চিত্রদীপ জ্বেলে রেখো ময়ূখ পিদিম; রাত্রি-কথায় বেঁধে নেবো ভোরের খোঁপা। ১।
যত রাতেই আমি ঘুমাই না কেন বেশ সকালেই বিছানা ছাড়ি। অবশ্য ভুল বললাম পরিপূর্ণ ঘুম বলতে যা বোঝায় তার অনুভূতি এখন কেমন তার কিছুই আমার মাঝে কাজ করেনা। হয়ত মনটা যখন সতেজ ছিলো , স্কুলের গণ্ডি পার করিনি তখনো , হালকা গোঁফের রেখা স্পষ্ট হয়নি সে সময়টা পর্যন্ত ঘুমের আমেজ কি তা বেশ বুঝতাম।
নাহ , ঘুমাতে পারিনা কিংবা ঘুম হচ্ছেনা বলে আমার মাঝে কোনো আক্ষেপ বা হা-পিত্যেশ নেই। তবে আমার স্ত্রী খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় , ঘরের হালকা রঙের পর্দা পাল্টে ভারী , মোটা কাপড়ের পর্দা ঝোলায় , ডিমলাইটও এখন আমাদের রুমে জ্বলে না যাতে নিরিবিলিতে রিলাক্স হয়ে ঘুমাতে পারি। ডাক্তারের দেয়া নার্ভ রিলাক্স করার ওষুধ আমি রাত আটটার মাঝেই খেয়ে নেই তা দেখে আমার স্ত্রী লোপা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আর আমি তখন লোপার দিকে তাকিয়ে আমার বিখ্যাত গুডি গুডি মার্কা হাসিটা মুখে ঝুলিয়ে রাখি। সে তখন আশ্বস্ত হয়। ঘরের শান্তি বজায় রাখার জন্য এরকম মুখ টিপে হাসি হাসি ভাব ধরে রাখা সব পুরুষের জন্যই জরুরী আর এই বিদ্যা ঈশ্বর সম্ভবত পুরুষদেরকে দিয়েই বোধ করি পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
আজ ঘুম থেকে উঠেই আমার মাঝে প্রথমে যে ব্যাপারটা কাজ করলো তা হলো “ আজ রেহান অফিসে যাবেনা। ” আমি রেহান , একটা মাল্টিন্যাশনাল অফিসের সিনিয়র এডমিন অফিসার। নাস্তা সেরে অফিসের জন্য রেডি হয়ে আয়নার সামনে মনে হয় অনেকটা সময়ই দাঁড়িয়ে ছিলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখতে আমার বেশ ভালো লাগে। এটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস।
লোপা প্রায়ই বলে আমার চোখ দুটো নাকি খুব ঠাণ্ডা আর স্থির। আমার চোখে নাকি অভিব্যক্তি অনেক কম , সব অবস্থাতেই চোখের রেখায় বিন্দুমাত্র কাঁপন না তুলে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি। আমি কথা খুব কম বলি বলেই অন্যকে নিয়ে ভাবার সুযোগ বেশী পাই। আমি জানি আমার চোখ দুটোকে লোপা খুব ভয় পায় আর মুখ ফুটে না বললেও আমি বুঝি ও আমাকে ভালোবাসে না। বুদ্ধিমতী মেয়ে বলেই বোকা মেয়েদের মতো স্বামী -সংসার নিয়ে শরীরে সুখের চর্বি মজুদ করে রাখছে যাতে অসময়ে তা পোড়াতে পারে।
আমাদের ড্রেসিং টেবিলটা বিছানার ঠিক বিপরীতে রাখা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ব্রাশ করতে করতে দেখলাম লোপা বালিশে হেলান দিয়ে আমাকে একদৃষ্টিতে দেখছে। আমি একটা মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিতেই জানতে চাইলো –
- এতো সময় নিয়ে নিজেকে আজ আয়নায় দেখছ যে ? নতুন কেউ জয়েন করলো নাকি তোমার ডিপার্টমেন্টে ?
আমি শুধু হাসলাম। হেসে ওকে বললাম –
- ভাবছি চুলগুলো ফেলে দিয়ে ন্যাড়া হয়ে যাবো। ন্যাড়া হলে দেখতে কেমন লাগবে তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম।
২।
লোপাকে সারাদিন ভাববার মতো একটা প্রশ্নের উত্তর ছুঁড়ে ওকে বিদায় জানিয়ে অফিসের গাড়ির জন্য লিফটের দিকে পা বাড়ালাম। আমাদের ফ্ল্যাটটা ১৪ তলাতে। অন্যান্য দিন লোপা লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায় কিন্তু আজ হয়ত ও হতভম্ব হয় এখনো বিছানাতে আধশোয়া হয়েই আছে। ভাবতেই একটা পৈশাচিক সুখ সুখ ভাব এলো আমার মাঝে।
আমার ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলো
“ রেহান , তোমার আজকের দিনটা ভালো যাবে । ”
নীচে নেমে আজ বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না । মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নীল রঙের বারো সীটের হাই এইচ গাড়িটা চলে এলে আমি গাড়ির আরামদায়ক এসিতে বসে আমার কিছুক্ষণ আগের সুখ অনুভবটাকে বুক পকেটে মুড়ে রাখি।
আমি ছাড়াও গাড়িতে করে আমাদের অফিসের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের আরও সাত জন কলিগ যায়। আমাকে সহ মোট আটজনকে নিয়ে গাড়িটা সকালের মহাখালীর জ্যামে রোদের মাঝে হাঁপাতে থাকে।
এরই মাঝে কলিগদের কথার তুবড়ি ছুটতে থাকে। আমার পাশের সীটেই আজ শাহানা বসেছে। ফাঁকে ফাকেই সে তার পা দিয়ে আমার পা ঘষার চেষ্টা করছে। শাহানা , সদ্য ইউল্যাব থেকে এমবিএ করে আমাদের এখানে জয়েন করেছে মাস ছয়েক হলো। মেয়েটার মাঝে কেমন একটা খাই খাই ভাব আছে।
যদিও আমি আমার ম্যারিটাল স্ট্যাটাস নিয়ে শাহানাকে কিছুই বলিনি আর সেও কিছু জানতে চায়নি। আমি মনে মনে হাসি এই ভেবে যে জানি এই মেয়েও আকর্ষিত হয়ে আমার কাছে আসবে । তাই আর ইচ্ছে করে গুটি চেলে কাছে আনার প্রয়োজন পড়েনি।
শাহানার ঠিক পাশেই বসেছে নিলয়। দু’ বছর হলো আমাদের এখানে আইটি ডেভেলপার হিসাবে কাজ করছে।
দারুণ জিনিয়াস একজন ছেলে কিন্তু কোনো ব্যাপারেই তার ভবিষ্যৎ প্ল্যান নেই। সময় যেভাবে যাচ্ছে সেও সেদিকেই পাল তুলে চলছে। আমার ঠিক পিছনের সীটে বসেছেন কমার্শিয়াল ম্যানেজার হাবিব সাহেব। চরম বিরক্তিকর এক ক্যারেক্টার। তার সব কথাই শেষ হয় হা – হুতাশ দিয়ে।
মানুষের পছন্দ যে কতটা নিম্ন রুচির হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই হাবিব সাহেব যার জুতো , শার্ট , প্যান্ট দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে উনি একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করেন। তবে উনি কাজ জানেন ভালো তাই টিকে আছেন এখনো।
হাবিব সাহেবের পাশেই বসেছেন সিনিয়র মার্কেটিং অফিসার সেলিম সাহেব। ৪৩ বছর বয়সী লোকটি দারুণ স্মার্ট। দুর্দান্ত ইংরেজি বলা ছাড়াও ডয়েচ আর স্প্যানিশেও তার সমান দক্ষতা।
আমার পিসিতে ইউজার মনিটর সফটওয়্যার থাকায় কে কার পিসিতে কি কাজ করছে খুব সহজেই বুঝতে পারি যার পারমিশন খোদ এমডি দিয়েছেন। প্রায়ই দেখা যায় সেলিম সাহেব সকালে এসেই এমন সব সাইটে বিচরণ করেন যে এয়ারকুলারের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রীতে দেয়া থাকলেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু হালকা ঘামের রেখা দেখা যায় । আমি হাসি হাসি মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অনুমান শক্তি আর চোরের মন পুলিশ পুলিশ হবার কারণে একটা সময় দেখা যায় সেলিম সাহেব বোকা বোকা একটা নার্ভাস হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখে আমার দিকে একবার তাকাচ্ছেন আরেকবার তার পিসিতে যা একজন কর্পোরেট সিনিয়র মার্কেটিং অফিসারের মুখে একেবারেই বেমানান।
স্নিগ্ধার কথা ভাবতে শুরু করবো আর দেখি অফিসের গেটের সামনে চলে এসেছি।
তাই আর স্নিগ্ধাকে নিয়ে ভাবা হয়না
৩।
প্রতিটা কাজেই আমি নিদারুণ এক অলসতা বোধ করি। অফিস করতে আমার ভাল লাগেনা মোটেই। মূলত সারাটা দিন কি করে পার করবো এই চিন্তাতেই অফিসে আসা কিংবা কর্মক্ষেত্রে জড়ানো। এখানে এসে প্রথম প্রথম কাজের মাঝে বৈচিত্র্য পেলেও এই চার বছরে বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছি।
অন্য কোথাও আসলে জবের অ্যাপ্লাই করছিনা একই কারণে। আমার আগ্রহ খুব অল্পতেই চলে যায় যে কোনো ব্যাপারে খুব দ্রুত আর এই ব্যাপারটা প্রথম টের পাই যখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। এটা যে এই ৩৫ বছর বয়সে এসেও সমানভাবে দাপাদাপি করে আমার ভেতরে দ্বিতীয় এক নিষ্ঠুর রেহানের জন্ম দিবো তা আমার ধারনাতেও ছিলোনা। কুমিল্লা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম হয়েও যখন আমার মাঝে ছিটেফোঁটা আনন্দের রেশ পেলামনা তখন অনুভব করলাম আমার মাঝে বোধহয় কোনো সমস্যা আছে। সহপাঠীরা এমনকি কাজিনরা ভেবেছিলো এটা বুঝি আমার কোনো পার্ট নেয়া কিংবা ভাব ধরা জাতীয় কিছু।
কিন্তু আমি জানি তা ভাব ধরা জাতীয় কোনো বিষয় ছিল না , আমি এমনই। কারণ পুরো পাঠ্যপুস্তক যখন আমার পড়া হয়ে গিয়েছিলো আমি জানতাম এখানে আমার নতুন করে কিছু পড়ার বা শেখার নাই। কোনো আকাঙ্ক্ষিত বস্তু আমার কব্জার মাঝে চলে আসলেই আমি নিদারুণ এক ক্লান্তি অনুভব করি। আর আমার সমস্যা এখানেই যা অন্যের চোখে ধরা পড়ে না ; সযতনে লুকিয়ে রাখি বলে ।
মোবাইল একবার ভাইব্রেট করে উঠতেই দেখি লোপার এসএমএস।
তা আর খুলে পড়তে ইচ্ছে করলো না। জানি নতুন কিছুই সেখানে লেখা নেই তাতে। আদর্শ স্ত্রীর মতো বরাবরের একঘেয়েমি একই কথা “ অফিসে পৌঁছেছ ?” জোরে শব্দ কানে বাজে বলেই আমি মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখি। টিভিও দেখি মিউট করে যদিও তা আমার কালেভদ্রেই দেখা হয়। প্রথম প্রথম লোপা খুব অবাক হতো।
লোপা ভলিউম কমিয়ে দিয়ে টিভির প্রোগ্রাম বা গান শুনলেও আমি যখন বলতাম ভলিউম বাড়িয়ে নিতে ও খুব ইতস্তত করে বলতো –
- তোমার তো শব্দ করে শোনা পছন্দ না
- আমার পছন্দ নয় বলে যে তোমারও তা অপছন্দ তাই বা কে বলল ! তুমি তোমার মতো দেখতে পারো।
ও তখন খুব অস্বস্তি নিয়ে টিভি দেখতে থাকে আর আমি দেখতে থাকি ওকে। কোনো কামনায় নয় এমনি একটু ইচ্ছে করলো লোপার গালটা ছুঁয়ে দেখতে। আমার আঙুলের স্পর্শ পেতেই দেখলাম তিরতির করে লোপার পাতলা ঠোঁট দুটো কাঁপছে। এক ঝলকেই ওর দু’ গালে কেউ যেন হালকা গোলাপি রঙের রুজ লাগিয়ে দিয়েছে।
দ্রুত লয়ে ওর উঁই ঢিবির ওঠানামা দেখে মনে হলো সমর্পণের প্রতীক্ষায় কেমন যেন ও নুয়ে পড়তে চাইছে। বুনো উন্মত্ততায় যখন দুজনে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় পড়েছিলাম আমার মাঝে বয়ে যাচ্ছিলো তীব্র এক বিষাদ ঝড়। লোপাকে আর বলতে ইচ্ছা করলো না শুধুমাত্র জৈবিক তাড়নাতেই ওর দেহের অলিগলিতে বিচরণ করলাম বিগত চল্লিশ মিনিট। লোপা আমার গালের সাথে গাল ঘষে কপালের মাঝ বরাবর চুমু খেয়ে জানালো আমায় ভীষণ ভালোবাসে। আমি একদৃষ্টিতে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে এলোমেলো চুলগুলোকে আরো এলোমেলো করে দিলাম।
ও শাওয়ার নিতে চলে গেলো আর আমি বিগত চল্লিশ মিনিট ধরে আটকে থাকা দীর্ঘ নিঃশ্বাসটাকে সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে রিং বানিয়ে ১২৪০ বর্গফুটের মাস্টার বেডরুমে ওড়াতে লাগলাম। আমি জানতাম না এতো দ্রুতই আমার শারীরিক আকর্ষণও কমে যাবে। তখন আমাদের বিয়ের মাত্র দু’ মাস চলছে।
৪।
কাজের ফাঁকে মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে লাগতেই চেয়ে দেখি স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
স্নিগ্ধা , কমপ্লায়েন্স অফিসার হিসাবে তিন বছর হলো এখানে কাজ করছে। ডিভোর্সি , সিঙ্গেল মাদার , ৩২ বছর বয়স ; আমেরিকা থেকে সংসারধর্ম ত্যাগ করে বাংলাদেশে চলে এসেছে বাবা- মায়ের কাছে। আলগা একটা কাঠিন্য চেহারাতে ধরে রাখলেও তার হিজাবের মাঝে খেলা করে এক টলটলে লাবণ্য , দু’ চোখের মনিতে ভেসে থাকে পাখি হয়ে উড়তে চাওয়ার স্বপ্ন।
- রেহান সাহেব , সারাদিন বুঁদ হয়ে এতো কি ভাবেন ?
- কিছুনা। আমি বরাবরই স্বল্পভাষী।
- হতে পারেন স্বল্পভাষী। তবে আপনার চোখ কিন্তু সে কথা বলেনা।
- চোখ কি বলে ?
স্নিগ্ধা উত্তর না দিয়ে আমার চোখে চোখ রাখলো। এ আমাদের এক অনুক্ত স্নায়ুযুদ্ধের খেলা। ওর চোখে অবিশ্বাস আর নির্ভরতা দুটোই একসাথে কাজ করছে আর আমার চোখে নিশ্চিত সিদ্ধান্তের ফোঁড়ন ঝাঁজ।
আবার হয়তো আরেকটি বৈচিত্র্যহীন ঘটনার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমি কিছুদিনের মাঝেই স্নিগ্ধাকে নিয়ে ; ভাবতেই ক্লান্ত স্বরে তাকে বললাম
- চলুন ডাইনিং এ যাওয়া যাক। লাঞ্চের সময় হয়ে এলো।
৫।
এ আমার এক অদ্ভুত রোগ। অফিসে এসে একবার ঢুকলে আর বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করেনা।
বাসায় ফিরে সেই পরিচিত ঘর , পরিচিত মুখ , পিনপতন নীরবতা ইত্যাদি ভেবেই আর ঘরে ফেরার আগ্রহ থাকেনা। তবুও ফিরতে হবে বলেই কলিগদের বিদায় দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে থাকি ধানমণ্ডির জাহাজ-বাড়ির কাছ ঘেঁসে লেকের সামনের দিকটা ধরে। সন্ধ্যা ৭ টার পর লেকের আশেপাশে উঠতি ছেলে- মেয়েদের আড্ডায় জায়গাটা মুখরিত হয়ে উঠলেও লেকের জলে চাঁদের ছায়া দেখতে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও ভালো লাগে বেশ। কিন্তু লোপার ফোনে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলেও বিন্দুমাত্র বিরক্তি না দেখিয়ে ওর ফোন রিসিভ করে জানাই ১৫ মিনিটের মাঝেই বাসায় পৌঁছবো।
ঘরে ঢুকলেও একই অবস্থা আর বের হতে ইচ্ছা করেনা কোথাও।
তবুও আমার মাঝের এই বিক্ষিপ্ত ভাবনাকে নিপুণভাবে ঢেকে রেখেই লোপার সাথে ডাইনিং এ বসে রাতের খাবার সেরে নেই। টিপিক্যাল বউ বউ ভাবটা আমার একেবারেই অসহ্য লাগে, লোপাও এর বাইরে নয়। প্রত্যেকটা মানুষেরই তার নিজস্ব একটা সত্ত্বা বলে কিছু থাকতে হয় কিন্তু মেয়েরা কেন যে নিজেদের বিসর্জন দিয়ে পুরোই গেরস্থালী মনোভাব পোষণ করে বুঝি না আমি। ৪/৫ ধরনের খাবারের আইটেম না হলেও আমার চলে কিন্তু লোপা একই নিয়মে রোজ টেবিলে খাবার সাজায়। বিয়ের পর প্রথম প্রথম লোপা তার রান্না কেমন হয়েছে জানতে চাইতো।
আমিও ছোট করে উত্তর দিতাম “ বাহ বেশ ভালো কিংবা মন্দ না । ” ওর এই কেয়ারিং ভাবটাও আমার বিরক্তি তৈরি করে বিশেষ করে না খেয়ে আমার জন্য এই বসে থাকাটা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমার ভালো লাগা – মন্দ লাগা আমার বাচন বা কাজেও প্রকাশ পায়না বলে লোপা সহ আমার অল্প কিছু বন্ধু- বান্ধব , পরিবারের অন্য সদস্যরাও ভেবে নেয় যে তাদের মতো করেই বুঝি আমার পছন্দ – অপছন্দের মাত্রা ওঠা নামা করে। এই মুহূর্তে আমি ডাল ভুনা আর ইলিশ মাছের ভাজা দিয়ে ভাত খাচ্ছি হাসি – হাসি মুখ করে। ডাল আর ইলিশ ভাজা দুটোতেই এতো লবণ হয়েছে যে আমার ইচ্ছা করছে ডালের বাটিটা লোপার মাথায় ঢেলে দেই।
আমি এও খুব ভালো মতো জানি এই অতিরিক্ত লবণের ব্যাপারটাও ওর ইচ্ছাকৃত। ওর প্রতি , ওর রান্নার প্রতি কিংবা সংসারে আমার মনোযোগ আছে কিনা তা পরীক্ষা করতেই ও এই কাজটা করে খুব সরলতার ভান করে।
- রেহান , তোমাকে আরেক পিস মাছ দিবো ?
- লোপা, ডিনার শেষ হলে আমার পাসপোর্টটা দিও তো!
- অফিস থেকে দেশের বাইরে কোথাও যাচ্ছ নাকি তোমরা ?
- নাহ।
- তাহলে ?
- ভাবছি দু’সপ্তাহের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ঘুরে আসবো আব্বা – আম্মার ওখানে।
- ওয়াও ।
তাহলে কাল থেকেই লাগেজ গোছাতে শুরু করে দেই , কি বলো রেহান ?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমি বললাম –
- লোপা , তুমি যাচ্ছ না। আমি একাই যাচ্ছি।
লোপার অভিব্যক্তি দেখতে ওর দিকে তাকালাম। স্নায়ুযুদ্ধের খেলায় সে এখনো অতটা পারদর্শী হতে পারেনি বলেই মুহূর্তের মাঝে তার দু’ চোখে শ্রাবণের ঝিলিক দেখা দেয় যদিও তা অল্প সময়ের জন্যে। ওকে কান্না গেলার সময় দিয়ে বললাম “ আমি যে ক’টা দিন থাকবো না তুমি না হয় টাঙ্গাইল তোমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে ঘুরে এসো।
”
ও মাথা নেড়ে সায় জানালে আমি ব্যালকনীতে গিয়ে দাঁড়ালাম।
ঢাকা শহরের রাতের আকাশের আলো – আঁধারির খেলা যেমন আমার মনকে বিন্দুমাত্র দোলা দেয় না ঠিক সেরকমভাবেই ক্যালিফোর্নিয়াতে যখন এইচ এস সি পরীক্ষার পর গ্রাজুয়েশন করতে যে পাঁচ বছর কাটিয়ে এসেছিলাম তখনো আমায় আন্দোলিত করতো না। এবার সেখানে গেলে মা’ কে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবো আমার জন্মের সময় মা কি খুব অসুখী ছিলো কিনা কিংবা মনো-বৈকল্যে ভুগতো কিনা । কৈশোরটা বড় আপার বাসায় যখন বাবা- মা’কে ছাড়াই কাটিয়ে দিলাম তখন থেকেই ধীরে ধীরে মানসিক ব্যাধিতে আমি ডুবছিলাম কিনা আরো গভীরভাবে ভাবতেই ব্যালকনীতে রাখা ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলাম। কিন্তু নাকে এডিডাসের হালকা মিষ্টি সৌরভ লাগতেই বুঝলাম লোপা চা নিয়ে এসেছে।
চায়ের কাপে চুমুক দেবার আগে লোপাকে পিরিচে একটু চা ঢেলে এগিয়ে দিতে গিয়ে টের পেলাম ও খুব সন্তর্পণে ওর ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের করে দিলো আর আমিও টুপ করে ওর দীর্ঘশ্বাসটাকে আমার ভেতরের রেহানের কাছে গচ্ছিত রাখলাম।
- আচ্ছা লোপা, তুমি বিবিএ করে কেন ঘরে বসে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখো আমায় বলতে পারো ?
- আমার যে জব করতে ইচ্ছা করেনা রেহান !
- ঘরে তোমার সময় কাটাতে খারাপ লাগেনা লোপা ?
- রেহান , তোমাকে ছাড়া আর কোনো কিছুই আমার ভালো লাগেনা ।
উফ , মেয়েরা যে কেন এতো ন্যাকামি করে কে জানে ! ওর এরকম ন্যাকা ন্যাকা কথায় আমার কপাল বিরক্তিতে সামান্য কুঁচকে গেলেও এই অন্ধকারে লোপা তা টের পায়না। লোপাকে আমার কোলে বসতে দিয়ে ইজিচেয়ারে ওকে সহ দোল খেতে লাগলাম। ও আমার গলার পিছন দিক দিয়ে দু ’হাতে জড়িয়ে ধরে কিশোরীদের মতো আদুরে গলায় জানতে চাইলো
- রেহান , তুমি কি আমায় ভালোবাস না ?
আমি দুলুনি থামিয়ে স্থির হয়ে বসলাম।
ওর চুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙুল গলিয়ে চুলগুলো আমার মুঠোতে পুরে নিয়ে ওর ঠোঁটে গভীর চুমু খেলাম। হাহ হাহ হাহ , নারী কতো সহজেই না ছলনাতে ভোলে ! আমার ভেতরের রেহানকে ধমকে চুপ করাতেই লোপা বলল আমার জন্য নাকি একটা সুখবর আছে। যদিও আমি অনুমান করতে পারি কি সুখবর হতে পারে কিন্তু মুখ ফুটে ওর কাছে আর জানতে চাইনা। বরং ওকে বললাম স্টাডি-রুমে আমার পাসপোর্টটা রেখে যেন ও শুয়ে পড়ে।
৬।
বৈচিত্র্য হীনতায় ভুগতে ভুগতে কেমন যেন এক তীব্র আক্রোশ আমার শরীরের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে বেশ কিছুদিন যাবত। মনে হচ্ছে রক্তের মাঝে পোকার মতো কিছু ক্রমাগত বংশবিস্তার করে চলেছে। কেমন একটা কিলবিলে অনুভূতিতে সারা গা, হাত- পায়ের আঙুল চুলকোতে থাকে। ইচ্ছা করে গায়ের চামড়া ধারালো কিছু দিয়ে চিঁড়ে ফেলি। কোরবানির গোরু বা খাসির ছাল ছাড়ানো মাংস আর চর্বির নগ্ন শরীরটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আমি ফিক করে হেসে ফেলি।
নতুন কিছু একটা করার উত্তেজনায় আমার চোখ চিকচিক করে উঠলো। বুকশেলফের নীচের ড্রয়ারে একটা পাতলা ছুরি থাকার কথা। তিন বেড রুমের এই বিশাল ফ্ল্যাটটা আমাদের বিয়ের সময় বাবা- মা গিফট করলেও স্টাডি-রুমটা আমার পারসোনাল রুম হিসাবেই বিবেচিত হয় লোপার কাছে। সোলো মিউজিক আমার খুব পছন্দের। আজ দীর্ঘ দেড় বছর পর আমি ভলিউম বাড়িয়ে ছুরি হাতে কার্পেটে মোড়া মেঝেতে বসে পড়ি।
এসির নীচে বসেও আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে যাচ্ছে। নিষিদ্ধ আনন্দে কেমন যেন নিজের মাঝে কাঁপন অনুভব করছি। বাঁ হাতের তালুতে ছুরিটা ডান হাতে ধরে প্রথম রমণ সুখের মতো এক উত্তেজনা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছি বিগত তিন মিনিট ধরে। ভেতরের রেহানটা ধমকে উঠলো –
- “ বসে আছো কেন ? কাটো । হাতের তালুটা কচ করে কেটে ফেলো।
”
ছুরিটা ধীরে ধীরে নেমে আসে আমার বাঁ হাতের তালুর উপর। অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছি রক্তবিন্দুর পতন দেখতে। হাতের নীচে রাখা সাদা টিস্যু পেপারটা মুহূর্তের মাঝেই শুষে নিচ্ছিলো আমার A পজিটিভ রক্তের ধারাকে। ভেতর থেকে প্রবল ঢেউয়ের মতো করে কেউ যেন ধাক্কা দিচ্ছে আমাকে আর বলছে
- আরো জোরে , আরো জোরে চেপে ধরো ছুরিটা ।
আমিও নেশা লাগা এক ঘোরে আমার বাঁ হাতের তালু ছাড়িয়ে কবজি , আরেকটু উপরে এভাবে করতে করতে কনুই পর্যন্ত ছুরির আঁচড়ে শিমুল রঙা রঙে ক্যানভাস আঁকতে শুরু করলাম পাগলে মতো হিস-হিস ধ্বনিতে।
দরজা খোলার শব্দে তাকিয়ে দেখি লোপা এক বোবা ভয়ে বিস্ফোরিত চোখে নতুন এক রেহানকে দেখছে। ওর মুখ থেকে ছিটকে এলো দুটি মাত্র শব্দ-
- কি করছ ?
- রক্তের ভেতর মনে হয় কিছু চুলকোচ্ছে অনেকদিন ধরে। তাই দূষিত রক্তটা চিরে বের করে দিলাম বলে ওকে আরেকটু ভয় দেখাতে বাঁ হাতটা মুখের সামনে ধরে জিভ দিয়ে চুষতে লাগলাম মুখে ক্রুর একটা হাসি ফুটিয়ে রেখে।
সশব্দে দরজা বন্ধ করে লোপা চলে গেলো এই স্টাডি রুম থেকে। আমি আসলে দু’ সপ্তাহের জন্য দূরে যাচ্ছি যাতে লোপা ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে পারে আমার সাথে থাকবে কিনা সামনের পথ চলায়।
আমার কাছে একদম অসহ্য লাগছে এই বিবাহিত জীবন , সকাল ৯ টা – ৫ টা অফিস, এই ক্লান্তিকর বৈচিত্র্যহীন ভাবে বেঁচে থাকা, সব – একেবারে সব কিছু। সাধারণের চেয়ে আমার আই কিউ বেশ ভালো এবং মুখে সদা হাস্যময় এক মুখোশের কারণে নিজের ইমেজটা খারাপ হোক তাও চাইনা বলে নিজের মুখ দিয়ে “ না ” শব্দটা বের করিনা । বরং কাজগুলো এমনভাবে করি যাতে আরেকজনের মনের উপর চাপ পড়ে আর সে মানুষটাকে দিয়েই আমার ইচ্ছে মতো কাজটা করিয়ে নেই। আর লোপা কিংবা লোপার মতো মেয়েদের নার্ভ নিয়ন্ত্রণ করা আমার জন্য তেমন জটিল কাজ নয় । না ডাকতেই মেয়েরা কেন আকৃষ্ট হয় জানি না অনেকটা মরণ নিশ্চিত জেনেও পোকাদের আলোর কাছে ছুটে আসার মতো।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সারারাত নির্ঘুম ভাবেই স্টাডি রুমে কাটিয়ে দেই। যদিও রাত জেগে থাকা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। খুব নিষ্ঠুরভাবে মানুষকে অগ্রাহ্য করার একটা অভ্যাস আমার মাঝে ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠেছিলো। পিনপিন করে ভেতরের রেহানটা আমাকে বলে উঠলো
- মৃত্যুর কাছাকাছি একবার ঘুরে দেখে আসতে পারো । সেই উত্তেজনায় হয়তো আরো কিছুদিন বেশী বেঁচে থাকতে পারবে।
হা হা হা
দাঁতে দাঁত পিষে রেহানকে বললাম – ফাক ইউ, স্টুপিড!
৭।
রাত দশটা বিশ মিনিট। আধাঘণ্টা হলো শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি এমিরেটসের ইউএসএ গামী ফ্লাইটের জন্য। বাঁ পাশে আমার সাথে বসে আছে স্নিগ্ধাও পাথরের মতো এক জোড়া চোখ নিয়ে। ওর চোখেও এই মুহূর্তে কোনো কাঁপন দেখতে পাচ্ছিনা যেমন করে লোপাও আমার চোখে কাঁপন খুঁজে পায়না।
আমার মোবাইলে একটা এস এম এস আসতেই স্নিগ্ধা একটু নড়েচড়ে বসলো। দেখি লোপার এস এম এস
- “ তোমাকে বলেছিলাম একটা সুখবর দিবো। আমাদের ঘরে একজন নতুন অতিথি আসছে যার দায়িত্ব আমাদের দুজনকেই নিতে হবে ”
এই মেসেজ পড়েও আমার মাঝে কোনো ভাবান্তর আসেনা নতুন করে। কারণ আমি জানি লোপার সুখবরটা কি হতে পারে। নতুন একজন শিশু আসবে এই খবরে আমার মাঝে কোনো চাঞ্চল্য সৃষ্টি না করলেও লোপাকে কেন জানি এক নজর দেখতে ইচ্ছা করলো এই ভেবে সে কি আমাকে বাদ দিয়ে তার বাকি জীবনটা নতুন অতিথিকে নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে কিনা !
আমার হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে যায়।
জানি স্নিগ্ধার শরীরে আমি প্রবেশ করা মাত্রই আমার আগ্রহ ঠিক ঐ মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাবে। আমি আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালাম। স্নিগ্ধা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো
- কি মত পাল্টেছেন ? বাড়ির দিকে চললেন বুঝি ? হায়রে পুরুষ মানুষ !
- না
- তাহলে ?
- জানিনা।
স্নিগ্ধা এতো সহজে ভেঙে পড়ার কিংবা অবাক হবার মতো মেয়ে নয় । তবু তাকেও এক বিধ্বস্ত অবস্থার মাঝে রেখে আমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলাম।
ভালোবাসা ! ভালোবাসা আমাকে দিয়ে হবেনা। লোপা কিংবা অন্য কোনো নারী কারো জন্যই আমার কোনো বোধ কেনো জানি কাজ করেনা ।
আমার ভেতর থেকে আবার তিরতিরে এক কম্পন টের পাচ্ছি রেহানের। এক্ষুনি নিশ্চয়ই বলে উঠবে আমাকে শূন্যতায় ঝাঁপ দিতে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।