আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্যান্ডি , আইরিন ও ২৯ শে এপ্রিলের সেই ভয়াল রাত

হ্যারিকেন, সাইক্লোন ও টাইফুন প্রায় একই গোত্রের দুর্যোগ হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ভৌগলিক অবস্থানের কারনে ভিন্ন ভিন্ন নাম ধারণ করে। প্রকৃতিকেও এইরূপ বৈষম্য তাও আবার দুর্যোগ নিয়ে! গভীররাত পর্যন্ত হ্যারিকেন নিয়ে বেশ জল্পনা কল্পনা করতে করতে ঘুমাতে গেলাম। ওমা এ কি, স্বপ্নে দেখি সাইক্লোন! তাও আবার দুই দশক পূর্বের... ১৯৯১ সালে সাইক্লোনের পর কর্ণফুলী নদীর দৃশ্য ২৯ শে এপ্রিল, ১৯৯১ কথায় আছে মানুষের সুখ স্মৃতি বেশীদিন স্থায়ী হয় না তবে ভয়াল স্মৃতি দুঃস্বপ্নের মতো চিরকাল তাড়িয়ে বেড়ায়। অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে গেলেই ওই একটি রাত বার বার ফিরে আসে। আমার স্মৃতির প্রাচীনতম ঘটনা, হয়তো নেতিবাচক বিধায় এতোদিন টিকে আছে।

ভাগ্যক্রমে ছোট খালার বিয়ে উপলক্ষ্যে নানুর বাড়িতে ছিলাম। তা না হলে আফটার ম্যাথ অন্যরকম হতে পারতো। একেতো দ্বীপাঞ্চল, তার উপর আসেপাশে সাইক্লোন সেন্টারের অপ্রতুলতা অস্বাভাবিক মৃত্যুকে সেদিন অনেক স্বাভাবিক করে তুলেছিলো। স্পষ্ট মনে আছে নানু সেদিন তার নিজ হাতে সেলাই করা বিবর্ণ কাপড়ের কাঁথা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। ঘরের উপরের অংশের চাল উড়ে যাওয়ায়, অপেক্ষাকৃত নিচু ও নিরাপদ স্থান বারান্দায় আমাদেরকে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো।

তবে বারান্দার চালের উপর ক্ষনে ক্ষনে ঝরে পরা জাম্বুরা, জামরুল ও আমের শব্দে আমি লাফিয়ে উঠতাম। একসময় ক্লান্তি ভর করলে ঘুমিয়ে পড়ি। কে জানতো পরবর্তী সকালে আমার জন্য আরও কিছু অপেক্ষা করছে। সকালে উঠে নানুর সাথে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি কাঁচাফল আর পাতায় উঠানের মাটি অদৃশ্য অথচ এই উঠানেই আগেরদিন বিকালে খেলাধুলা করেছিলাম। জোয়ারের পানিতে পুকুরে অবস্থান নির্ণয় করা অনেকটা দুঃসাধ্য।

কিছুক্ষন পরপর দূর থেকে স্বজন হারানোর চিৎকার শুনা যাচ্ছে। আকাশ এখনো লালাভ অগ্নিমূর্তি হয়ে আছে। গোয়াল ঘরের কাছে গিয়ে নানু কিছুটা স্থির ও নীরব। হয়তো অন্যদের মতো স্বজন হারা হয়নি বিধায় মনকে অভয় দিচ্ছিলেন। হঠাৎ হেলিকপ্টারের শব্দে ওনার ধ্যান ভাঙ্গে।

কি ব্যাপার এতো নিচ দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ছে! আমি ভয়ে নানুর আঁচলে মুখ লুকালাম। কিছুক্ষণ পর হেলিকপ্টার পাশের স্কুলের মাঠের উপর স্থির হলো আর লাল জামা পরিহিত দুইজন লোক উপর থেকে কি যেন ছুঁড়তে লাগলো। চার-পাঁচ বছরের শিশুর জন্য এটি মোটেও সাধারণ কোনো বিষয় ছিলও না। আশেপাশের বাড়ির মানুষগুলোকে দেখছি কিছুক্ষনের জন্য আহাজারি ছেড়ে স্কুলের মাঠে ছুটতে। যাহোক দ্বীপের পশ্চিমাংশে মেঘনার মোহনায় অবস্থিত ছিলো বিধায় আমাদের ঘর বাড়ি অনেক আগেই সমুদ্র গর্ভে বিলীন।

তাই মাত্র দুই সাপ্তাহ পরেই প্রতিকূল আবহাওয়া সত্ত্বেও চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওই দুর্যোগে প্রায় দুই লক্ষ লোক প্রান হারান। স্বজন হারিয়ে অনেকে নির্বাক। জরুরী অবস্থা জারি করার পর নিউইয়র্কের ব্যস্ততম গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল ষ্টেশন স্যান্ডি , আইরিন হ্যারিকেনের নামকরণ সম্পর্কে সে দিন কাজিনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সে বললো হ্যারিকেনকে মেয়েদের নামে পারসোনিফাই করা হয় কারন দুটোই নাকি বন্য ও ভিভিড! একজন মেয়ের কাছে থেকে এই ধরণের ব্যাখা শুনে খানিকটা অবাক হলাম।

এইটা বড়জোর আবহাওয়াবিদদের অভিমত হতে পারে! যাহোক গতবছর অগাস্টে হ্যারিকেন আইরিনের জন্য বেশ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম। মোমবাতি, শুকনো খাবার, পানি, লাইটার, টর্চ লাইট বালতি থেকে শুরু করে সব। খবরে মাইক্রোফোন নিয়ে হাঁটুপানিতে দাঁড়ানো রিপোর্টারদের তামাশা দেখছিলাম। আর অধিকাংশ আমেরিকানদের মৃত্যু ভয় দেখার মতো! কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়ায়। তাই গতবছর আইরিনের তাণ্ডবের পর মনে সুখে ফটোগ্রাফি করেছি।

গতবছর আইরিনের আঘাতের পর তোলা ছবি এই বছর স্যান্ডি নাকি সরাসরি নিউজার্সি ও নিউইয়র্কের উপকূলের দিকে তেড়ে আসছে। গতরাতেও বেশ কিছুক্ষন রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছি। বাতাসের বেগ ছিলও বেশ। সাপ্তাহিক ছুটি হওয়া সত্ত্বেও রাস্তাঘাটে সুনসান নীরবতা। সিটির পূর্ববর্তী ঘোষণা অনুযায়ী সাবওয়ে (পাতাল রেল) থেকে শুরু করে যাবতীয় পাবলিক ট্রান্সপোটেশান বন্ধ।

জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছে পুরো সিটিজুড়ে। উপকূলীয় অঞ্চলের লোকজনদের অনেক আগেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দুর্যোগের উদরে যাদের জন্ম তাদের আবার ভয় কিসে!!! অনেকে আবার এই হ্যারিকেনের ইতিবাচক দিক খুঁজছেন। নির্বাচনের প্রাক্বালে রিপাবলিক্যানরা ও তাদের মদদপুষ্ট মিডিয়া যে ভাবে উঠে পরে লেগেছে, তাতে রাজনৈতিক বিবেচনায় এই দুর্যোগ কিছুটা ইতিবাচক বটে !!! অন্তত মিডিয়া কিছুদিনের জন্য ডেমোক্রেটদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো বন্ধ করবে! আল্লাহ্‌ তার বান্দাদের হেফাজত করুন। ১০.২৯.২০১২ ব্রুকলিন নিউইয়র্ক  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।