাশে যারা মরে পড়ে আছে তারা সাড়ে তিন ইঞ্চি জায়গাও পায়নি।

লুবনা ভাবে, বাচ্চাটা পেটে না থাকলে অবশ্য আল্লাহ ওকে বাঁচাতো না। বাচ্চাটার উছিলায় এযাত্রা বেঁচে গেছে ও। ওর মত পাপী বেনামাজি পাপী বান্দাকে বাঁচিয়ে আল্লাহর লাভটা কী? লুবনা মুখে থুতু আনার চেষ্টা করে। ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কয়েকবার মুখে থুতু আনার চেষ্টা করেছে।

আসে নি। একটু থুতু আসলে ভালো হতো। চোখটা পরিষ্কার করা যেত। টাকাটা দিয়ে চোখ পরিষ্কার হয়নি। উল্টো জ্বালা করছে।

একটা চোখ বেঁচে আছে। বাচ্চাটাকে দেখার আগে এটাকে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে লুবনা। পরক্ষণেই মনে হতে থাকে আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না ও। বাচ্চাটা হওয়ার সময় বেশিরকম ধকল গেছে।

সালোয়ারের নিচে থোকা থোকা জমাটবাঁধা রক্ত দেখে বুঝেছে অনেক রক্তও ঝরেছে। তবে মনে মনে চন্দনা মাসিকে ধন্যবাদ দিতে ভুল হয়না ওর। বকুল ভাইয়ের কথা শুনে ঢাকা আসার আগে তো ও চন্দনা মাসির সাথে কাজ করতো। মাসি বোঝাতো কিভাবে বাচ্চার মাথা ধরে উপরের দিকে টান দিতে হবে, কিভাবে নাড়ি কাটার আগে ব্লেড পুড়িয়ে নিতে হবে। কিভাবে সুতা সেদ্ধ করতে হবে।

চুপচাপ শুনতো আর দেখে যেত লুবনা। ওর ভালো লাগতো না। মেয়েদের বাচ্চা প্রসবে এতটা কষ্ট দেখে একবার চন্দনা মাসিকে বলেছিলো, মাসি, আমি এত কষ্ট সহ্য করতে পারবো না। আমি কোনোদিন বাচ্চা নেব না। মাসি হো হো করে হেসেছিলো।

পান খাওয়া লাল দাতের বিচ্ছিরি হাসি। সেই লুবনা আজ বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সময়ে তেমন যন্ত্রনা পায়নি। মৃত্যু যন্ত্রনা দেখে হয়তো প্রসব যন্ত্রণাটা ভোঁতা হয়ে গেছে। ও ভাবতে চেষ্টা করে তাহলে ওই মেয়েগুলো কি ইচ্ছে করে কাঁদতো? চন্দনা মাসির কাছে শেখা জ্ঞানটা আজ কাজে লাগিয়েছে ও। বাচ্চাটা হওয়ার পরে নিজের দাঁত দিয়ে নাড়ি কেঁটেছে।

ব্রা টা এক হাতে খুলে ওটার ফিতা দিয়ে নাড়ি বেঁধেছে। অন্ধকারেই। চন্দনা মাসি জোর করে কাজ না শেখালে আজ বাচ্চাটা বাঁচতো না। লুবনাও না। চন্দনা মাসির সাথে সাথে আরেকবার আল্লাহকেও ধন্যবাদ দেয় লুবনা।

এরপর লুবনা ভাবতে থাকে ওর বাচ্চাটা যখন হয়েছে তখন কী দিন না রাত ছিলো? তখন কী মসজিদে আযান হচ্ছিলো? কঙ্ক্রিটে বাম হাতটা আটকা পড়ায় বাম দিকেই কাৎ হয়ে এতক্ষণ বাম দুধটা ধরে রেখেছিলো বাচ্চাটার মুখে। দুধ বের হচ্ছেনা আর। তা দেখে বাচ্চাটা মুখ সরিয়ে নিয়েছে। কেবল হওয়া বাচ্চাটার বুদ্ধি দেখে লুবনা অবাক হয়। ও ভাবতে চেষ্টা করে ছেলেটা বড় হলে উকিল হবে।

উকিলদের অনেক বুদ্ধি থাকতে হয়। লুবনা ডানহাতে বাচ্চাটাকে জড়িয়েই ঘোরার চেষ্টা করে। পারে না। আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। শেষতক বাচ্চাটাকে উপুড় করেই ডান বুকের বোঁটাটা গুজে দেয় মুখে।

বাচ্চাটা উপুড় হয়ে বোঁটা টানতে পারছে না দেখে লুবনা শেষ চেষ্টা করে। হাতটা বাকিয়ে ডানদিকে কিছুটা কাৎ হতে পারে এবার। বাচ্চাটা বুক টানতে শুরু করে। আল্লাহকে ধন্যবাদ দেয় লুবনা। লুবনার ছেলে বাচ্চার স্বপ্ন ছিলো।

তার বাচ্চাটাও ছেলে হয়েছে। চন্দনা মাসির সাথে কাজ করার সময়ে দেখেছে ছেলে বাচ্চাগুলো বেশি কান্নাকাটি করে। মেয়েদের বড় হয়ে কাঁদতে হয় বলে ছোট বেলায় কম কাঁদে আর ছেলেরা যা কাঁদার তা জন্মের সময়ই কেঁদে নেয়। তবে লুবনার বাচ্চাটা কাঁদেনি ধরতে গেলে। হওয়ার পরে একবার-দু'বার উ-আ করেছে শুধু।

মাঝে মাঝে বুক থেকে দুধ আসেনি, তবু বাচ্চাটা কাঁদেনি। এরপর থেকেই লুবনা বুঝে গেছে তার বাচ্চা সাধারণ কেউ না। আল্লাহ প্রেরিত ফেরেশতা। ফেরেশতার গায়ে আলো থাকে। চোখটা মেলতে পারলে বাচ্চাটাকে দেখা যাবেই।

সেই আশাতেই আছে লুবনা। ডানবুক থেকে দুধ আসছে। কাৎ হয়ে থাকতে কষ্ট হলেও লুবনার বেশ স্বস্তি লাগছে এজন্য। একবার ভাবে, কয়েক ফোঁটা দুধ দিয়ে চোখটা পরিষ্কারের চেষ্টা করলে খারাপ হয় না। ভাবতেই বুক থেকে বাচ্চাটার মুখ সরাতে যায় লুবনা।

ক্লান্ত হাতে মুখটা সরাতে পারে না। কয়েক ঘন্টা বয়সের বাচ্চাটা শক্ত করে বুক টানছে। সিদ্ধান্ত পাল্টায় লুবনা। না, ফেরেশতাটা দুধ খাক। যে হাতটা ধরে বুকপকেটে গিয়ে টাকা পেয়েছিলো লুবনা, সেই হাতটা আবার ধরে।

ধারণা করে এটা হয়তো আলমের হাত। ওর হাতের দ্বিগুন বড়। শক্ত। ঠান্ডা। নিথর।

ওর একটু সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো আলম। বিল্ডিং যখন কাঁপছিলো তখন কলিকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো আলম। কলি চিৎকার জুড়ে দিয়েছিলো। জড়িয়ে ধরা অবস্থায় আলম বলেছিলো, আমাকে ধরে থাকো কলি, কিচ্ছু হবেনা। বাকিদের চিৎকারে ওদের আর কোনো কথা কানে আসেনি লুবনার।

তবে আলম ছেলেটার জন্য লুবনার হঠাৎই খারাপ লাগতে থাকে। গার্মেন্টসে আসার পর প্রথম প্রথম লুবনা দেখতো ডিউটি শেষ হলেই আলম দলবল নিয়ে ক্রিকেট খেলতে লেগে যায়। কলি চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরে সেই আলমই কেমন যেন বদলে গেলো। ক্রিকেট খেলে না। গার্মেন্টসে ডিউটি করে মোতালেব ভাইয়ের দোকানে গিয়ে বসে বাড়তি রোজগারের জন্য।

কৌতুহল মেটাতে একবাল আলমকে জিজ্ঞাসা করেছিলো। আলম একরাশ হেসে উত্তর দিয়েছিলো, বুবু, সামনের বছর কলির ১৮ হবে। ওকে বিয়ে করতে হবে। ওর খুব জামদানি আর নূপূরের শখ। রূপার নূপূর।

আর এখনকার মত তো আর মেসে সাবলেট থাকা যাবে না। একটা ঘর ভাড়া নিতে হবে। তাই টাকা জমাচ্ছি। লুবনা খুব করে হেসেছিলো। হাসি দেখে আলম বলেছিলো, বুবু, তোমার হাসি খুব সুন্দর কিন্তু কলিরটা আরও সুন্দর।

আচ্ছা, আরেক হাতে কি আলম কলিকে ধরে আছে? কলি কি ওর গায়ের সাথে এখনও লেপটে আছে? অন্ধকার আর চোখের অবস্থা জেনেও লুবনার ওদেরকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। আলমের হাত ছেড়ে দেয় লুবনা। আতাউরের কথা মনে হতে থাকে লুবনার। আতাউর তার বাচ্চাটাকে দেখতে পাবে তো? আমি যদি মরে যাই তবে আমার বাচ্চাটাকে চিনতে পারবে? কিভাবে চিনবে? ছেলেটা দেখতে কি আতাউরের মতই হয়েছে? নাক-চোখগুলো? আমাদের গ্রামের আইজু চাচার ছেলে রনজু দেখতে ঠিক আইজু চাচার মত, ওরকম? তা না হলে চিনবে কিভাবে আতাউর? চিন্তায় পড়ে যায় লুবনা। আতাউরের সাথে স্মৃতিগুলো ভেসে আসে।

সাভার থেকে ওকে ময়মনসিংহ নিয়ে গিয়েছিলো। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে গিয়ে বলেছিলো, আজ রাতে এই কাশবনে থাকবো। এখানেই হানিমুন হবে। লোকটা একটা পাগল। তাকে সবাই আতা ভাই বলে ডাকতো।

সবারই উত্তর দিতো। আমি সামনে থাকলেই কেবল আতা ভাই ডাকলে বলতো, শোনো, আমাকে আতা ভাই ডাকবা না। আতা একটা ফল। আমার নাম আতাউর। আমি ফল না, মানুষ।

একটাই শুধু দোষ মানুষটার। একটু নেশা করে। নেশা সব পুরুষই করে। সব মেয়েরা যেমন পান খায় তেমন সব ছেলেরাই একটু নেশা টেশা করে। মানুষের আরও কত খারাপ গুন থাকে।

জুয়া খেলে, মারামারি করে। আতাউর এসব কিছু করে না। তাই লুবনা এটাকে এমন কিছু মনে করে না। প্রথম প্রথম অবশ্য লুবনা কয়েকবার বারণ করেছে। কাজ হয়নি।

পেটে বাচ্চা আসতেই সেই আতাউর বদলে গেলো। রাতে বাসায় আসতো না। আশে পাশে কানাকানি হতো। লুবনা ওসব গায়ে মাখেনি। একদিন পাশের পাড়ার কামরুল এসে লুবনাকে একটা বস্তিতে নিয়ে গেলো।

লুবনা গিয়ে দেখে ফর্সা একটা মেয়ের বিছানায় আতাউর ঘুমাচ্ছে। লুবনা ফিট হয়ে গেছিলো। আর কিছু মনে নেই ওর। পরে শুনেছিলো আতাউর ঘুমে ছিলো না, স্ট্রোক করেছিলো। হাসপাতাল থেকে আতাউর ফেরার পরে লুবনার সে কী কান্না।

ভয়ানক কষ্ট হয়েছিলো ওর। বুকের ভিতরটা ভেঙে যাচ্ছিলো। লুবনা বিল্ডিং ভাঙার পরের কষ্টের সাথে ওইদিনের কষ্ট মেলায়। না, ওইদিনই লুবনার বেশি কষ্ট হয়েছিলো। মানসিক কষ্টের কাছে শারীরিক কষ্ট কিছুই না।

আর কোনোদিন কোনো মেয়ের কাছে যাবেনা বলে ওইদিন আতাউরকে মাথা ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করতে বলেছিলো লুবনা। আতাউর ওর বুকের মাংসে হাত রেখে বলেছিলো, আর কারো বুক ছোঁবো না। আতাউরকে আর বিশ্বাস হয়নি লুবনার। নেশাগ্রস্থ মানুষের প্রতিজ্ঞার জোর থাকেনা। বাচ্চাটা আর বুক চুষছে না।

দুধ সম্ভবত শেষ হয়ে গেছে। চুষতে চুষতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেছে বাচ্চাটা। লুবনার হঠাৎ ভয় হয়। বাচ্চাটার বুকে হাত রেখে দেখে। না, বুক নড়ছে।

আল্লাহ ওর হেফাজত করছে। লুবনার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। শরীরের ধকল নেওয়ার সব ক্ষমতা শেষ। দমবন্ধ লাগছে। নাকে জমাট রক্তের গন্ধ অনেক আগে থেকেই আসছিলো, এখন পঁচা গন্ধ আসছে।

লুবনার হঠাৎ খট খট শব্দ শুনতে পায়। লুবনা ভাবে আল্লাহ নিশ্চয়ই কেউকে পাঠিয়েছেন তার ফেরেশতাটাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নাহ্ִ, আরও কিছুক্ষণ জেগে থাকতে হবে। ঘুমানো যাবে না। লুবনার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।

অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। কেউ আসে না। শব্দ মিলিয়ে যায়। বাচ্চাটা দুধ না পেয়ে মাঝে মাঝে কেঁদে উঠতে থাকে। লুবনা কান্নার শব্দ এড়িয়ে কান পেতে থাকে খট খট করে দেয়াল ভাঙার শব্দ শুনতে।

বাচ্চাটার কান্না মিয়িয়ে আসে। লুবনা সর্বশক্তি দিয়ে বুক টেপে। দুধ বের হয় না। না পেরে নিজের ডান হাত কামড়ে খানিক মাংশ তুলে ফেলে। রক্ত বের হয়।

হাতটা বাচ্চাটার মুখের উপর ধরে। রক্ত খেয়ে বাচ্চাটা কান্না থামায়। আবার কিছুক্ষণ পর কাঁদতে থাকে। লুবনা আবার হাতে কামড় বসায়। মাংশ ছিড়ে আনে।

কিন্তু আর রক্ত আসে না। লুবনা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। শেষ শক্তিটুকু এক করে মাথার পাশের দু'টো ইট এক করে। ঠেলে ঠেলে পায়ের কাছে পাঠায়। তারপর থেতলে যাওয়া বাম হাতের উপরের কঙ্ক্রিটের উপর মাথা তুলে পা দু'টো ইট দু'টোর উপর উঠায়।

রক্তে ভেজা ছেড়া শাড়িটা খুলে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে দুই বুকের নিচে রাখে বাচ্চাটাকে। খট খট শব্দের আওয়াজ বাড়ে। লুবনা জেগে থাকার শেষ চেষ্টা করে। যেভাবেই হোক, মরার আগে ফেরেশতাটাকে দেখতে হবে। লাশঘর থেকে চোখ লাল এক মাতাল মতন লোক লুবনার লাশ নিয়ে যায়।

শিশু ওয়ার্ডের ইনকিউবেটর থেকে বাচ্চাটার কান্না ভেসে আসে। তাকে কেউ চেনে না। তাকে কেউ নিতে আসে না। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।