হ্যা আমি সেই সত্যবাদীকে সত্যবাদী মনে করি মাওলানা আবদুল মালেক সাহেবের পুর্ণ মূল লেখাটির ই-সূত্র
আমার সামনে একটি পুস্তিকা আছে, যার নাম ‘যেভাবে নামায পড়তেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ প্রণয়নে অধ্যাপক মোহাম্মাদ নূরুল ইসলাম। প্রকাশক : কামিয়াব প্রকাশন লিমিটেড।
এ পুস্তিকার শুরুতে
إذا صح الحديث فهو مذهبي
কেন্দ্রিক প্রসিদ্ধ চিন্তাটা তুলে ধরা হয়েছে। এরপর নামাযের যে সকল মাসআলায় সুন্নাহর বিভিন্নতা কিংবা হাদীস বা সুন্নাহ বোঝার ইজাতিহাদী ইখতিলাফ খাইরুল কুরূন থেকে চলে আসছে সেসব বিষয়ে একটি দিক গ্রহণ করা হয়েছে এবং তার উপর আমলের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। যেন এর উপর আমল করলেই সব ইমামের মাযহাবের উপর আমল হয়ে যাবে!!
আপনি যদি গোটা প্রবন্ধটি পাঠ করে থাকেন তাহলে বলুন-
إذا صح الحديث فهو مذهبي
বাক্যটি কি সালাত-পদ্ধতির ঐসকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়, যেখানে উভয় দিকে হাদীস ও আছার রয়েছে?!
এ পুস্তিকার ৩৬ নং পৃষ্ঠায় বিতরের নামায সম্পর্কে যা কিছু লেখা হয়েছে তা এখানে উল্লেখ করছি, যাতে
إذا صح الحديث فهو مذهبي
নীতি অনুসারে ফিকহী মাযহাবের সংশোধন ও পরিমার্জনের যে দাবি করা হচেছ তার আরেকটি দৃষ্টান্ত সামনে আসে।
তিনি লিখেছেন, ‘‘বিতরের সালাত আদায়ের পদ্ধতি : তিন রাকআত বিতর দু’ভাবে পড়ার পদ্ধতি হাদীসে পাওয়া যায়।
প্রথম পদ্ধতি : অন্যান্য নামাযের মতোই প্রথম ও দ্বিতীয় রাকআত পড়বে। তৃতীয় রাকআতে কিরাআত পাঠ শেষে দু’আ কুনূত পড়ে রুকুতে চলে যাবে অথবা কিরাআত পাঠের পর রুকু দিয়ে আবার উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দু’আ কুনূত পড়ে একেবারে সিজদায় চলে যাবে। তবে দ্বিতীয় রাকাআতের পর তাশাহহুদের জন্য না বসে সরাসরি দাঁড়িয়ে যাবে। শুধু মাত্র তৃতীয় রাকআতের পর বসবে এবং আত্তাহিয়্যাতু, দরূদ ও দু’আ মাছূরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে নেবে।
আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বলেছেন, রাসূল (স.) তিন রাকাআত বিতরের সালাত আদায় করতেন, এর মাঝে তাশাহহুদের জন্য বসতেন না। একাধারে তিন রাকআত পড়ে শেষ রাকআতে বসতেন ও তাশাহহুদ পড়তেন। এভাবে উমর (রা.)ও বিতর পড়তেন। (হাকেম : ১১৪০)’’
আমরা এই নম্বরে হাকিমের হাদীসটি দেখেছি। হাদীসটির পাঠ এই-
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث، لا يسلم إلا في آخرهن.
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন (রাকাত) বিতর পড়তেন।
তাতে শেষ রাকাতে ছাড়া সালাম ফিরাতেন না। ’
একে পুস্তিকার তরজমার সাথে মিলিয়ে পার্থক্য বোঝার চেষ্টা করুন। এই হাদীসটি বর্ণনা করার পর হাকিম লেখেন-
هذا وتر أمير المؤمنين عمر بن الخطاب رضي الله عنه، وعنه أخذه أهل المدينة.
অর্থাৎ এটিই ছিল আমীরুল মুমিনীন উমর রা.-এরও বিতরের নিয়ম, তাঁর থেকেই আহলে মদীনা এই নিয়ম গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু পুস্তিকার লেখক হাকিমের এই বক্তব্যের প্রথম অংশকে, অর্থাৎ
هذا وتر أمير المؤمنين عمر بن الخطاب رضي الله عنه
সরাসরি আয়েশা রা.-এর বক্তব্য বানিয়ে দিয়েছেন।
বিতরের বিভিন্ন পদ্ধতি থেকে যে পদ্ধতিটি হানাফী মাযহাবে গ্রহণ করা হয়েছে তার সূত্র হাকিমের এই হাদীসটিও, যার উপর হাকিমের বক্তব্য অনুযায়ী খলীফায়ে রাশেদ ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.- এরও আমল ছিল এবং মদীনাবাসীরও।
কিন্তু পুস্তিকার লেখক এর কী তরজমা করলেন এবং একে বিতরের এক খেলাফে সুন্নত তরীকার দলীল হিসেবে পেশ করলেন! এই কি তাদের সহীহ হাদীস মোতাবেক আমল করা ও করানোর খিদমত? আমি তাঁর নিয়ত সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। তাঁর নিয়ত হয়তো ভালো এবং তিনি হয়তো তার বুঝ অনুসারে সহীহই লিখেছেন, কিন্তু বাস্তবে যা হয়েছে তা আমি নিবেদন করলাম।
‘‘দ্বিতীয় পদ্ধতি : অন্যান্য সালাতের মতো প্রথমে দুই রাকাত পড়ে সালাম ফিরিয়ে নেবেন। অতপর পৃথকভাবে আরেক রাকাত পড়ে রুকুর আগে বা পরে দুআ কুনূত পড়ে সিজদা শেষে আবার বসে সালাম ফিরাবেন। -মুসলিম : ১২৫২ (প্রাগুক্ত)’’
এ নম্বরে উল্লেখিত সহীহ মুসলিমের হাদীসটির পাঠ এই-
إن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : صلاة الليل مثنى مثنى، فإذا رأيت أن الصبح يدركك فأوتروا بواحدة، فقيل لابن عمر : ما مثنى مثنى؟ قال : أن تسلم في كل ركعتين.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রাতের নামায দুই রাকাত দুই রাকাত করে।
অতপর যখন তোমার মনে হবে, সুবহে সাদিক হয়ে যাবে তখন এক রাকাত দ্বারা বেজোড় করবে। ইবনে ওমরকে জিজ্ঞাসা করা হল-‘দুই রাকাত দুই রাকাত অর্থ কী?’ তিনি বললেন, ‘প্রতি দুই রাকাতে সালাম ফেরানো। ’
এ পুস্তিকায় যা কিছু বলা হয়েছে তার সাথে মিলিয়ে দেখুন, কোথায় কোথায় পার্থক্য আছে।
‘‘তৃতীয় পদ্ধতি : এ পদ্ধতিটি আমাদের দেশে প্রচলিত। এ পদ্ধতিতে ২য় রাকাআত শেষে বসে তাশাহুদ পড়া হয়।
অথচ বিশ্বের খ্যাতনামা আলেম ভারতের আল্লামা ছফীউর রহমান মুবারকপুরী বলেছেন, এ নিয়মের পক্ষে সরাসরি কোনো সহীহ হাদীস নেই। বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পদ্ধতিতে বিতর পড়তে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন-
لا توتروا بثلاث، ولا تشبهوا بصلاة المغرب
‘তোমরা মাগরিবের নামাযের মতো করে তিন রাকাআত বিতরের নামায পড়ো না’। -দারকুতনী, হাদীস : ১৬৫০, ২/৩৪৪; সহীহ ইবনু হিববান : ২৪২৯) (প্রাগুক্ত)
উপরোক্ত হাদীস, যার ভিত্তিতে তিনি নিজের বুঝ অনুসারে দুই জলসা, এক সালামের সাথে তিন রাকাত বিতরের পদ্ধতি ত্যাগ করাকে জরুরি বলছেন এই হাদীসের পাঠ তারই উদ্ধৃত নম্বরে দারাকুতনী ও সহীহ ইবনে হিববানে এভাবে আছে-
لا توتروا بثلاث، أوتروا بخمس، أو بسبع، ولا تشبهوا بصلاة المغرب
(তোমরা বিতর (শুধু) তিন রাকাত পড়ো না। পাঁচ বা সাত রাকাত পড়ো।
মাগরিবের সাথে সামঞ্জস্য গ্রহণ করো না। )
লেখক এই হাদীসের মাঝে থেকে أوتروا بخمس أوبسبع (পাঁচ বা সাত রাকাত পড়ো) বাক্যটি বাদ দিলেন কেন? আসলে হাদীসের এই বাক্যগুলোর দ্বারা, সহীহ সনদে বর্ণিত এই হাদীসের অন্যান্য পাঠ এবং এ বিষয়ের অন্যান্য সহীহ হাদীস দ্বারা এই হাদীসের মর্ম পরিষ্কার হয়ে যায়। আর তা হচ্ছে, তোমরা বিতর শুধু তিন রাকাত পড়ো না; বরং এর আগে তাহাজ্জুদ হিসেবে দুই রাকাত নফল বা চার রাকাত নফল নামায অবশ্যই পড়ো। নফল দুই রাকাত হলে সর্বমোট পাঁচ রাকাত হবে, আর নফল চার রাকাত হলে সর্বমোট সাত রাকাত হবে। সুতরাং মাগরিবের আগে যেমন কোনো নফল পড়া হয় না বিতরকে এমন বানিও না।
এই হাদীসের এই ব্যাখ্যা সুনানে আবু দাউদে (হাদীস : ১৩৫২, ১৩৬২) সনদে বর্ণিত আয়েশা রা.-এর হাদীস দ্বারাও সমর্থিত। আরো বিস্তারিত জানার জন্য ‘শরহু মাআনিল আছার’, তহাবী ১/২০৫ এবং ‘নাসবুর রায়াহ’ ২/১১৬-১১৮৫-এর হাশিয়া দেখা যেতে পারে।
সামান্য চিন্তা করলেই যেকোনো পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে যে, সামাঞ্জস্য থেকে বাঁচার জন্য দুই রাকাতের পর জলসা ছাড়তে হবে কেন। দুআ কুনূত দ্বারাও তো দুই নামাযে পার্থক্য হচ্ছে। দুই রাকাতে জলসার বিধান তো সব নামাযের সাধারণ বিধান-
وفي كل ركعتين التحية
অর্থাৎ প্রতি দু’রাকাআতে আছে আত্তাহিয়্যাহ।
-সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৪৯৮
তো إذا صح الحديث فهو مذهبي এর ভিত্তিতে মাযহাব সংশোধনের এই যদি হয় অবস্থা আর এই ‘সংশোধিত’ মাযহাবের উপর আমল করলেই তা যদি হয় হাদীস ও মাযহাব মোতাবেক আমল, তাহলে বলুন ঐ বন্ধুদের দাওয়াত গ্রহণ করা জনসাধারণের জন্য অপরিহার্য হবে কি না এবং গ্রহণ না করলে সত্যিই তারা হাদীস-অনুসরণ থেকে বঞ্চিত থাকবেন কি না?
এখানে এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হল। অন্যান্য প্রশ্নের জবাব ইনশাআল্লাহু সুযোগমত আলকাউসারে লেখার চেষ্টা করা হবে। (ক্রমশ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।