সাধারন একজন
নিজের কথা গুলো অন্যের জবানীতে বলছি। ব্লগার ভাইরা ভেবে দেখবেন কি?
কোন একজন মানুষ প্রতি সপ্তাহে ৪৮
ঘণ্টা কিংবা তার থেকেও বেশি সময় শ্রম
দিয়ে যাবে কিন্তু বিনিময়ে তাকে কোন
সম্মানী দেয়া হবে না- এই
পুঁজিবাদী বিশ্বে এমনটাও
যে ঘটতে পারে তা হয়ত অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবে না। কিন্তু এই অবিশ্বাস্য
ঘটনাটিই আমাদের
দেশে ঘটে যাচ্ছে বছরের পর বছর
ধরে এবং আশ্চর্যের বিষয় হল যাদের
সাথে ঘটছে তারাও মুখ
বুজে ব্যাপারটা সহ্য করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িত
মানুষেরা হয়ত এতক্ষণে বুঝে গেছেন
আমি কী বলতে চাইছি। হ্যাঁ, আমি আমাদের
দেশের ‘অনারারি’ প্রথার কথাই বলছি।
যদিও নামে অনারারি কিন্তু বাস্তব
ক্ষেত্রে কোন ‘অনারিয়াম’ এর দেখা তারা কোন দিনই পাননা। আমাদের
দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার সমস্ত
হতাশাজনক বিষয়গুলোর
যদি একটা তালিকা করা হয় তাহলে বোধহয়
এই ‘অনারারি প্রথা’ সেই তালিকার
প্রথমদিকেই থাকবে। ফেসবুকে,ব্লগে, সংবাদপত্রে চিকিৎসকদের হতাশা-
বঞ্চনার ব্যাপারগুলো নিয়ে এখন অনেকেই
সোচ্চার কিন্তু অনারারি প্রথা’র মত
একটা অবাস্তব এবং মধ্যযুগীয়
প্রথা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। অথচ
আমাদের চিকিৎসকরা যে ব্যাপারগুলো নিয়ে সমলোচিত
হন সেই ব্যাপারগুলোর অনেক কয়টিরই উৎস
কিন্তু লুকিয়ে আছে এই অবাস্তব
সিস্টেমটির জটিল গোলকধাঁধার ভেতরে। চিকিৎসক এবং মেডিকেল
শিক্ষার্থীরা সবাই এই
অনারারি প্রথা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল।
চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িত নন এমন
মানুষদের জন্য এই
সিস্টেমটা আসলে কী তা একটু অল্প কথায় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। এম.বি.বি.এস. পাস
করার পর উচ্চতর
ডিগ্রি নিতে হলে চিকিৎসকদের
ট্রেনিং করতে হয়। উচ্চতর
ডিগ্রি মানে এফ.সি.পি.এস., এম.ডি., এম.এস.
প্রভৃতি। কোর্সভেদে ট্রেনিং এর মেয়াদ ভিন্ন ভিন্ন হয়।
প্রতিটা সরকারি হাসপাতালে কিছু
ট্রেনিং পোস্ট আছে।
অ্যাসিস্ট্যাণ্ট
রেজিস্টার, রেজিস্টার, আই.এম.ও.
এগুলো হচ্ছে ট্রেনিং পোস্ট। যে সকল
চিকিৎসক সরকারি চাকরি করেন, দুই বছর উপজেলায়
বা ইউনিয়নে কিংবা গ্রামে থাকার পর
তারা এই পোস্টগুলোতে আসেন এবং উচ্চতর
ডিগ্রি’র জন্য ট্রেনিং করেন।
যারা সরকারি চাকরি করেন
না কিংবা সরকারি চাকরি এখনো পাননি তারা ট্রেনিং করার জন্য হাসপাতালগুলোতে কাজ করেন
অনারারি অর্থাৎ অনারারি মেডিকেল
অফিসার হিসেবে এবং এদের
সংখ্যা নেহাৎ কম না। যেসকল
হাসপাতালে ট্রেনিং করা যায় সেই সব
হাসপাতালে ইন্টার্নিদের পর এরাই সবচেয়ে বড় ওয়ার্কফোর্স। কিন্তু দুঃখের
বিষয় হল, এদের শ্রমটা পুরোটাই
অবৈতনিক।
সম্পূর্ণ
বিনা বেতনে এরা দিনের পর দিন
মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এর
থেকে বড় তামাশা আর কী হতে পারে? কিন্তু শুধু মানবসেবা করলেই তো আর পেট
ভরে না। তাই পেটের তাগিদেই এই
অনারারিদের কাজ করতে হয় বিভিন্ন
ক্লিনিকে এবং শুনতে আশ্চর্য লাগলেও
সত্যি এই ক্লিনিকগুলোতে ডাক্তারদের
যে টাকা দেয়া হয় ঢাকা শহরে একজন রিকশাওয়ালা প্রতি ঘণ্টায় তার
থেকে বেশি টাকা উপার্জন করে! বিনা বেতনে মানবসেবা করার এই
প্রথা পৃথিবীর কোন সভ্য দেশেই নেই।
উন্নত দেশগুলোর কথা তো বাদই দিলাম,
আমাদের পাশ্ববর্তী দেশগুলো যেমন ভারত
কিংবা শ্রীলংকাতেও এইরকম বর্বর
প্রথা চালু নেই। বিনা বেতনে এই অমানুষিক কষ্ট করার
কথা শুনলে ওরা হাসে।
ঐ
দেশগুলোতে বিভিন্ন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট
ট্রেনিং কোর্সগুলোর জন্য
ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়। যারা চান্স পায়
তাদেরকে সবাইকে কিছু না কিছু টাকা দেয়া হয় জীবন ধারণের জন্য।
আমাদের দেশে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব
সীমিত পরিসরে এই সুযোগটা চালু
হয়েছে অল্প কিছুদিন হল। অন্য সব
জায়গাতেই অনারারিরা অনাহারী থেকেই মানব সেবা করে যাচ্ছে এখনো। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের
ক্যাজুয়ালটিতে অনারারি করতেন এমন
একজন ডাক্তারের সাথে কথা হচ্ছিল
কয়েকদিন আগে।
তিনি তাঁর
অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন।
ওখানে তিনি সপ্তাহে অন্তত একবার টানা ত্রিশ ঘণ্টা ডিউটি করতেন। তারপরও
মর্নিং কিংবা ইভেনিং তো করতে হতই।
সাথে ছিল পেট চালানোর জন্য প্রাইভেট
ক্লিনিকগুলোতে চাকরি। উনি যখন ঘর
থেকে বের হতেন তখন নাকি তাঁর
স্ত্রী তাকে কখনো জিজ্ঞেস করতেন না কখন আসবে;জিজ্ঞেস করতেন, কবে আসবে।
এটা শুধু
ঐ চিকিৎসকের না, দেশের অনেক
চিকিৎসকেরই জীবনের চিত্র। সামনেই বিএমএ নির্বাচন। দেশের
প্রতিটা মেডিকেল
কলেজে প্রতিটা প্যানেলের সভাপতি-
মহাসচিব পদপ্রার্থীরাই যাবেন
প্রচারণা চালাতে। খুব ভালো হয়,
যদি আমরা তখন এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের বর্তমান
নীতিনির্ধারকেরা কী চিন্তা করছেন
তা জানতে চাই, জোর দিয়েই জানতে চাই
এবং এর সংস্কারের দাবি জানাই।
যদি দেশের সব হাসপাতালগুলো থেকে এই
অমানবিক অনারারি প্রথার সংস্কারের দাবি ওঠে তাহলে তারা অবশ্যই বাধ্য
হবেন এই বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করতে।
আমাদের অন্তত এই বিষয়টা তাদের
কাছে পরিষ্কার করা উচিৎ যে দেশের
ডাক্তার সমাজ অবিলম্বে এই অভিশপ্ত
অনারারি প্রথার যুগোপযোগী সংস্কার দেখতে চায়। দরকার হলে আমরা,
চিকিৎসকরা পরীক্ষা দিয়ে পোস্ট
গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং এ ঢুকব। চান্স
না পেলে বার বার চেষ্টা করব। তবুও
আমরা এই মান্ধাতার আমলের
অনারারি প্রথার যুগোপযোগী সংস্কার চাই।
প্রীতম দে
ইণ্টার্নি চিকিৎসক,
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।