আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিয়েভ, আমার সেই স্টুডেন্ট ।

। । ১২ অক্টোবর , ১৯৯৪ কিয়েভ , ইয়উক্রাইন, আবার আসিব ফিরে ,এই বাংলার তীরে ... না, ঘরে ফেরা আর হবেনা আমার । কি করে ফিরব !! সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে । মফস্বল এর ছেলে আমি।

ছোট সুখ এর পরিবার। বাবার বড় ছেলে আমি, ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হয়েই জড়িয়ে পড়ি রাজনীতি তে । বাবা তা চাননি বলেই পাঠিয়ে দিলেন রাশিয়া তে। পড়াশুনা করে যেন কিছু একটা হই। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য , বাবার সেই কিছু একটা আমি কোনদিন হতে পারবনা।

রাশিয়া তে কিছু ঝামেলায় জড়িয়ে কি করে যে আমার ঠাই হয় এই কিএভ এ, তা না হয় অন্যদিন বলব। কারন, এখন যে ঘটনা আমি লিখব, তা লেখার সুযোগ হয়ত আর মিল্বেনা । বাবা চিঠিতে জানিয়েছে আর যেন ফিরে না যাই, এই মুখ আর তিনি দেখতে চান না। তাই আটকে গেলাম আই শহর এ। কয়দিন আগে যে ঘটনা আমার জীবনে ঘটে গেল, তা আজ লিখে রাখি।

যদি আমার কিছু একটা হয়ে যায়। । !! একদিন একটা পার্ক এ বসে আছি। এলোমেলো কিছু ভাবনা মনে ঘুরছে। হঠাত, এক টা লোক এসে কথা বলল ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে ।

অবাক হলাম, এরা সাধারণত অপরিচিত দের সাথে কথা বলেনা। বিশেষ করে এশিয়ান দের । লোকটার লম্বাটে মুখ। চোখের দৃষ্টি গভীর । হাঁটুর নিচ পর্যন্ত একটা কোট পরে আছে ।

মাথায় হ্যাট। এরপর আমি যখনি পার্কে যাই, লোকটা কথেকে এসে উদয় হয়, সেই একই পোশাক এ। কথেকে হুট করে আসে , আবার উধাও হয়ে যায়। পার্কে বসে বসে দেশ এর কথা ভাবি, এ ভাবি মায়ের মুখ। অনেক চিঠি লিখি, উত্তর পাইনা।

তবু আশায় থাকি। এই কারণে, লোকটা কই থেকে আসে জায়, মাথা ঘামাইনা । আমি আসার ৫ মিনিট এর মধ্যে সে হাজির হয়। একদিন লোকটা একটা প্রস্তাব দিল। এখান থেকে বেশ খানিকটা দূর এ একটা ছোট শহর আছে, নাম অবুহভ ।

লোকটার বাড়ি সেখানেই । যেহেতু , এই দেশ এর লোকজন ইংরেজিতে খুব কাঁচা, তাই তার মেয়েটাকে যদি আমি পরাই, সে খুশি হবে। থাকা খাওয়ার বেবস্থা আর কিছু টাকা হাত এ আশবে, তাই রাজী না হয়ে পারলাম না। আর টাকার অংক টাও নেহায়েত কম না। একদিন সবকিছু ঘুছিয়ে , রওনা হলাম অবুহভ নামের ছোট শহর এ।

সঙ্গে লোকটা । ট্রেন থেকে নামলাম । গাছ এ ঢাকা সুন্দর ছিমছাম একটা শহর । মনটা ভাল হয়ে গেল । অনেক খানি পথ পাড়ি দিয়ে একটা বিরাট জঙ্গল পাড় হয়ে লোকটার বাড়িতে।

বিশাল এক খামার বাড়ি । চারদিকে ফসল এর খেত । আশে পাশে কোন ঘর বাড়ি চোখে পরলনা । বাড়ির ভেতর ঢোকার সময় একটা ধাক্কা গেলাম । মায়ের করুণ মুখ খানি ভেশে উঠল মনে।

ঘোড় কাটে সামনে একটি অপূর্ব রূপসী মেয়ে দাড়িয়ে আছে। সোনালি কোঁকড়া চুল এর মেয়েটার দিকে বেশিখন তাকাতে পারিনাই । এই দেশ এর মেয়েদের কিছু স্বভাব আমারদের দেশ এর মেয়েদের মত। এরা চোখ এ চোখ পরলে, লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নেয়। এই মেয়েটি তা করলনা ।

বাধ্য হয়ে আমিএই চোখ নামালাম । লোকটি পরিচয় করে দিল, এই তোমার ছাত্রী । আমি দেখলাম আমার ছাত্রী কে । ছিপছিপে গড়ন । মায়াবী চেহারা ।

শীতল চাহনি । এই মুখ কোনদিন ভোলার মত না। মেয়েটির নাম ইয়উলা । তার মা এসে কিছুক্ষণ ভ্রু কুছকে আমাকে দেখে নিয়ে, মেয়েকে বলল, আমার রুম দেখিয়ে দিতে। পুরনো দিনের বাড়ি ।

বিশাল বিশাল রুম । তেমনি একটা রুম আমাকে দেয়া হল। আনেক বড় । বাথরুম তা খানিক টা দূরে । ফ্রেশ হয়ে রুম এ আসলাম ।

জানালা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলাম । যতদূর দৃষ্টি যায় , মাঠ আর মাঠ । তার পরে জঙ্গল । যেন জঙ্গল তা বাড়ীর সীমানা । আজব, এই লোক গুলো কি করে থাকে এখানে? রাত এ ঘুম হলনা।

আনেক আজে বাজে সপ্ন দেখলাম। নতুন জায়গা, আনেক পুরনো বাড়ি । ঘুম হওয়ার কথা ও না । কিন্তু প্রতি রাত এই এমন হতে লাগলো । চোখ বন্ধ করলেই মনে হয়, আমার ঘরে কারা যেন ঘুরে বেরাচ্ছে ।

ফিশ ফিশ করে কেও কথা বলছে । হাসছে । কিছুতেই ঘুমাতে পারিনা আমি। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয়, আনেকগুলো মুখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এর মধ্যে আমার ছাত্রীর পুরদমে পড়া লেখা শুরু হয়ে গেছে।

খুবই মেধাবী আর মনযোগী । কিছু দিনের মধ্যে টুক টাক কথা বলাও শিখে গেল। তার বাবা ভিশন খুশী । দিনের বেশির ভাগ সময় মেয়েটি আমার কাছাকাছি থাকে। যেন আমাকে চোখ এ চোখ এ না রাখলে ,আমি পালিয়ে যাব ।

কিছু বলিনা, কারন তার সঙ্গ আমি উপভোগ করি। সে যখন আমার পাশে থাকে, নানান কথা বলে, আমি কিছু বললে লজ্জায় লাল হয়, সবই আমার ভাল লাগে। শুধু বাড়িটার ব্যাপারে জানতে চাইলে কিছু বলেনা । আমি যা বলি, তাতেই সে মজা পায়। মাঝে মাঝে আমি রান্না করি, আমার দেশ এর মত।

ওহ খুব আগ্রহ নিয়ে খায়। আজব ব্যাপার হল, ওর বাবা মা কে দিনের বেলায় তেমন একটা দেখা যায়না । মনে হয় ক্ষেত এ কাজ করে। এরা খুব পরিশ্রমী। একদিন লোকটা বলল, আমি যেন কোনদিন বাড়ির সীমানা পেরিয়ে বাইরে না যাই।

বিশেষ করে মেইন রোড এর দিকে না যাই । আমি বললাম কেন ? সে উত্তর দিল , এখানকার লোকজন বিদেশী দের সহ্য করতে পারেনা । আমি আর বের হইনা। ইয়উলার সাথে আমার বেশ সময় কেটে যায় । আর কোথাও যাবার দরকার অ পরেনা ।

চিঠি খামে ভরে ঠিকানা লিখে দেই, ইয়উলা সেটা পোস্ট করে দিয়ে আসে । এছাড়া আর কোন কাজ নেই । ইয়উলার সাথে আমার দিনগুলো স্বপ্নের মত কেটে যাচ্ছিল । শুধু একটাই সমস্যা । ঘুমাতে পারিনা রাত এ।

একদিন রাত এ তন্দ্রা মত এসেছে । হটাত বুকে চাপ অনুভব করলাম । চোখ খুলে দেখি , জানোয়ার টাইপ এর কি একটা আমার বুকের উপর বসে আছে। আমার গলা চেপে ধরল। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম ।

চিৎকার করছি , শব্দ নেই গলায় । মনে মনে দোয়া পড়তে লাগলাম , জীবনে যত দোয়াও। শিখেছি । এরপর দেখি , জানোয়ার এর মত দেখতে জিনিস টা আমাকে ছেড়ে উধাও হয়ে গেল। আমি পানি খাওয়ার জন্নে নীচে নামলাম ।

দেখি, এত রাত এ ইয়উলা অ তার বাবা মা ঝগ্রা করছে। আমি আমার রুম এ চলে আসলাম । এর পর লক্ষ করলাম, প্রায় প্রতিদিন তাদের মধ্যে খুব ঝগড়া হচ্ছে । অর বাবা মা কে দেখলাম খুব অস্থির থাকে, আমার সাথে আগের মত নরম সুর এ কথা বলেনা । ওদের ভাষা বুঝিনা ।

২/১ তা ওয়ার্ড যা জানি, তাতে বুঝি, ইয়উলা তার বাবা মা কে অপেখখা করতে বলে। আমার মনে হল অর পড়াশুনার জন্নে তাড়া দিচ্ছে । আমি আনেক বেশি সময় নিয়ে পরাতে থাকলাম । কিন্তু, ওর যেন পড়ায় আর মন বসেনা । আমার রান্না ও এখন আর খেতে আসেনা ।

শুধু আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, আর আক্তু পর পর চোখ মোছে । জানতে চাইলে কিছু বলেনা। একদিন হঠাত বলে উঠল , এখান থেকে চলে যাওয়ার সুযোগ খোঁজেন । আমি মনে মনে বললাম, তোমাকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব না । মুখে কিছু বললাম না।

প্রতি রাত এই আমার মনে হয়, কোনও একটা অশুভ শক্তি আমাকে তাড়া করে, আর পরখখনেই কেও আবার আমাকে রক্ষা করে। ভাল করে দোআ পড়ে তারপর শুতে যাই । এত যত্ন আর আরামে থেকেও আমি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। চোখের নীচে কালি পরে গেল । এমন করে দিন যাচ্ছে ।

একদিন রাতে ইয়উলা হন্তদন্ত হয়ে আমার রুম এ ঢুকল । আমার হাত ধরে টেনে উঠাল । বলল, আপনার অতি জরুরী জিনিস গুলো নিয়ে নিন। আপনাকে এখুনি যেতে হবে। আমার বিস্ময়ের সীমা রইলনা ।

কোথায় যাব আমি? সে বলল , প্রশ্ন নয়, তাড়াতাড়ি । এই বলে আমার ব্যাগ গোছাতে লাগলো । পাসপোর্ট , আর হাতের কাছে যা পেলাম, নিয়ে ওর হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে আসলাম । ইয়উলা পাগলের মত আমাকে টানতে টানতে দোরাতে লাগলো । ওরে বাবা, এই মেয়ের গাঁয়ে যেন অসুরের শক্তি ।

আমাকে প্রায় উরিয়ে নিয়ে চলল । অন্ধকার জঙ্গলে দুজন ছুটে চলছি , কারও মুখে কথা নেই । অনেখন পর ইয়উলা বলে উঠল , ষ্টেশন এর কাছে একটা বড় গির্জা আছে, রাত টুকু সেখানে পার করে ভোরের ট্রেন এ কিএভ ফিরে যাও । আর এখানকার কথা কাওকে কোনদিন বলবেন না। আমি চিৎকার করে বললাম, তোমাকে ছাড়া আমি যাবনা ।

ইয়উলা বলে, তা হয়না । কোনও ভাবেইনা । আমি বললাম, কেন নয়, তোমাকে ছাড়া আমি কিছু তেই থাকতে পারবনা । সে ডুকরে কেঁদে উঠল । তার অর্জিত ইংরেজি বিদ্যা দিয়ে সে হরবর করে অনেকগুলি কথা বলে উঠল।

যতটা বুঝতে পেরেছি, তার মানে এই দারায় যে, আমি ,আমার মা বাবা, আমরা কেও মানুষ না। অনেক বছর আগে আমরা মরে গেছি। আজকের এই দিনটিতে । তাই আমরা এই দিন এ কোনও না কোনও মানুষ কে টুকরো টুকরো করে কেটে খেয়ে , নিজেদের জ্বালা কমাই । তোমাকে ওরা অনেক আগেই খেয়ে ফেলত, আমি বাধা দিয়েছি ।

বলেছি, আর কটা দিন অপেখখা কর। তোমাকে আমার অনেক ভাল লাগে, তোমার ক্ষতি হতে দিতে আমি চাইনি । কিন্তু, আজ আমার কোনও কথাই তারা শুনবেনা , আজ সেই অভিশপ্ত দিন। আজ তারা পাগল হয়ে গেছে । তোমাকে শেষ রক্ষা করতে আমি চেষ্টা করছি।

এই বলে, আরও জোরে উরিয়ে নিয়ে চলল । আর তখনি শুনতে পেলাম পেছনে গাছ পালা ভাঙার আওয়াজ । ইয়ুলা বলল , আর বুঝি পারলাম না। ওরা এসে পরেছে । যা বলছি মন দিয়ে শুনও ।

গির্জার বাম পাশে একটা ঘর আছে। সেখানে ফাদার থাকে। তিনি তোমাকে সাহায্য করবে। আমি পাথর হয়েই থাকলাম। কিছু বলতে পারছিলাম না।

পেছনে শব্দ গুলো বাড়তে লাগলো , কোনওমতে জঙ্গল তা পার হয়েই ইয়উলা আমার এক মুহূর্ত চেপে ধরলও । তারপর আমাকে দূরে ছুড়ে ফেলল । চিৎকার করে বলল , পালাও । আমি প্রানপন দোরাচ্ছি । প্রচণ্ড শব্দে পেছন ফিরে দেখি, তিন টা দানব যেন লড়াই করছে ।

গাছ গুলো ভেঙ্গে পড়ছে । আমি সব শক্তি দিয়ে ছুটছি । বেচে থাকার শেষ চেষ্টা । তবু পারলাম না। বুড়িটা এসেই আমার হাতে একটা কামড় বসিয়ে দিল।

অসম্ভব বেথায় আমি চিৎকার করে উঠলাম । আর তখনি ইয়উলা এসে বুড়ির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । আমি ছাড়া পেয়ে আবার ছুট লাগালাম । ওই তো গির্জা দেখা যাচ্ছে । বাম পাশের ঘরটাও দেখতে পারছি ।

ইয়উলা লড়াই করে চলছে । এক পর্যায়ে ওর বাবা মা ওর শরীর থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলল। আমি কোনও রকমে ফাদার এর দরজায় সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করেই লুটিয়ে পড়লাম ফাদার এর কাছে জানতে পেরেছিলাম, ওই বাড়িতে , এক কৃষক তার বউ আর মেয়েকে নিয়ে থাকতেন । একবার কিছু ডাকাত এসে তাদের কে নির্মম ভাবে খুন করে ফেলে রেখে যায় । সেই থেকে ওই বাড়ীর আশেপাশে কেও গেলে তাকে আর খুজে পাওয়া যেতনা।

ছোটো গলপ বাই ফাটা শারট আপনাদের ভালো লাগলে আরো লেখবো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।