দেশ সামসুদের নিয়েই গঠিত। তাই সামসুদের নিয়ে ভাবতে হবে, সামসুদের কথা শুনতে হবে । স্মরণকালের ভয়াবহ ট্র্যাজেডি সাভারের রানা প্লাজার মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানা। অবৈধভাবে নির্মিত এই ভবন ছিল একটি টর্চার সেল। আপন ভগ্নিপতি ও বন্ধুসহ বেশ কয়েকটি হত্যা মামলায় সম্পৃক্ত এই রানার উত্থান বিস্ময়কর।
সাভারে অবৈধ দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ হতো এই ভবন থেকেই। মঙ্গলবার ভবনটিতে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিলে সাময়িকভাবে ভবনে থাকা তিনটি গার্মেন্ট ও ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু যুবলীগ নেতার ভবন হওয়ায় প্রশাসন এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
রানা প্লাজা অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে উল্লেখ করে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নূরুল হুদা জানিয়েছেন, তারা সাভারে রানা প্লাজা নামের বহুতল ভবন নির্মাণের কোনো অনুমোদন দেননি। তাহলে কীভাবে নির্মাণ করা হলো এটি? এর জবাবে সাভার পৌর মেয়র রেফায়েত উল্লাহ বলেন, সাভার পৌর এলাকায় ৬ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণে পৌরসভার অনুমোদন হলেই চলে।
কিন্তু এরচেয়ে বেশি তলা করতে চাইলে রাজউকের অনুমোদন লাগে। সোহেল রানা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পৌরসভা থেকে ৬ তলার অনুমোদন নিয়ে অবৈধভাবে ৮ তলা বানিয়েছেন। পৌর মেয়র জানান, ভবনটিতে ফাটল দেখা দেয়ার পর তিনি ভবনটি খালি করার নোটিশ দিয়েছিলেন দু’দিন আগেই। মঙ্গলবার ভবনটিতে বড় ধরনের ফাটল দেখা দেয়ার পর ওইদিনই ভবনটি খালি করে দিতে বলা হয়। সেদিন সকাল ৯টায় ভবনটি খালি করে সবগুলো গার্মেন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়।
কিন্তু দোতলার মার্কেটগুলো খোলা ছিল।
গতকাল শ্রমিকরা কাজে যেতে না চাইলেও ভবন মালিক রানার নির্দেশে এবং গার্মেন্ট মালিকরা জোর করে হরতালবিরোধী মিছিল করার জন্য শ্রমিকদের সেখানে জড়ো করেছিল।
মর্মান্তিক এই ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী রানা সম্পর্কে জানা গেছে, সে সাভার এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী। সাভার পৌরসভা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক। তার বাবা আবদুল খালেক ওরফে কলু খালেক।
আশির দশকে আবদুল খালেক বিভিন্ন বাড়িতে তেল ফেরি করে বিক্রি করতেন বিধায় কলু খালেক নামেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। কলু খালেকের চার মেয়ে ও এক ছেলে।
যুবলীগ নেতা সোহেল রানার বয়স ৩৫ বছর। সাভারের স্থানীয় বাসিন্দা ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ছোটবেলা থেকেই বখাটে হয়ে যাওয়া রানার পড়ালেখা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। ওই সময় সে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপর সে সক্রিয়ভাবে যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। ২০০১ সালে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় যৌথবাহিনীর হাতে আটক হয়ে রানা দীর্ঘদিন কারাগারে ছিল। অভিযোগ পাওয়া গেছে, জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তার বড় বোনজামাই জাকিরের সহযোগিতায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অস্ত্রের মুখে এক হিন্দু ব্যক্তির কাছ থেকে নির্মাণাধীন এই ভবন ও ভবনের জমি দখল করে রানা। ওই দখলে সহযোগিতা করে তার বড় বোন সুফিয়ার স্বামী জাকির। সেও সাভার এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ছিল।
সাভারের বাসিন্দারা জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রানা তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে বড় বোন সুফিয়ার স্বামী জাকিরকে খুন করে বলে অভিযোগ রয়েছে। তার লাশ উদ্ধার হয়েছিল ধামরাই এলাকা থেকে। এছাড়াও সাভার ব্যাংক কলোনি এলাকার বাসিন্দা রানার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবদুল্লাহকে কুপিয়ে হত্যা হয়েছিল এই রানা প্লাজার ভেতর। ওই খুনের সঙ্গে রানা জড়িত ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। মূলত অবৈধ দখল, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ওই খুন হয়েছিল বলে জানা গেছে।
ওই খুনের সঙ্গে রানা ও তার বাহিনীর সম্পৃক্ততা ছিল।
সাভার বাসস্ট্যান্ডের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এই রানা প্লাজা ছিল রানা তথা আওয়ামী লীগ দলীয় ক্যাডারদের টর্চার সেল। এলাকায় চাঁদাবাজি, ফেনসিডিল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলত এই ভবন থেকে। রানা নিজেই ফেনসিডিল ও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সে নিজেও ফেনসিডিল ও ইয়াবা সেবন করত।
রানা প্লাজায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও বেশ ক’জন আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিক নিয়মিত আড্ডা দিতেন। ঢাকার আওয়ামীপন্থী একটি দৈনিকের স্থানীয় সংবাদদাতারও শেয়ার এবং তার কার্যালয় ছিল রানা প্লাজায়। ওই সাংবাদিকের মূল কাজ ছিল প্রশাসনিকভাবে রানাকে রক্ষা করা। এসব বিষয় নিয়ে স্থানীয় সাধারণ সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল বলেও জানান অনেকে।
রানার পরিবার সম্পর্কে আরও জানা গেছে, তাদের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিংগাইরে।
আশির দশকে মাথায় ফেরি করে তেল বিক্রি করলেও অল্পদিনের মধ্যেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিলেন রানার বাবা আবদুল খালেক। সাভারে রানা ও তার বাবার নামে ৩টি বাড়ি রয়েছে। রানার বোনদের প্রত্যেককেই বাড়ি করে দেয়া হয়েছে। রানার শ্বশুর এলাকায় বিএনপি নেতা হিসেবে পরিচিত।
গতকাল সকাল ৯টায় যখন রানা প্লাজা ধসে পড়ে, তখন রানা নিজেও ওই ভবনের মধ্যে ছিল।
তাকেও সামান্য আহত অবস্থায় জনতার রোষানল থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদে সরিয়ে নেন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য তৌহিদ জং মুরাদ। ভবনটি ধসের সময় রানা ছিলেন নিচতলায়। জনতার রোষানলে পড়ার ভয়ে তিনি বের হতে না পেরে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের খবর দেন। পরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে স্থানীয় এমপি তৌহিদ জং মুরাদ ঘটনাস্থলে গিয়ে ভবন মালিক রানাকে বের করে হাসপাতালে নিয়ে যান।
রানার সঙ্গে থাকা বন্ধু অ্যাডভোকেট মাসুদ চৌধুরী জানান, ভবন ধসে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটলেও সোহেল রানা আঘাত পাননি।
মাসুদ তার ব্যক্তিগত গাড়িটি রানা প্লাজার নিচতলায় গ্যারেজে রাখতেন।
মঙ্গলবার বিকালে ভবনটিতে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিলেও ভবন মালিক সাভার পৌর যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সোহেল রানা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভবনের বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। সামান্য একটু প্লাস্টার খসে পড়েছে। এটা তেমন কিছু নয়। একই বক্তব্য দিয়েছেন স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদার।
যদিও স্থানীয় প্রকৌশলী আবদুর রাজ্জাক ভবন ঘুরে দেখে বলেছিলেন, ভবনের নিরাপত্তার স্বার্থে বুয়েট থেকে প্রকৌশলী এনে পরীক্ষা করা প্রয়োজন; তা না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।