আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খালেদা জিয়ার ভারতপন্থী হওয়ার চেষ্টা-মুনতাসীর মামুন

সূত্র হতে পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন। বেগম খালেদা জিয়াকে দেখে সত্যিই ভাল লাগল। জানি খালেদাবিরোধীদের এ মন্তব্য ভাল লাগবে না। ভাল লাগবে না এ কারণে যে, বাঙালীর স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল। গত চার বছর টেলিভিশনে দেখেছিলেন খালেদা জিয়াকে? চুল উস্কোখুস্কো, মুখের বলিরেখা স্পষ্ট, সারামুখে বিরাগ অথবা বিরক্তি।

তিক্তস্বরে শুধু সরকারের গিবত গেয়েছেন, তাঁর কর্মীরা যথারীতি জ্বালাও-পোড়াওয়ে অংশ নিয়েছে। হঠাৎ পরিবর্তন! চীন সফর শেষ করে এলেন। ভারত সফরে যাবেন। দেখা গেল পরনে উৎকট রঙিন শাড়ি, চুল পরিপাটি, মুখে কখনও মৃদু কখনও বা একগাল হাসি। ঘোষণা করা হলো চীন সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ।

যেন তিনি প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের, চীনে গেছিলেন রাষ্ট্রীয় সফরে এবং চীন দ্বিতীয় পদ্মা সেতু করে দেবে, কুনমিং থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রাস্তা করে দেবে। কবে দেবে? কেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে। প্রধানমন্ত্রী হতে তো আর বেশি দিন নেই। চীন তিনি জয় করে এসেছেন, এখন যাচ্ছেন ভারত জয় করতে। এ কথা যখন ঘোষণা করলেন, তখন মুখে ভুবন ভোলানো হাসি।

যাক মনে খুব স্বস্তি পেলাম। যতদিন তিনি মৌতাতে থাকবেন, ততদিন অন্তত দেশে শান্তি থাকবে। এটি যদি এক বছর কনটিনিউ করে তা’হলে অন্তত সরকার এক বছর নিজের কাজকর্ম গুছিয়ে করতে পারবে। খালেদা জিয়ার চীন ও ভারত সফর বিএনপি-জামায়াত জোটকে অত্যন্ত আনন্দিত করে তুলেছে। জামায়াতের নেতারা ভাবছেন, মাটি কামড়ে যদি এক বছর পড়ে থাকা যায়, তা হলেই হলো।

ক্ষমতায় গেলে কোথায় যাবে যুদ্ধাপরাধ মামলা আর নির্বাচন কমিশনের হুমকি। বিএনপি নেতারা না হলেও খালেদা জিয়া ভাবছেন, তার সুপুত্ররা ফিরে আসবে এবং দেশে যাতে আওয়ামী লীগ করার মতো কেউ না থাকে সে ব্যবস্থা তিনি করবেন। আমি আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থককে দেখছি খুবই চিন্তিত, অনেক নীতিনির্ধারকও। চীন থেকেও তারা বেশি চিন্তিত ভারত নিয়ে। ভারত যদি এক তরফাভাবে সমর্থন না করে বাংলাদেশকে তা’হলে কি আওয়ামী লীগের পক্ষে আবার ক্ষমতা আসা সম্ভব হবে? তা’ হলে, বাজারে যে গুজব বিএনপি এলো বলে [সে গুজবের সত্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বেগম জিয়ার হাসি ও সফরে] তা’ কি সত্যি? পাঠক, আমাদের মতো দেশে ক্ষমতায় থাকা না থাকা অনেকটাই নির্ভর করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে ভারতের ওপরে।

বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে ভারত। নানামুখী চাপ সৃষ্টি করে সরকারের পতন ত্বরান্বিত করতে পারে ভারত। এ সব তত্ত্ব হয়ত অনেকাংশে ঠিক। কিন্তু এটিই সব নয়। নির্বাচন করবে বিভিন্ন দল।

মানুষ ঠিক করবে কোন্ দলকে ভোট দেবে। তারাই প্রধান নিয়ামক। চীনের কথা বলি। চীন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। ১৯৭৫ সালের পর করেছে।

সে জন্য বিএনপির ধারণা চীন বিএনপির অকৃত্রিম বন্ধু। চীন কখনও কারও অকৃত্রিম বন্ধু হয়নি। বন্ধুত্বের দাম এক সময় দিত সোভিয়েত ইউনিয়ন। পুঁজিবাদী চীন সব রাষ্ট্রেই সমান মনোযোগ দেবে। চীন সুপার পাওয়ার।

বাংলাদেশের কৌশলগত মূল্য আছে তার কাছে। তবে চীন উৎসাহী বিনিয়োগে। বেগম জিয়ার মতো অনেক দেশের সরকারী নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা চীনে যাচ্ছে হরদম। চীন সাবাইকে যথাযথ আপ্যায়ন করে, বেশিমাত্রাই করে এবং সবাইকে সবকিছু করে দেয়ার আশ্বাস দেয়। এতে খুব আশ্বান্বিত বা বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।

পদ্মা সেতু বা কুনমিং চট্টগ্রাম রাস্তা হাতের মোয়া নয় যে বললেই দেয়া যাবে। বেগম জিয়া হয়ত জানেন বিষয়টা। কিন্তু এখন তাঁকে পারফর্ম করতে হবে। পারফর্মারের মতো। তা তিনি করছেন।

চীন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভাবিত নয়। চীন জানে, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক অটুট থাকবে, যেমন থাকে আমেরিকার সঙ্গে। বেগম জিয়া একেবারে বোধহীন রাজনীতিবিদ, তা তো নয়। তিনি অনুধাবন করেছেন ২০১৪ সালের নির্বাচনে তাঁকে যেভাবেই হোক ক্ষমতায় যেতে হবে, সেটি গণতান্ত্রিক-অগণতান্ত্রিক যে পথেই হোক না কেন। না হলে আরও পাঁচ বছর তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে।

তখন তাঁর বয়স হয়ে যাবে সত্তরের অনেক বেশি। বাংলাদেশে কেউ রিটায়ার করে না। তিনিও করবেন না। তবে বয়স একটা ফ্যাক্টর তো বটে। তাঁর সুপুত্ররাও পাঁচ বছর দেশে আসতে পারবে না।

কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা মওদুদ আহমদ বা মির্জা ফখরুল তো এতদিন অপেক্ষা করবেন না। তাঁরা নতুন দল গড়বেন বা দল বদল করবেন। তাঁদের পথ অনুসরণ করবেন অনেকে। ২০১৯-এর নির্বাচনেও তা’হলে জেতার চান্স নেই। তাঁর একমাত্র রাজনৈতিক আদর্শ আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করা ও পাকিস্তানের পক্ষে থাকা।

তাঁর বিশ্বস্ততা আসলে পাকিস্তানবাদের প্রতি। বেগম জিয়ার ধারণা ভারত অনুকূলে না থাকলে নির্বাচনে বোধহয় জেতা যাবে না। বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের আগ্রহ বেশি। সুতরাং ভারতকে সন্তুষ্ট করতে তিনি মরিয়া। বেগম জিয়ার ভারত ত্যাগের আগে ভুবন মোহিনী হাসি ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হাস্যমুখর আলোচনা রবীন্দ্রনাথের একটি গান বার বার মনে করিয়ে দেয়।

‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়…। ’ মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা নিতে আসা ভারতীয় সাংবাদিক ও এ্যাকাডেমিশিয়ানদের সঙ্গে কথা বলে একটি সূত্র পাওয়া গেল। সাউথ ব্লকের খানিকটা পাকিস্তানপ্রীতি আছে। সাউথ ব্লক যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের পূর্ব পুরুষদের অনেকের আদি নিবাস পাকিস্তান। তাদের একাংশের মনে একটা ভাবনা এ রকম, বাংলাদেশ অন্যান্য যে কোন দেশের মতো একটা দেশ।

ক্ষমতায় যে-ই থাকুক তাতে ভারতের কিছু যায় আসে না। ভারত তার নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক স্বার্থ অক্ষুণœœ ও অটুট রাখতে চায়। সুতরাং সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা ঠিক হবে না। সব দল ভারতের বন্ধু। সব দল ভারতের শত্রু।

সুতরাং, আওয়ামী লীগ প্রীতি যা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট দেখিয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতের কংগ্রেসের এখন নড়বড়ে অবস্থা। সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সব সময় ঝুঁকির মুখে আছে কংগ্রেস। সে জন্য সাউথ ব্লকের এ তত্ত্বনীতি নির্ধারকরা হয়ত গ্রহণ করেছেন বা করতে বাধ্য করেছেন। কারণ এই নীতির পেছনে একটা রাজনৈতিক শক্তিও আছে কিন্তু বলে রাখা ভাল, এর বিপক্ষের দলও কম শক্তিশালী নয়।

একটা কথা আমরা ভুলে যাই বিশেষ করে তাত্ত্বিকরা যে, চিরাচরিত ধারণা ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে খাটে না। গবেষণা করে দেখেছি ভারতে কংগ্রেস জোট এবং বাংলাদেশে আওয়ামী জোট ক্ষমতায় থাকলে দু’দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়। এর কারণ ঐতিহাসিক। ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু মুজিব এর অনুঘটক। তা’ ছাড়া দুটি দলেই মধ্য মৃদু বামের একটা প্রভাব আছে।

ভারতে দক্ষিণপন্থী এবং বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থী দল ক্ষমতায় থাকলে দু’পক্ষের সম্পর্কের অবনমন হয় না কিন্তু সম্পর্কের তেমন উন্নয়নও হয় না। বাংলাদেশ কিছুই পায় না। হিসাবটা মিলিয়ে দেখুন ভুল হলে জানাবেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ভারত যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা অন্য কোন দলকে ভারত কখনও দেয়নি। বলা যেতে পারে, এ প্রতিশ্রুতির কতটা পূরণ করতে পেরেছে ভারত? হয়ত সবটা এখনও পারেনি।

কিন্তু এক বছর বাকি আছে। দেখা যাক! সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে যদি ভারতে নির্বাচন হয় এবং কংগ্রেস যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তা’হলে সে মমতার মতো পার্টনারদেরও পাত্তা দেবে না। তখন কংগ্রেস বিএনপি ইকোয়েশনটা কী হবে? বা কংগ্রেস ক্ষমতায় এলো না। কে আসবে তাও নিশ্চিত নয়। নিশ্চয় কোয়ালিশন হবে।

তা সে কোয়ালিশন খোয়াখোয়ি করবে না খালেদা-হাসিনা দেখবে। এবার মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা নিতে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ভারত যে খালেদাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাতে তাঁরা মহাবিরক্ত। তাঁদের যুক্তি সোজাসাপটা, শেখ হাসিনা খোলা মনে কোন তাস আঁচলে না ঢেকে কথা বলেছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং প্রতিশ্রুতি রেখেছেন।

ভারতকে তার প্রতিশ্রুত রাখতে হবে। যেসব নীতিনির্ধারক এরশাদ-খালেদাকে আমন্ত্রণ জানানোর কৌশল নিতে বলছেন তাঁরা ভ্রান্ত। কারণ তারা ইতিহাস জানে না। তাঁরা এসব ভ্রান্ত মতের বিরোধিতা করবেন দেশে গিয়ে। তাঁরা আরও জানিয়েছেন, সাউথ ব্লকের এসব মাতব্বরিতে ভারত সীমান্তের ছয়টি রাজ্য খুবই অসন্তুষ্ট।

তাদের নীতিনির্ধারকরা নাকি জানিয়েছেন শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে তাদের মাশুল দিতে হবে এবং এ মাশুল তারা একা নয় কেন্দ্রকেও দিতে হবে। তাঁদের অনেকে বলেছেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ১৯৭১ থেকে। সেই মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত যে ক’বার তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়েছে জিয়ার, একবারও তিনি ভারতের পক্ষে একটি কথাও বলেননি। খালেদা তাঁর স্ত্রী। ৩৫ বছর ধরে যে নীতি পালন করে এসেছে বিএনপি তা হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই বাদ দিয়ে দেবে তা কখনও হয়? তাঁদের মতে, বিএনপির এটি সাময়িক কৌশল।

কারণ খালেদা যদি আন্তরিকও হন তাঁর সমর্থকরা তা মানতে রাজি হবে কেন? তারা ভালবাসে পাকিস্তানবাদকে। যদি তা ত্যাগই করতে হয় তা’হলে আওয়ামী লীগ করলে দোষ কী? খালেদা জিয়া শুধু চান ভারত সরকার তাঁকে নিয়ে একটু মাতামাতি করুক, তা’হলে বাংলাদেশে জনমনে এ গুজব দৃঢ়ভাবে শেকড় ছড়াবে যে, ভারত বিএনপিকে সমর্থন করছে তা’হলে বিএনপিই ক্ষমতায় আসবে। সুতরাং হিসাবটা কিন্তু এত সহজ বলে মনে হচ্ছে না। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দেখা করার আগে বেগম জিয়ার নামে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, যেখানে তিনি ভারতপ্রীতির কথা উল্লেখ করেছেন। চীন-ভারত সফরের তারিখ দু’সপ্তাহের মধ্যেই রেখেছেন।

যাতে এর ইতিবাচক খবর অভিঘাত হানে। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র বলেছেন বাংলাদেশের মাটি ভারতীয় বিছিন্নতাবাদীদের ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে সব সময় বলেছেন, বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোন ঘাঁটি নেই। এখন তাঁর কথা শুনে মনে হচ্ছে, আগে ছিল এখন আর হতে দেবেন না। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, বেগম জিয়ার কথামতো যদি বিছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটি না থাকে তা’হলে শেখ হাসিনা কাদের বহিষ্কার করলেন? কেন ভারত ও আমেরিকা শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানাল? শেখ হাসিনা বিছিন্নতাবাদীদের শক্তি বিনষ্ট করে দিয়েছেন।

খালেদার আশ্বাসে এখন কিছুই আসে যায় না। ভারত কি ভুলে গেছে। হাসিনা যখন বিছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, তখন খালেদা জিয়া জোরাল ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ওরা বিছিন্নতাবাদী নয়। ওরা দেশপ্রেমিক। হাসিনা ভারতীয় দেশপ্রেমিকদের হেনস্থা করছেন।

এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, উলফা বা অন্যদের যুদ্ধও এক ধরনের মুক্তিযুদ্ধ। একটু পিছিয়ে যাই গতবারের ঘটনাটা একটু মনে করিয়ে দিতে চাই। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ পরিচিত ভারত সমর্থক হিসেবে। বিএনপি-জামায়াত পরিচিত ভারতবিরোধী হিসেবে। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে এবং ভারতের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয়, তখনই বিএনপি- জামায়াত প্রবলভাবে ভারতবিরোধী প্রচারণা শুরু করে যার মূল বক্তব্য, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে বা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকলে তাকে ভারত সমর্থন জানায় এ কারণে যে, আওয়ামী লীগ ভারতের কাছে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেবে।

এর আরেকটি কারণ হতে পারে যে, ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সমস্যাসমূহের মীমাংসা হলে ভারতবিরোধী রাজনীতি কার্যকর হবে না এবং এই ধরনের ভারতবিরোধী আক্রমণ শুরু হলে আওয়ামী লীগ রক্ষণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করে। আবার বিএনপি বা বিএনপি-জামায়াত যখন ক্ষমতায় থাকে তখন ভারতবিরোধী কোন প্রচারণা তারা করে না। এ থেকে আবার প্রমাণিত হয়, ভারতকে তারা ভয় করে। ক্ষমতায় আসার জন্য বা ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকারীভাবে তারা ভারতের বিরোদ্ধাচারণ করে না। আরেকটি বিষয় হলো, সাধারণ মানুষ বোঝার চেষ্টা করে ভারত কোন্ পক্ষে আছে বা যাবে।

যে পক্ষে তারা মনে করে ভারত আছে বা থাকবে সে পক্ষকে আবার অবলীলাক্রমে ভোট দেয়। অবশ্য, অভ্যন্তরীণ অবস্থা ভোটের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, এ ক্ষেত্রে দুটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই বিজেপি কোয়ালিশন ভারতে ক্ষমতায় আসে। বিএনপি-জামায়াত ভারতবিরোধী প্রচারণা চালালেও, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক শীতল হয়ে আসে। ট্রানজিট এবং বাংলাদেশ থেকে গ্যাস সরবরাহ প্রস্তাব এলেও আওয়ামী লীগের পক্ষে কোন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি।

বরং শেখ হাসিনাকে ঘোষণা করতে হয়, পঞ্চাশ বছরের গ্যাস মজুদ রেখে বাংলাদেশ গ্যাস রফতানির কথা চিন্তা করবে। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই জনমনে এই ধারণা গড়ে ওঠে যে, হাসিনার এই ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এ অনুমানটির যে ভিত্তি আছে তার প্রমাণ ভারতীয় ওয়াকিবহাল এক সম্পাদকের রিপোর্ট। একটি রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেছেন “…হাসিনা ভালভাবেই জানতেন যে বাজপেয়ী ও এলকে আদভানির মনে একটা বাড়তি ক্ষোভ জমা হয়ে রয়েছে কারণ কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের স্বার্থ উপেক্ষা করে ভারত গঙ্গাজল ভাগাভাগি নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছনোর চেষ্টা করলেও তিনি (হাসিনা) বাংলাদেশ থেকে ভারতে গ্যাস রফতানি করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে অস্বীকার করেছিলেন। পদস্থ ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার সময় হাসিনাকে ভারতের তরফ থেকে বার বার এ কথা শুনতে হয়েছে, ‘গঙ্গা পানিকে বদলে সে হামে কেয়া মিলা?’ ভারতকে সরবরাহ করার মতো পর্যাপ্ত গ্যাসের ভা-ার বাংলাদেশের নেই হাসিনার এই যুক্তিতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

এর কারণ হলো তাঁর প্রধান প্রতিশ্রুতি বিএনপির খালেদা জিয়া ও তাঁর পুত্র তারেক বিজেপী নেতৃত্বকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ২০০১-এর সংসদীয় নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এলে তাঁরা পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করার জন্য উদ্যোগী হবেন। মাতা-পুত্র দু’জন ভারতের নীতিনির্ধারকদের এটা বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন যে তারাই ভারতের স্বার্থ ভালভাবে দেখতে পারবেন। তারেক জিয়া তৎকালীন ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারকে এ কথাও বলেছিলেন, ‘আমরা যেহেতু ভারতের দালাল নই, তাই বাংলাদেশীরা ভারতকে আমাদের গ্যাস বিষয়টি বিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করবে, কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার সেটা করতে গেলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণœœ হচ্ছে বলে কথা উঠবে। ’ ভারতীয় নীতি প্রণেতাদের বোকা বানাতে তারেক ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের এক অফিসারের মাধ্যমে এই বার্তাও ছড়িয়ে দেন যে ‘ব্যবসা করতে হলে বিএনপিই ভাল বাজি। পরে এক ভারতীয় গোয়েন্দা অফিসার তারেককে মুম্বাইয়ে একটি বড় কর্পোরেট হাউসে নিয়ে যান ভারত- বাংলাদেশ গ্যাস পাইপ লাইন পাতার পরিকল্পনা করছিল।

খালেদা তাঁর পুত্র গ্যাস ইস্যুতে ভারতকে যে বিভ্রান্ত করছিল তা অনেকদিন পর ধরা পড়ে। কিন্তু ততদিনে তাঁরা ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরিকল্পনাকারী পাকিস্তানের আইএসআই মদদপুষ্ট জেহাদী গোষ্ঠীগুলোর অভয়ারণ্যে পরিণত করে ফেলেছে বাংলাদেশকে। ১০২ শেখ হাসিনার শেষ সময়ে বিডিয়ার বিএসএফ সংঘর্ষে ১৬ (?) জন বিএসএফ সদস্য নিহত হয় এবং বিডিআর সে সব লাশের যথাযথ মর্যাদা না করার আলোকচিত্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এটি কতটুকু সত্য তা আলোচ্য নয় কিন্তু তারেক জিয়ার ভারত সফর ও এই ঘটনা এ ধারণাই সৃষ্টি করে যে, আগামী নির্বাচনে ভারত বিএনপিকে সমর্থন জানাবে। নির্বাচনে যে বিএনপি জোট জিতবে সে ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়।

২০০১ সালের নির্বাচনে দেখা গেল, জনগণের আশঙ্কাই সঠিক হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। এ প্রসঙ্গে ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর লেখেন, “সংবিধান অনুযায়ী প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান সরকারপ্রধান হলো। দেখা গেল, নীতিহিসেবে ন্যায়নীতি তাঁর অজানা। ৪২ ভাগ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ লাভ করে সংসদের ৬২টি আসন কারণ বিএনপি সরকারের সঙ্গে মিলে ভোট কারচুপি করে।

বিএনপি নিয়েছিল ৩৮ ভাগ ভোট। জামায়াত পায় ১৪ ভাগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেখায় বিএনপি-জামায়াত জোট পেয়েছে ২৩৮টি আসন। আমার নির্বাচনী এলাকায় [আওয়ামী লীগ সরকারের তিনি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী] পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে টাকা দিয়ে কিনে নেয়া হয়। আমাদের কর্মী ও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রের ধারে কাছে ভিড়তে দেয়া হয়নি।

সংখ্যালঘু ভোটাদেরকে পিটিয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয় এবং তাদের ভোটগুলো দেয়া হয় বিএনপি পক্ষে। ”১০৩ অন্যদিকে বিজেপিও ভারতে ক্ষমতায় আসীন হয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসেন। বিএনপির অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন গ্যাস মাটির নিচের জন্য নয়, তা বিক্রি করার জন্য। টাটা প্রস্তাব নিয়ে আসে তারা একটি ইস্পাত মিল গড়তে চায় বাংলাদেশে, যা সম্পূর্ণভাবে হবে গ্যাসনির্ভর এবং স্বল্প দামে তা সরবরাহ করা হবে।

ট্রানজিটের বদলে অন্য শব্দ ব্যবহার করে ট্রানজিট ভারতকে দেয়া যায় কিনা সেটিও আলোচনায় আসে। তখন ভারত বিরোধিতা না করলেও আওয়ামী লীগ ও অন্যরা প্রশ্ন তোলেন যে দল কয়েকদিন আগে মাত্র এসব ইস্যুতে বিরোধিতা করেছে তারা এখন সে সব ইস্যুর পক্ষে কিভাবে অবস্থান নেয়? দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দলের কাছে সরকারের অধঃস্তনতা সবকিছু তাদের পূর্ববর্তী আমলের রেকর্ড ভঙ্গ করে। কালো টাকা এত পুঞ্জীভূত হয় যে, সরকার তা সাদা করার জন্য ভাল ব্যবস্থা গ্রহণ করে যার ফলে শুধু ব্যবসায়ীরাই নয়, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ডাক্তার, পুলিশ, রাজনীতিবিদ, সরকারী চাকুরেও লাভবান হয়। ১০৪ দুর্নীতিকে আর অপমানজনক মনে হতো না। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রণালয়ের সচিব ঘোষণা করেন, সবাই দুর্নীতি করে তাই তিনিও দুর্নীতি করেন।

১০৫ ৫০,০০০ কোটি টাকার কালোবাজারি মামলা স্থগিত রাখা হয়। কারণ মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, পুলিশ, সরকারী কর্মচারী, কূটনীতিবিদদের নেটওয়ার্ক সহায়তা করেছে স্মাগলারদের। ১০৬ দুর্নীতিতে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ পর পর তিনবার প্রথম হয়। বিএনপি-জামায়াত জোটের পাঁচ বছর ছিল বাংলাদেশের জন্য নরকতুল্য। আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘুদের ওপর প্রচ- অত্যাচার শুরু হয়।

সংখ্যালঘুদের অনেকে দেশ ত্যাগ করতে থাকেন। অন্যদিকে, সরকার দেশের অভ্যন্তরে উগ্রবাদী জঙ্গী সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া শুরু করে। ১০৭ উলফার ঘাঁটি তৈরি হয় বাংলাদেশে, যা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে। মিয়ানমারের আরাকান থেকে উগ্রবাদীরা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে থাকে। এ সময় দশ ট্রাক অস্ত্র হঠাৎ ধরা পড়ে।

অনুমান করা হচ্ছিল এগুলো ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য আনা হয়েছে, যা পরে প্রমাণিত হয়েছে। তখন তদন্ত অসমাপ্ত রাখা হয়। আইএসআই সক্রিয় হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা হয়, তাঁকে কয়েকবার হত্যার চেষ্টা হয়। ১০৮ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকে হত্যা করা হয়।

জেলে নেয়া হয় অনেককে। ১০৯ উগ্র জঙ্গীবাদীরা বিভিন্ন জায়গায় হামলা শুরু করে। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চরম আকার ধারণ করে। ১১০ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন বিষয়ে তখন অগ্রগতি হয়নি। বেসরকারীভাবে ভারতীয় সরকারের কর্মকর্তা ও অন্যদের সঙ্গে সাক্ষাতকারের এসব বিষয়, বিশেষ করে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও উত্তর-পূর্বে ভারতে উগ্রবাদীরা পরস্পরকে সহায়তা করে সেখানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, এ নিয়ে আলোচনা হয়।

কিন্তু ভারত সরকারের তরফ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এবং তখন জনমনে এই ধারণা হয় যে, ভারতের সমর্থন আছে এই সরকারের প্রতি সুতরাং অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এ সময় লক্ষণীয় যে, ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা নেয়। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী পাকিস্তান সফরে যান। পাকিস্তানের সঙ্গে বাস সার্ভিস চালু হয়।

বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়নের কোন প্রচেষ্টাই তখন নেয়া হয়নি। বরং এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, ভারতের রাডারে বাংলাদেশ নেই। এরই মধ্যে বাম দলের সমর্থন নিয়ে কংগ্রেস কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। এই সরকার পূর্ববর্তী সরকারের নীতি বজায় রাখলেও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যে বাংলাদেশ সহায়তা করছে সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। ভারতে বাংলাদেশের অবৈধ অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়, যা বাংলাদেশ অস্বীকার করে।

সীমান্ত সংঘর্ষ বৃদ্ধি পায়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। দুর্নীতির দায়ে তারা উভয় দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনাকেও গ্রেফতার করলে জনমত সামরিক সরকারের বিপক্ষে চলে যায়। এ পরিস্থিতিতে ভারত নতুন বাঙালী রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে প্রেরণ করে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ভারত সফরে যান।

তাঁকে পরম অভ্যর্থনা জানানো হয়। বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করে ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায়। একজন বাঙালী (প্রণব মুখার্জী) পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন, যার সঙ্গে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠতা সবার জানা। সবাই আশা করতে থাকে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে এবং এর পরই বাংলাদেশের পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। দুই নেত্রীকে মুক্তি দেয়া হয় এবং সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়।

ভারতীয় মন্ত্রীদের কয়েকজন ঢাকায় আগমন করেন বিভিন্ন উপলক্ষে এবং এ ঘোষণা দিতে তাঁরা দ্বিধা করেননি, তাঁরা বাংলাদেশে একটি অসাম্প্রদায়িক সরকার আশা করেন। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বিভিন্ন কর্মকা- ও বক্তব্যে অনুমিত হয় যে, তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সামরিক সরকার অথবা বিএনপি-জামায়াত সরকার পছন্দ করবে না। ইতোমধ্যে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতে সরকার গঠিত হয়। কোয়ালিশন হলেও কংগ্রেসই প্রধান হয়ে ওঠে, ড. মনমোহন সিং পুনর্বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। জনমনে এই ধারণা হয় যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতবে।

প্রথমত দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা গত সাত বছরে এমন নরকতুল্য হয়ে উঠেছিল যে, মানুষজন আশা করছিল আওয়ামী লীগ সরকার এ থেকে তাদের মুক্তি দেবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে পরিষ্কার ঘোষণা করা হয়েছিল, নির্বাচনে জিতলে তারা ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি, ট্রানজিট এবং ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সমস্যাসহ দ্বিপাক্ষিক সমস্যাগুলোর সমাধান করবে। ফলে জনগণের মনে আরেকটি ধারণা জন্মে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে এবং সেনাবাহিনী ‘নিরপেক্ষ’ থাকবে। দেখা যায়, ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। তিন দশক পর আবার বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং কোয়ালিশন হলেও ভারতে কংগ্রেস প্রবলভাবে ক্ষমতাসীন হয়।

দু’পক্ষই ঘোষণা করে দ্বিপাক্ষিক সব সমস্যার তারা সমাধান করবে। এবং ক্ষমতায় আসার পরই শেখ হাসিনা সে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এবং ভারত সাড়া দেয়। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। ভারত-বাংলাদেশ ৫০টি অনুচ্ছেদের এক যৌথ বিবৃতি দেয়, যাতে বলা হয় গত তিন দশকের জমে থাকা সব সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হবে ও কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

১৯৭৫ সালের পর আবার ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন দিক উন্মোচিত হয়। এ ইতিহাস বিবৃত করলাম এ কারণে যে, এত তাড়াতাড়ি ভারত নিশ্চয় এসব ভুলে যায়নি। মাত্র দশ মাস আগে খালেদা জিয়া বিবিসিকে এক সাক্ষাতকারে বলেন, “বর্তমান সরকার দেশের যা কিছু আছে সবই তলে তলে ভারতের হাতে তুলে দিচ্ছে। সরকার দেশের ও দেশের মানুষের পক্ষে কথা বলছে না। সরকার অন্য দেশের হয়ে কাজ করছে।

কাজেই বর্তমান সরকার যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততই দেশের ক্ষতি হবে। দেশের সর্বনাশ হবে। ” [জনকণ্ঠ, ১২.১২.১১] কুষ্টিয়ার জনসভায় তিনি বলেন, “এ সরকার ভারতীয়দের সরকার। তাদের কথামতো দেশ পরিচালনা করছে। সীমান্তে প্রতিনিয়ত মানুষ হত্যা করে।

বিএসএফ এ দেশের জায়গা-জমি দখল করে কিন্তু এ সরকার প্রতিবাদ করে না। ” [ওই ২৭.১১.১১] এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি সুস্পষ্টভাবে দুটি বিষয় তুলে ধরেছেন- ১. “স্বাধীনতার পর তারা ভারতের সঙ্গে ২৫ বছরের গোলামি চুক্তি করেছিল। তখন পুরোপুরি এ চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তাই এখন ক্ষমতায় এসে এ চুক্তি বাস্তবায়ন করছে। ” ২. “তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না দিলে ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট, করিডরসহ সব ধরনের ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ার আহ্বান জানান।

” [ওই ২৮.২.১২] পল্টনের এক সমাবেশে এর আগে বলেছিলেন বাংলাদেশের বুকের ভেতর দিয়ে ট্রানজিটের কোন গাড়ি চলতে দেয়া হবে না, হবে না। বাংলাদেশকে পুরোপুরি ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেছে এই সরকার। প্রধানমন্ত্রী ভারতে গিয়ে দেশ বন্ধক দিয়ে এসেছেন। ” [ইত্তেফাক ৮.১১.১০] আরও আগে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে সাভারে দেযা বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন এখন থেকে মসজিদে মসজিদে উলুধ্বনি হবে। অর্থাৎ ভারত জোর করে সব মুসলমানকে হিন্দু বানাবে।

১৯৯৬ সালের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি হলে বলেছিলেন, ফেনী থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত সব ভারতের অধীনে চলে যাবে। ১৯৪৭ সালের পর এত কদর্য ভাষায় এমন সাম্প্রদায়িক উক্তি আর কোন রাজনৈতিক নেতা করেননি। এটি তার মনের কথা। এ জন্যই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির এত মহব্বত। তাহলে দেখা যাচ্ছে, জিয়াউর রহমানের সময় থেকেই বিএনপি চরম ভারত ও হিন্দুবিদ্বেষী।

এবং এ ধারাবাহিকতা খালেদার ভারত সফরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ছিল বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, এর আগেও ভারত সরকারকে কথা দিয়ে কথা রাখেননি। ভারত যাওয়ার আগে খালেদা জিয়া বলেছেন, এখন থেকে তাঁরা মন বদলাচ্ছেন। দিল্লী গিয়ে মনমোহন সিংকে বলেছেন, ‘প্লিজ, ভেবে দেখুন। ’ আওয়ামী লীগ ভারতের কাছে যেসব দাবি করেছিল খালেদাও সেসব দাবি করেছেন।

তিনি যেটা বলতে চাইছেন তাহলো ক্ষমতায় গেলে তিনি আওয়ামী লীগের বন্ধুত্বপূর্ণ নীতি অনুসরণ করবেন। খালেদাকে কোন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কি না তা আমরা জানি না। তাদের সঙ্গে মূল কী কথাবার্তা হয়েছে তাও খালেদা বা মনমোহন সিং ছাড়া কেউ জানবেন না। এখন যেসব লেখালেখি হবে তার সবই অনুমাননির্ভর। যেহেতু ক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্ন সেহেতু ভারতের জিজ্ঞাসা থাকতে পারে।

সংবিধান অনুযায়ী খালেদা নির্বাচনে যাবেন কি না? না গেলে ক্ষমতায় যাবেন কিভাবে? ক্ষমতায় না গেলে যা দেবেন বলছেন তা দেবেন কিভাবে? আন্দোলন করে তিনি ক্ষমতা হাতে পাবেন কি না? এ প্রশ্নের উত্তর তিনি কী দিয়েছেন তা জানা যাবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করলে। সংখ্যালঘুদের প্রশ্নে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী? এ বিষয়ও ভারত জানতে চাইতে পারে। এবং এক্ষেত্রে খালেদা পটভূমি তৈরি করে গেছেন। বিএনপি-জামায়াত রামুতে বৌদ্ধদের ওপর হামলা করে তাদের সব মন্দির ধ্বংস করেছে। খুব ভেবেচিন্তেই কাজটি করা হয়েছে।

কারণ খালেদা জানেন, পাকিস্তানীমনা হিসেবে তাঁকে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। এখন তিনি তুরন্ত বলবেন, আওয়ামী লীগ আমলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। আওয়ামী লীগের লোকেরাই আগে মিছিল করেছে। তবে সবচেয়ে কঠিন যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাহলো উগ্র মৌলবাদ যা তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াত ছড়িয়েছিল তার কী হবে? এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার চলবে কি না? দুটি প্রশ্নের উত্তরই আপাতত হ্যাঁ হবে। কিন্তু আমরা জানি, ক্ষমতায় গেলে এ দুটি প্রশ্নের উত্তর হবেÑ না।

কারণ খালেদা জিয়া নিজের ও পুত্রদের আখের গোছানোর জন্য পাঁচ বছর সময় চান। কয়েক দিন আগেও তিনি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। বাংলাদেশে বিএনপি এখন যুদ্ধাপরাধ সমর্থনকারী দল হিসেবে পরিচিত। মৌলবাদীদের প্রশ্ন এখনও তিনি কিছু বলেননি। একজন প্রৌঢ়ার মিনতিতে একজন প্রৌঢ়ের মন গলবেই, কূটনীতি এমন সোজা নয়।

তবে আওয়ামী নীতি গ্রহণ করে তিনি মনমোহন সিংয়ের সমবেদনা হয়ত কুড়াতে পারবেন। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, জেনারেল এরশাদকেও ভারত আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তুরন্ত তিনি ছুটে গেছেন দিল্লীতে। দিল্লীর ক্ষমতা তিনিও জানেন। দিল্লীওলারা এও জানে সুযোগ পেলেই এরশাদ খালেদাকে সমর্থন জানাবেন।

আসলে কূটনীতির সাফল্য নির্ভর করে দেশের ওজনের ওপর। আমাদের নেতারা ক্ষমতায় গেলে ভাবেন, দেশের ওজনটা বোধহয় খুব বেশি। আর তাদের ওজন তো দেশের থেকেও বেশি। আসলে ওজন অত বেশি নয়। তাই বড় দেশের ডিক্টাট আমাদের মেনে চলতে হয়, হবে।

ওজনদার হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে। বন্ধু বদলানো যায়, প্রতিবেশী তো বদলানো যাবে না। তাই আওয়ামী লীগ ভারতের প্রতি সহনশীল বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। ভারতের নতুন তাত্ত্বিকরা বিএনপিকে যতই ভারত বন্ধু বলে মনে করুক আমরা তো জানি, কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। আর এও জানি ভারত প্রায় ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়।

ভারত শুধু বঙ্গবন্ধুর সময় এবং শেখ হাসিনার সময় কিছু প্রতিশ্রুতি পালন করেছে। ইন্দিরা সব প্রতিশ্রুতি রেখে ছিলেন। কিন্তু উপমহাদেশের পরবর্তী রাজনীতিবিদরা তো ইন্দিরা ও বঙ্গবন্ধুকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। আবার আমেরিকা, চীন এমনকি পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও ভারত প্রতিশ্রুতি রাখবে। তাদের তারা ভয় করে।

সেক্ষেত্রে তাদের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অবস্থা বাংলাদেশের মতো। সুতরাং ভারত হাসিনাকেও চাপে রাখার জন্য খালেদার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শুধু বজায় নয়, তাকে সাহায্যও করতে পারে। তাতে আওয়ামী লীগের খুব একটা ক্ষতি হবে না। খালেদা, নিজামী এবং বিএনপি-জামায়াত কী জিনিস তা আমরা হাড়ে হাড়ে জানি। সে জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতও আমরা।

কারণ আওয়ামী লীগের ভুলের মাসুল আমাদের দিতে হবে নেতাদের নয়, তারা কখনও দেয়নি, প্রয়োজনে তারা দেশত্যাগ করবে [আ. লীগ নিযুক্ত অধিকাংশ উপদেষ্টা ক্রাইসিসে প্রবাসে সময় কাটিয়েছেন, নেতা-মন্ত্রীদের অনেকেও] অথবা সংস্কারবাদী হবেন। কিন্তু আমরা জানি খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসামাত্র কমপক্ষে কুড়ি লাখ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হবে। মিয়ানমার থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত ভারতের ‘দেশপ্রেমিকদের’ ব্যবহার করতে দেয়া হবে। কার্যত আইএসআইয়ের নির্দেশে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি কার্যকর হবে। পাকিস্তানবাদ আরও দৃঢ় হবে।

‘হাম হ্যায় পাকিস্তানী’ এ সঙ্গীতই হয়ত জাতীয় সঙ্গীত হবে [জাতীয় সঙ্গীত বদলাবার প্রস্তাব বিএনপির নেতারা দিয়েছিল] ভারতে গিয়েও বিএনপি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেছে। সে জন্যই বলেছিলাম কয়লা ধুলেই ময়লা যায় না। যে ভারত ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করেছে স্বাধীনতার আহ্বায়ক হিসেবে সে ভারতে গিয়ে যদি বিএনপি নেতারা সরাসরি মিথ্যা বলে এখন, তাহলে ভবিষ্যতে? সুতরাং ভারত যদি তার সীমানায় দুই প্রান্তে দুটি পাকিস্তান নিয়ে থাকতে চায় তাতে আমাদের অসুবিধা কী? ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.