প্রত্যেকটি মানুষই অন্যদের থেকে আলাদা। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। দিনটি ছিল শুক্রবার। তখনও ভোর হয়নি। রাত তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট।
অন্য দিনের মত সেদিনও মাদার বখশ হলের ৪২০ নম্বর কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন গণিত চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ফিরোজ আলম। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। দরজা খুলতেই দেখে হলের ছাত্রলীগের কয়েকটি ছেলে। তারা তাকে একই হলের ‘ক’ ব্লকের ৩০৮ নম্বর কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে ছিল মারূফ হোসেন, জুবায়ের ইবনে তানিম, দেলাওয়ার হোসেন ডিল্স, মণির, শেখ রাসেল এবং ফিরোজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের ১০/১১ জন।
সবার হাতেই লোহার রড, লাঠিসোটা ও অস্ত্র। তাদের একজন বলে, তুই খুব সেয়ানা হয়েছিস। রুমে সবাইকে ডেকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াস অথচ আমরা জানিনা। বড় ভাইদের দাওয়াত দিতে হয়না। আর তোকে না সেদিন শেভ করতে (দাঁড়ি কামাতে) বলেছিলাম।
এখনও কামাসনি কেন? বাহাদুরি দেখাস? বেটা শিবির! মার শালাকে! মার....... বলেই শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। এসময় তারা ৮ থেকে ১০জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী রড, হকিস্টিক ও হাঁসুয়ার উল্টা পিঠ দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করতে থাকে তারা। যাতে চিৎকার করতে না পারে সেজন্য একজন এসে মাথায় পিস্তলও ঠেকায়। বাড়াবাড়ি করলে শিবির বলে পুলিশে দেয়ারও হুমকি দেয় তারা। এর আগে তারা হলের ছাদে নিয়ে গিয়েও মারধর করে।
ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ছেড়ে দেয় তাকে। আর বলে এক ঘণ্টার মধ্যে হল ছেড়ে চলে যাবি। এর পর যদি তোকে হলে দেখি তো খবর আছে।
সেদিন ভোরেই সাড়ে ছয়টার ট্রেনে মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যেতে হল বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে।
প্রাথমিক চিকিৎসা সেরে কোন রকমে খুড়িয়ে খুড়িয়ে লালমনিরহাটের বাসে বাড়ির পথে রওনা হন ফিরোজ। তাও সান্ত্বনা জীবন নিয়ে তো বাড়ি ফিরতে পারছে। এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন শিক্ষার্থীর জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই। বাবাকে এখন ও বলা হয়নি। মা শুনে সারাদিনে কেঁদেছে।
কেন তাকে মারা হল জিজ্ঞেস করতেই তিনি যা বললেন, আগের রাতে আমরা ৭/৮জন বন্ধু-বান্ধব মিলে মাংস রান্না করে খাচ্ছিলাম। ওরা এসে আমার নাম জিজ্ঞেস করে বললো, এভাবে মাংস রান্না করে খাচ্ছিস হলের বড় ভাইদের দাওয়াত দেয়া লাগেনা? এসময় তারা আমাদের কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে হলের গেস্ট রুমে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং আমাকে শেভ করতে বলে। ফিরোজ আরো জানায়, সে কোনদিনও কোন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলনা। তার পরিবারের কেউও রাজনীতির সাথে জড়িত না। এমনকি সে নিয়মিত দাড়িও রাখে না।
একটু শেভ করতে দেরি হওয়ার মুখের দাড়িগুলো বড় হয়ে গিয়েছিল, যোগ করে আহত ফিরোজ।
হলের গেইটে থাকা পুলিশ, গার্ড ও হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ওই রাতে শুধু ফিরোজকেই নয়। হলের ‘ক’ বকের আরও বেশ কয়েকজন ছাত্রকে গভীর রাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে শিবির সন্দেহে মারধর করে ছাত্রলীগের ওই কর্মীরা। একাজ সফলভাবে করতে এবং কেউ যেন হলের বাইরে যেতে না পারে এজন্য রাত ১১টার দিকে ছাত্রলীগ ক্যাডার মারুফ ও মুনির হলের প্রধান গেইটে তালা লাগিয়ে দিয়ে পুলিশ ও গার্ডকে বলে দেয় সকাল ৮টার আগে যেন গেইট খুলে দেয়া না হয় এবং কেউ যেন বের হতে না পারে।
ঘটনার আগের রাতেও ১টার দিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অন্ততপক্ষে ৬ থেকে ৭জন সাধারণ ছাত্রকে শিবির সন্দেহে মারধর করে হল বের করে দেয় এবং কয়েকজনকে সকাল ১০টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়।
এরা হলেন, ‘খ’ বকের ৪২৬ নম্বর কক্ষের সৌরভ (আরবি), ৩১৯ নম্বর কক্ষের আবু হুসাইন (ব্যবস্থাপনা ৩য় বর্ষ), শামীম রেজা (ব্যবস্থাপনা এমবিএ), মিন্টু মেহবুব খানসহ (ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং এমবিএ) নাম না জানা আরও কয়েকজন। এছাড়া আপেল নামে শিবির সন্দেহে ছাত্রদলের এক কর্মীকে ছাত্রলীগ মারধর করলে পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে।
হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানায়, তানিম ও ডিলস মাদার বখশ হলের সভাপতি-সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই হলের টেলিভিশন ও রিডিং রুমে অন্ততপক্ষে ১০ থেকে ১২জন সাধারণ শিক্ষার্থীকে কানেধরে উঠবস ও মারধর করে। এজন্য ছাত্রলীগ আতংকে হলের অধিকাংশ আবাসিক ছাত্র আর রাতে টেলিভিশন ও রিডিং রুমে যায় না। তাছাড়া আতংকে রাত ১২ টার পর আর প্রস্রাব-পায়খানা করতেও রুমের বাইরে বের হয়না ছাত্ররা।
শুধু মাদার বখশ হলেই নয়। শের ই বাংলা এ কে ফজলুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানায়, রাত আসলেই অনেকটা নিস্তব্ধ হয়ে যায় হল। ছাত্রদের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। কেন এমন হয় জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়, ছাত্রলীগ আতংক। কাউকে বাইরে দেখলেই শিবির সন্দেহে তাকে মারধর করে।
অনেকে ভয়ে হল ছেড়ে বাইরে মেসে চলে গেছে। অনেকের কাছে আবার শিবির বলে চাঁদাও দাবি করে। ওই হলের ছাত্রলীগ নেতা জাকির, আমিন, শিমুল, তুহিন এসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত বলে তারা জানায়। এছাড়া শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হলে ছাত্রলীগ নেতা ডেভিডসহ কয়েকজনের অত্যাচারে ছাত্ররা অতিষ্ঠ।
মাদার বখশ, শের ই বাংলা ও জিয়া হল ছাড়াও শাহ মখদুম হল (এস এম হল), সৈয়দ আমীর আলী হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেও প্রায় একই অবস্থা।
এই কয়েকটি হলে গত ০২ অক্টোবর ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের পর ছাত্রলীগের মারধর ও আতংকে অন্ততপক্ষে ২০ থেকে ২৫জন ছাত্র ভয়ে হল ছেড়ে বাইরের মেসে চলে গেছে বলে জানা গেছে।
প্রশাসনের সূত্র অনুযায়ী, ২০১০ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের পর ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, কম্পিউটার চুরি, সিট বাণিজ্য, মারধর ও হয়রানিতে অতিষ্ঠ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ১১টি আবাসিক হল থেকে প্রায় ৫৯৭জন শিক্ষার্থী হল ছেড়ে বাইরের মেসে চলে যায়।
অভিযোগ রয়েছে, মাদার বখশ হলের ছাত্রলীগ সভাপতি যুবায়ের ইবনে তানিম পুলিশের সামনেই প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে। গত ০২ অক্টোবর ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের সময় তাকে অন্ততপক্ষে ১০ রাউন্ড গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। এছাড়া সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ডিলস ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের কাউন্সিলে ঘোষিত আওয়াল কবির জয় ও মাজেদুল ইসলাম অপু কমিটির সভাপতি জয়ের ক্যাডার ও তার ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিল।
তারপর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিজ দলের কর্মী নাসিম হত্যার পর ওই কমিটি স্থগিত এবং ওই দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হলে রাজনীতির মাঠে ডিলসকে আর তেমন দেখা যায়নি। ওই সময়ের মাঝে সে বর্তমান সভাপতি আহম্মেদ আলী’র সমর্থকদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষেও জড়িয়ে পরে। সম্প্রতি আহম্মেদ আলী ও আবু হুসাইন বিপু কমিটির অধীনে তাকে মাদার বখশ হল শাখার সাধারণ সম্পাদক করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই মূলত ডিলস তার হলে এবং ক্যাম্পাসে নিরীহ সাধারণ ছাত্রদের উপর তাণ্ডব শুরু করে। ছাত্রলীগের প্রাক্তন ও বর্তমান একাধিক নেতার অভিযোগ, আগের সভাপতি আওয়াল কবির জয়ের পরোক্ষ নির্দেশেই বর্তমান আহম্মেদ-বিপু কমিটির মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল অথবা যেকোনো ধরণের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বড় ধরণের কোন সংঘর্ষে বাধিয়ে বর্তমান কমিটিকে বিলুপ্ত করতে সে উঠে পরে লেগেছে।
তার বিরুদ্ধে পূর্বে সাংবাদিক লাঞ্ছনার অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আহম্মেদ আলী’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আবাসিক হলগুলোকে শিবির-মুক্ত করতেই সন্দেহের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে অনেককে হল থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। তবে এখানে ছাত্রলীগের কেউ অতিরিক্ত কিছু করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। হলে কোন আবাসিক ছাত্রের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে হল প্রশাসন সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিবে কিন্তু ছাত্রলীগ কেন এখানে অবৈধ হস্তক্ষেপ করছে এমন প্রশ্ন করলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানায়, মাদার বখশ হলের ৪০ ছাত্রের একটি সন্দেহজনক তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
এদেরকে টার্গেটে রাখা হয়েছে। মূলত নম্র-ভদ্র স্বভাবের, নামাজী, শালীন পোশাকের ছেলেদের কে শিবির হিসেবে টার্গেট করা হয়। আর দাড়ি রাখলে তো কথাই নেই।
মাদার বখশ হলের প্রাধ্যক্ষ ড.মো.শেরেজ্জামান হলে দায়িত্ব পাবার কয়েকদিনের মধ্যেই হলের ছাত্রদের মূল্যবান সম্পদ নিরাপদে রাখার জন্য একটি নোটিশ দিয়েছিলেন। সেখানে বলা ছিল কোন মূল্যবান বস্তু হারালে হল কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
এসব বিষয়ে অভিযোগ করে কোন ফল পাওয়া যায় না। যেখানে নোটিশ দিয়ে নিরাপত্তা দিতে অপারগতা স্বীকার করা হয় সেখানে তিনি যে কিছুই করতে পারবেনা তা বুঝে নিতে কোন বেগ পেতে হয় না। প্রক্টর প্রফেসর চৌধুরী মো. জাকারিয়া ছাত্রদের নিরাপত্তার বিষয়ে বরাবরই উদাসীন। ছাত্র নির্যাতনের বিষয়ে কিছু জানেন কিনা প্রশ্ন করলে এসবের কিছুই তিনি জানেন না বলে জানান। তিনি উল্টো প্রশ্ন করে এসব বিষয় সাংবাদিকরা জানলো কিভাবে?!
বেশ কয়েকমাস ধরে ছাত্রলীগের ঘাটি হিসেবে গড়ে ওঠা মাদার বখশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল দুটি এখন ছাত্রলীগের টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এমনকি অন্যান্য হল থেকে সন্দেহভাজনদের ধরে নিয়ে এসব হলে নির্যাতন করা হয়। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে অস্ত্র রাখার অনুমতি পাওয়ায় তাদের হাতে এখন কেউই নিরাপদ নয়। ছাত্রলীগও নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।