আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আনিসুল হকের সুত্র

মিজান রহমান শ্রেষ্ঠ নিউটনের চতুর্থ সূত্রটি অনেক আগেই আবিষ্কৃত ছিল, সম্প্রতি সেটি মান্য করা হচ্ছে। সূত্রটি হলো, একজন মানুষের জনপ্রিয়তা টেলিভিশনের মাইক্রোফোনের সামনে উচ্চারিত তাঁর কথামালার বিপরীত আনুপাতিক। অর্থাৎ যিনি যত বেশি কথা বলবেন, তাঁর জনপ্রিয়তা তত কমবে। এটা শত শত বছর আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে। এ কারণেই লোকে বলে, নীরবতা হীরন্ময়।

বলা হয়ে থাকে, তোমাকে দুটো কান আর একটা মাত্র মুখ দেওয়া হয়েছে। দু কান দিয়ে তুমি বেশি শুনবে, একটা মুখ দিয়ে তুমি খাবে, থুতু ফেলবে, হাসবে, কাঁদবে এবং মাঝেমধ্যে কথা বলবে। কিন্তু এই যুগে নীরব থাকা মুশকিল। কারণ, এই যুগে টেলিভিশন নামে একটি যন্ত্র প্রচলিত হয়েছে, যার একটা চোঙ থাকে, যেটা নেতা-নেত্রীদের সামনে ধরা হয় এবং বলা হয়, কথা বলুন। কথা বলতে গেলে সব কথা ঠিকঠাক বলা যায় না।

আপনি একটা জিনিস লিখলেন, সেটা আপনি বারবার করে যাচাই-বাছাই করতে পারবেন, কাউকে দিয়ে দেখিয়ে নিতে পারবেন, ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ পাবেন, কিন্তু উপস্থিত যা বলবেন, তাতে তো ভুল হতেই পারে। আর আপনি মুহূর্তের উত্তেজনায় যা বলবেন, খানিকক্ষণ পরে উত্তেজনা মিটে গেলে আপনি তা আর বলবেন না। অনেকেই মনে করেন, দু কথা শুনিয়ে দিতে পারলে গৌরব বাড়ে। তাই কটু কথা বলাটাকে তাঁরা বেশ একটা কাজের কাজ বলে গণ্য করেন। কথা বলার সুযোগ পেলেই তাঁরা অন্যের নিন্দা করেন।

কটুকাটব্য করেন। তিনি বুঝতেও পারেন না, এতে তাঁর জনপ্রিয়তা কমে। লোকে তাঁকে পছন্দের তালিকা থেকে সরিয়ে অপছন্দের তালিকার দিকে নিতে থাকে। এ কারণে সবচেয়ে ভালো হলো, কথা না বলা। তারপরে ভালো হলো, কম বলা।

তারপর ভালো হলো, মধুর কথা বলা। কবির ভাষায়, কাকের কর্কশস্বর বিষ লাগে কানে, কোকিল অখিল প্রিয় সুমধুর গানে। কথা যদি বলতেই হয়, ভালো কথা বলাই ভালো। নিউটনের এই চতুর্থ সূত্রটা সম্প্রতি তিনি নতুন করে উপলব্ধি করেছেন। তিনি বুঝেছেন, জনপ্রিয়তা যদি বাড়াতে হয়, ভোট যদি পেতে হয়, তা হলে কথা কম বলতে হবে।

বিশেষ করে, অত্যন্ত বিপজ্জনক যন্ত্র টেলিভিশনের মাইক্রোফোনে কথা না বলাই লাভজনক ও সুফলদায়ক। এর আগে তিনি একবার, প্রায় বছর দুয়েক, কোনো কথাই বলেননি, যা বলেছিলেন হিসাব করে বলেছিলেন, তখন তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছিল। তারপর কী হলো, একদিন তাঁর মুখের অর্গল গেল খুলে। তিনি অবিরাম কথা বলতে লাগলেন। আর তাঁর কথা মানেই এর নিন্দা, ওর সমালোচনা।

অমনি নিউটনের চতুর্থ সূত্র কাজ করতে শুরু করল। তাঁর জনপ্রিয়তার পারদ নিচে নামতে লাগল। এখন তিনি ঠিক করেছেন, আর টেলিভিশনের ক্যামেরাগুলোকে তাঁর ত্রিসীমানার মধ্যেই আসতে দেবেন না। এর চেয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক আর কিছুই হবে না। এটা হবে ভীষণ উপকারী।

তাঁর জনপ্রিয়তা আবার বেড়ে যাবে। অন্যদিকে তাঁর প্রতিপক্ষ মুখ খুলেছেন। আর যথারীতি ওই প্রতিপক্ষ ভুল কথা, অপ্রিয় কথা, হাস্যকর কথা বলছেন। এভাবে যদি তিনি কথা চালিয়ে যেতে থাকেন, তা হলে কথা কম বলার যে গৌরবে তিনি এত দিন অভিষিক্ত ছিলেন, সেখান থেকে তাঁর চ্যুতি ঘটবে। তাঁর ক্ষেত্রেও নিউটনের চতুর্থ সূত্র কাজ করতে শুরু করবে।

তিনি জনপ্রিয়তা হারাতে থাকবেন। কাজেই আমরা তাঁকেই অভিনন্দন জানাব, যিনি সঠিক কাজটি করেছেন, যিনি হূদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন যে টেলিভিশনের ক্যামেরাগুলোকে এক শ হাত দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। তাঁর এই উপলব্ধি দীর্ঘস্থায়ী হোক। তা তাঁকে দীর্ঘস্থায়ী ও ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেবে। আর যিনি কথা বলবেন, তিনি ভুল বলবেন, কটু কথা বলবেন, তাঁর জনপ্রিয়তা নিম্নগামী হবে।

কে না জানে যে বোবার শত্রু নেই। ইশপকে রাজা বলেছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার রেঁধে আনতে। ইশপ রেঁধে এনেছিল জিহ্বার নানা পদ। রাজা বললেন, এটা সবচেয়ে দামি খাবার? এত কিছু থাকতে। ইশপ বললেন, মহারাজ, এই সেই জিব, যা দিয়ে আমরা ঈশ্বরের প্রশংসা করি, মানুষের মধ্যে প্রেমের বার্তা, কল্যাণের বার্তা প্রচার করি, সুন্দর কাব্য উচ্চারণ করি।

কাজেই জিহ্বার চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই হতে পারে না। তখন রাজা ইশপকে বললেন সবচেয়ে কম দামি খাবার বানিয়ে আনতে। ইশপ আবার রেঁধে আনলেন জিহ্বারই নানা পদ। রাজা বললেন, সে কী ইশপ। তুমি তো একই জিনিস আনলে।

ইশপ বললেন, মহারাজ, এই সেই জিব, যা দিয়ে আমরা পরস্পরের নিন্দা করি, গালিগালাজ করি, কটু কথা কই। এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে? কাজেই এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে খাবার। তবে শেক্সপিয়ার আবার অন্য কথা বলেছেন জিব নিয়ে। তিনি বলেছেন, সেই লোক কোনো লোকই না, যার জিব আছে আর সেই জিব দিয়ে যে কোনো নারীকে জয়ই করতে পারে না। উল্লেখ্য, এখানে শেক্সপিয়ার জিব বলতে কথা বুঝিয়েছেন।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।