আমিই হিমু। এই সাধারন বাস্তবের হিমু। দরজার ওপাশে, পারাপার, দ্বিতীয় প্রহর, নীল পদ্ম আর ঝি ঝি পোকার হিমু নই।
হিন্দী চ্যানেলের নাচাগানা দেখে দেখে ইচড়েপাকা হয়ে যাব ভেবে আমাদের বাসায় ডিশের সংযোগ নেয়া হয়নি অনেক দিন পর্যন্ত। কিন্তু ভিসিআরে সবাই মিলে দেখতাম দিলীপ কুমার - মধুবালার সিনেমা।
এতে হয়েছে হীতে বিপরীত; রোমান্স জিনিসটা অল্পবয়সেই হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছিলাম সমঝদারের মত। ফলশ্রুতিতে ক্লাস ফাইভেই প্রেমে পড়লাম চশমা পড়া এক রাগী বালিকার; যার মূল কাজ ছিল টিচারের কাছে বিচার দিয়ে আমাকে কান ধরে দাড় করিয়ে রাখা !! ব্যাপক সাফল্যের সাথে সেই প্রথম ছ্যাকা খেয়েও আমার কচি মনটা দমে যায়নি মোটেই। এরপরে আরো বেশকিছু ভিন্ন টাইপের ভিন্ন ভিন্ন ললনার প্রেমে পড়লেও নিয়ম করে ছ্যাকা খাওয়াটা ছিল অভিন্ন।
এতগুলো দাগা খেয়ে খেয়ে আমার হৃদয়টা হয়ে পড়লো বেশ স্পর্শকাতর। তাই যেকোন সিনেমায় একটু আবেগঘন দৃশ্য দেখলেই আমি ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদি আর বিছানার চাদর দিয়ে চোখ মুছি!! আবহাওয়ার পূর্বাভাসে যা শুনেছি তাতে আশিকী ২ দেখার পর চোখের পানিতে ঘর ভেসে যাওয়ার নাকি সমূহ সম্ভাবনা।
ফেসবুকে ছিঁচকাঁদুনে মেয়েরা (আমার চেয়েও বেশি) হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে স্ট্যাটাস দিচ্ছে এই সিনেমা দেখে! তাই সতর্কতামূলক প্রস্তুতি হিসেবে একটা এক্সট্রা বিছানার চাদর নিয়ে দেখতে বসলাম আশিকী ২।
পরিচালনা – মোহিত সুরি
স্টারকাস্ট – আদিত্য রায় কাপুর, শ্রদ্ধা কাপুর।
নায়ক মদ খান! উঁহু...। ইনি ‘খান’ সিরিজের নতুন নায়ক না; উনার সমস্যা হোল তিনি শুধু মদ খান। নাম তার রাহুল।
একজন রগচটা পপ সুপারস্টার। যার সম্বল শুধুমাত্র বিষন্ন একজোড়া চোখ, আর অসম্ভব সুরেলা গলা। তাকে দর্শনের জন্য কনসার্টের দর্শকরা ঘন্টার পর ঘন্টা উদ্বেলিত হয়ে অপেক্ষা করতে পারে, তার জন্য সারা দেশের তরুণ তরুণীরা পাগল আর সব মিডীয়ার আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু তিনি। ভয়াবহ রকম নন ক্যারিশমাটিক একটি চরিত্র; যার ভেতর মদ খাওয়াই সুপারস্টারসুলভ একমাত্র গুণ! রাহুল সাহেব স্টেজে ওঠার আগে, ওপেন স্টেজে, স্টেজ থেকে নেমে, গাড়ীতে ওঠার আগে, গাড়ী চালাতে, গাড়ী থেকে নেমে, বারে, রাস্তায়, হোটেলে, বাসায় – সব জায়গায় সারাক্ষন মদ খান। পুরো সিনেমায় তাকে মদ আর একটি চুমু ছাড়া আর কিছু খেতে দেখা যায়নি।
তখন সময় খারাপ। ফর্ম পড়তির দিকে, গানের বাজারে মন্দা, জনপ্রিয়তায় ভাটা। নায়কের কোন খেয়াল নেই। উড়াধুরা পুরা !! একদিন বাধা দেয় বিবেক। নিজের বিবেক নয়, বন্ধু কাম ম্যানেজার বিবেক! যতটা সময় পর্দায় নিজেকে দেখানোর সুযোগ পেয়েছেন, তার পুরোটা সময় যাত্রাপালার বিবেকের মত কঠিন ডায়লগ দিয়ে গেছেন কোন পরিস্থিতিতেই মুখোভঙ্গি একবিন্দু না বদলিয়ে !! তীব্র বাধার মুখে নায়ক; নায়কোচিত ভাবে ডিম আগে; না মুরগী আগে – প্যারাডক্সের মত কঠিন এক বাণী দিয়ে বিবেকের থোতা মুখ ভোতা করে দিলেন !! “আমি মরার নেশায় পান করিনা, পান করার নেশায় মরি!!” আহা !! কেয়া বাত !! মারহাবা !! মারহাবা !!
রাতের বেলা সানগ্লাস লাগিয়ে গাড়ী চালাচ্ছেন সুপারস্টার।
একহাতে স্টিয়ারিং, আরেকহাতে মদের বোতল। হঠাত সদাইপাতি সহ নায়িকার এন্ট্রি হোল একেবারে গাড়ীর সামনে!! মাতাল কে বোঝা গেলনা !! নায়ক? নায়িকা? নাকি গাড়ী? কোনমতে নায়িকা বেঁচে গেলেও গাড়ীর ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে রইল নায়িকার অসহায় সদাই – আলু, পটল আর কাঁচামরিচ গুলো। অল্পের জন্য জানে বেঁচে যাওয়ার পরবর্তী রিএকশনে নায়িকা সদাই কুড়াতে লাগলেন, আর নায়ক কে দেখা মাত্রই খ্যাক করে উঠলেন! (বংশের দোষ !! ভিলেন কন্যা বলে কথা!!)
সেই রাতেই মদের খোঁজে সাত রাস্তা তের গলি পাড়ি দিয়ে নায়ক রাহুল যেই আস্তানায় পৌছুলেন, সেখানে গিয়ে দেখেন সেই সদাইওয়ালা নায়িকা সেই বারের বারাঙ্গনা হয়ে নায়কেরই এক বিখ্যাত গান পরিবেশন করছেন। সাথে সাথে রাহুল বুঝে গেলেন এই নায়িকা খুবই উঁচুদরের গায়িকা এবং কঠিন প্রেমে পড়ে গেলেন। প্রেম অন্ধ, কিন্তু বলিউডি প্রেম জন্মান্ধ।
প্রেম কোন যুক্তি মানে না, আর বলিউডি প্রেম যুক্তি বানানটাও করতে পারেনা। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে আরোহী নায়কের এক কথায় বিশ্বাস করে চাকরীটা ছেড়ে চলে আসে শহরে; লাক্স সাবানের মডেল হবার লোভে। কারণ, একমাত্র উচ্চমার্গের সেলিব্রেটিরাই গায়ে ডি.এন.এ সমৃদ্ধ নতুন লাক্স সাবান মাখে !!
কথা নেই বার্তা নেই কে বা কারা নায়ককে মেরে ওয়ালটনের এলসিডি টিভির স্ক্রীণের মত পুরো ফ্ল্যাট বানিয়ে ফেলায় তিনি হয়ে গেলেন আউট অব রিচ। এদিকে আরোহী তো আর যোগাযোগ করতে পারছেনা! কি হবে তার ?? বিরোধীদলের বদমাশ নেতা কর্মীরা তার মনের দেয়াল ধরে নাড়াচাড়া করায় বিশ্বাসে ফাটল ধরে সৃষ্টি হয় এক আশংকাজনক অবস্থার!!
অবশেষে মাস দুয়েক পরে রাহুল নিজের পায়ে খাড়া হয়েই খুজে বের করে ফেলেন আরোহী কে এবং প্রডিউসারকে ভগিচগি দিয়ে অডিশন ম্যানেজ করে ফেললেন। প্রযোজকও গান শুনেই কাত।
ব্যাস; এরপর কনট্র্যাক্ট, এলবাম, মিউজিক ট্যুর, মিডিয়া, লাক্স...
নায়ক রাহুল কিন্তু এতিম নয়, তার একটা বাবা আছে! তিনি মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে খোঁজ নেন; “কিরাম আছস বাবা?
: ভালু আছি ড্যাড!!
: তাই? প্রেমে পড়েছিস মনে হচ্চে! হেহেহে
: কসকি মমিন? ক্যাম্নে বুঝলা ড্যাড?
: আরে শালা, আমি তো তোর জন্মদাতা বাপ!! যখন ছেলেরা প্রেমে পড়ে তখন বাবারা ঠিকই বুঝতে পারে, বুঝেছিস?”
কথা সত্য। আমার বাবাও বুঝতে পেরেছিলেন। তারপর যে বেতের বাড়ি গুলো দিয়েছিলেন, আহারে !!
এরপর? টিপিক্যালি আরোহীর সাফল্য; রাহুলের পতনের সমানুপাতিক। সাফল্যের চূড়ায় আরোহণ করে আরোহী, আর মদ খেয়ে গলা আর মাতলামি করে মান- সবই খুইয়ে ফেলতে থাকে রাহুল। আমরা মায়ের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে খুচরা টাকা চুরি করে বিড়ী খাই, আর রাহুল হাপিশ করে দেয় প্রেমিকার গোটা ভ্যানিটি ব্যাগটাই !! হাল ছাড়েনা আরোহী।
রাহুলের মদের নেশাকে সে প্রাণপণে কনভার্ট করতে চায় ভালবাসার নেশায়। কিন্তু জিম্বাবুইয়ান ডলার; ইউএস ডলারে কনভার্ট করে কি লাভ ?? বোঝেনা সে বোঝেনা !!
বাবা, মা, ক্যারিয়ার, সমাজ সবকিছু ভুলে আরোহী ফিরিয়ে আনতে চায় রাহুলকে নেশার পথ থেকে। ধীরে ধীরে ফিরেও আসতে থাকে রাহুল। কিন্তু হঠাত একদিন...খাটশের মত দেখতে এক খবিশ সাংবাদিক সব গুবলেট করে দিল। ঘুমিয়ে থাকা নেশার দানব জেগে উঠলো, ওলট পালট করে দিল সব।
অবশেষে জনসম্মুখে সেলিব্রেটি প্রেমিকার ইজ্জতের (সেইই ইজ্জত না কিন্তু) ফালুদা বানিয়ে হাজতবাস! অনেক দাগী আসামীর মতো রাহুলও হাজতবাস করে দার্শনিক হয়ে গেল। সে সিদ্ধান্ত নিল; আরোহী আর সাফল্যের মাঝখানে কাবাবের হাড্ডি হয়ে আর নয়। নিভে যাওয়ার আগে ফস করে জ্বলে উঠার মত নায়ক অনেক ভালো ভালো বাণী দিয়ে অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমায় পৌছে গেল। সক্কালবেলায় এই দুঃসংবাদ শুনে নায়িকা শোকাভিভূত হবার বদলে ক্ষোভাভিভূত হয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে ক্যারিয়ারে লাগাতার হরতালের ডাক দিয়ে দিলেন। এবারো জাগ্রত হোল সেই বিবেক; এবং শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষের পরিস্থিতিতে সংলাপের মাধ্যমে হরতালের মত নিজস্বার্থ বিরোধী কর্মসূচী প্রত্যাহার করা হয়।
এসময় উপস্থিত দর্শককূলের মাঝে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টী হয়।
বলিউডের মুভিতে প্লট দূর্বল হলে কিছু যায় আসেনা, বরং লাক বাই চান্স কোন সিনেমার প্লট সবল হলেই তা আলোচনার বিষয় হয়। এবং যথারীতি সেইসব সবল প্লট ওয়ালা মুভি হিট খায়না, কেউ আহা উহুও করেনা, চোখের পানি ফেলা তো পরের বিষয় !! মোটা দাগের কমেডিয়ান জনি লিভার’কে দিয়ে কাতুকুতু আর সস্তা সেন্টিমেন্টের আবেগে কাঁদানো – একই তো কথা! আমরা সস্তায় হাসতে এবং কাঁদতে ভালবাসি।
নিকোলাস কেজ’এর লিভিং লাস ভেগাস মুভিতেও নায়ক সারাক্ষন মদ খেতে থাকে। কেন? এর উত্তর কখনোই পাওয়া যায়না।
এবং সবচে বড় সার্থকতা হোল, পুরো সিনেমায় এই প্রশ্নটাই কখনো উঠেনি। যেন নায়কের মদ খাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাহুল কেন মদ খাচ্ছে, কিসের দুঃখ তার, কাকে ভোলার জন্য খাচ্ছে – পুরো মুভিতে বড়ই যন্ত্রণা দিয়েছে এই প্রশ্নটি। রাগ, হতাশা, ভেতর থেকে আসা তীব্র কষ্ট এবং ভয়ংকর একটি সিদ্ধান্ত নেবার ব্রেথ টেকিং এক্সপ্রেশন দিতে অনেকাংশে ব্যার্থ আদিত্য কাপুর। শক্তি কাপুরের মত ভয়াবহ চেহারার একটা লোকের মেয়ে এত কিউট হোল কি করে – এই প্রশ্নটিও উদ্বেলিত করেছে পুরো মুভি জুড়ে।
শ্রদ্ধা কাপুরের জড়তাই ছিল তার অভিনয়ের প্রাণ।
অসম্ভব সুন্দর কিছু গান, মন ছুয়ে যাওয়া মেকিং, নায়কের অদ্ভুত বিষন্নতা, নায়িকার নিষ্পাপ চাউনি আর খুব চেনা একটি ভালবাসার গল্প। একটি সিনেমার প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি হিসাব না করে চোখ বন্ধ করে দেখেই ফেলা যায়। অন্তত মুভি শেষে দাঁত কিড়মিড় করে গালাগালি করার ইচ্ছা হবেনা। চোখ ফেটে নাইবা আসুক অদম্য আবেগে অশ্রুর জোয়ার, মরিচীকা হয়ে যাক শুকনো সাহারার মত কঠিন মনে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।