আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজনীতির আগুনে পুড়ছে রামু ও উখিয়া

আমি একজন পর্যটন কর্মী। বেড়াতে, বেড়ানোর উৎসাহ দিতে এবং বেড়ানোর আয়োজন করতে ভালোবাসি। তারেক মোরতাজা কক্সবাজার থেকে ফিরে কক্সবাজারের রামুতে পুড়ে যাওয়া বৌদ্ধবিহার : ফাইল ফটো হিংসার আগুনে বৌদ্ধবিহার ও বসতি পুড়ে যাওয়ার পর এখন রাজনীতির আগুনে পুড়ছে রামু ও উখিয়া। সরকার ও বিরোধী দল একে অন্যকে দায়ী করছে এ ট্র্যাজিডির জন্য। সব দলের শীর্ষ নেতারা রামু ও উখিয়া ঘুরে এসেছেন।

তবে সেখানকার মানুষের যে মূল দাবিÑ সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা এবং আসল দোষীদের গ্রেফতার করা; তা তো হয়-ই নি, বরং সঙ্ঘাত জিইয়ে রাখার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়রা বলছেন, রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির বদলে আসল অপরাধীদের ধরতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার রামু ঘুরে আসার পরও সেখানকার মানুষের আতঙ্ক কাটেনি। স্থানীয় বাসিন্দা লিটন বড়–য়া বলেন, এখনো নিজেদের অনিরাপদ মনে করছেন রামুর মানুষ। একই রকম কথা বলেছেন উখিয়ার অমিয় বড়–য়া।

রামুর সবচেয়ে প্রাচীন সীমা বৌদ্ধবিহারের ভন্তে সত্য প্রিয় মহাথেরোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম প্রধানমন্ত্রী ঘুরে যাওয়ার পর তারা কতটা আশ্বস্ত হতে পেরেছেন। জবাবে তিনি বলেন, আমরা আশ্বস্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। প্রার্থনা করছি এমন ঘটনা আর না ঘটুক। তবে নিরাপত্তা বাহিনী যে সে দিন অবহেলা করেছে এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, আমরা সম্প্রীতিতে ফিরে যেতে চাই।

তবে এ কথা ঠিক, আমাদের মধ্যে একটা উদ্বেগ এখনো রয়ে গেছে। এ উদ্বেগ কাটানোর উপায় কী? জবাবে সত্য প্রিয় বলেন, এর উপায় হলো সব বিভেদ ভুলে আমাদের আবার একসাথে কাজ করা। সেটি করতে পারলে আমরা এগিয়ে যেত পারব। নিরাপত্তা নিয়ে তখন আমাদের আর ভাবতে হবে না। প্রধানমন্ত্রীর সফরকে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীকেও বলেছি, এখানে যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের চিহ্নিত ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

এ ক্ষেত্রে কোনোভাবেই যাতে ঘাপলা না হয় সে দিকেও নজর দেয়ার জন্য বলেছি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। আমরাও আশ্বস্ত হতে চাই। কিন্তু পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা বলছেন, এটি একটি জাতিগত দাঙ্গা।

যেমনটি বলেছেন রামু ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের পলাশ বড়–য়া। তিনি বলেন, সন্দেহ নেই যে, এটি একটা জাতিগত সহিংসতা। মুসলিম ও বৌদ্ধদের মধ্যে সঙ্কট। এটি কাটিয়ে ওঠার জন্য দু’পক্ষেরই আন্তরিকতা দরকার। প্রধানমন্ত্রীর সফর এ দূরত্ব ঘোচানোর ক্ষেত্রে কিছুটা কাজ করলেও এখানে একটা সঙ্কট থেকেই যাচ্ছে।

সেটি হলো বিশ্বাসের ঘাটতি। আমরা এটি যদি কমিয়ে আনতে না পারি তাহলে সমস্যা থেকে সহজে উত্তরণের কোনো উপায় আমি দেখছি না। তিনি বলেন, আমরা বড়–য়ারা বছরের পর বছর ধরে যেভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে চলেছি, সামনেও ঠিক সেভাবে চলতে চাই। তবে ঢাকার বৌদ্ধ ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয় মনে করেন, এ ঘটনা একেবারেই রাজনৈতিক। এখান থেকে একটা ফায়দা তোলার চেষ্টা হচ্ছে।

সেটি কোন দল করছে, তা তিনি সরাসরি না বললেও এ কথা বলতে চেয়েছেন যে, তাদের মতো নিরীহদের নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা যেন না হয়। বৌদ্ধদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এখন হারানো বিশ্বাস ফেরত পেতে চাই। দোষারোপের রাজনীতি চাই না। ২৯ সেপ্টেম্বর মধুপূর্ণিমার দিন রামুর বৌদ্ধবিহারগুলোয় হামলা হয়েছে। হামলাকারীরা বৌদ্ধ বসতিও পুড়িয়ে দেয়।

অভিযোগ করা হচ্ছে, এতে গান পাউডার ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি রামু এলাকার বাইরের থেকেও লোকজন গিয়ে এ হামলায় অংশ নিয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল শ্রীকুল রাখাইন বৌদ্ধবিহারে। আর কুরআন অবমাননার যে ছবি নিয়ে এটি ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সেটি ছড়ানো হয় রামু চৌমুহনীর ফারুকের দোকান থেকে। সেখানে উত্তম বড়–ুয়া নামে এক যুবক কুরআন শরিফের অবমাননামূলক কয়েকটি ছবি ট্যাগ করে, যা অন্যরা দেখে ফেললে এ নিয়ে আলোচনা হয়।

বলা হচ্ছে তা ফারুকের দোকানের ডেস্কটপ কম্পিউটারের সেভ করা ছিল। সেখান থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ছবিটি সংগ্রহ করে তা দিয়ে ফেস্টুন বানায় এবং ঘটনার রাতে ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে প্রথম মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে পরে স্থানীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি সেলিম যোগ দেন। এ ছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান সরোয়ার কাজল এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা চৌমুহনীতে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। বিএনপির টিকিটে নির্বাচনে জেতা সংসদ সদস্য লুৎফর রহমান শেষ দিকে এ সমাবেশে গিয়ে বক্তব্য রাখেন।

বক্তব্য রাখেন স্থানীয় থানার ওসি নজিবুল ও ইউএনও দেবী চন্দও। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, হামলার শুরু হয় সমাবেশ চলাকালেই। এমনকি রাখাইন বৌদ্ধবিহারের ভন্তে নয়া দিগন্তকে বলেছেন, তাদের মন্দিরে ভাঙচুর শুরু হয় সমাবেশ চলাকালে। এ ঘটনার পরও পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন সতর্ক হয়নি। এসব হামলার সাথে স্থানীয়রা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করলেও সরোয়ার কাজল সে অভিযোগ অস্বীকার করে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের মধ্যে পদ হোল্ড করেন এমন কোন্ োনেতা এ হামলায় অংশ নেননি।

শত শত লোক হামলায় অংশ নিয়েছে; সবাইকে তো চেনা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ হামলায় বাইরের লোকও অংশ নিয়েছে। তবে সেসব বাইরের লোক কারা, তা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি। ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ঘটনাস্থল রামু পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানে গেলে তাকে ঘটনা ব্রিফ করেন বিজিবির ১৭ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল খালেকুজ্জামান। নয়া দিগন্তকে তিনি বলেন, আমরা মধ্যরাতে এখানে আসি।

এরপর যা ঘটেছে আমি তার বর্ণনা দিয়েছি মন্ত্রীকে। খালেকুজ্জামানসহ বলেন, এটি এ রকম একটি ঘটনা যেটাকে আমার কাছে পরিকল্পিত বলেই মনে হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রামু থেকে ঢাকা ফেরার আগেই উখিয়ার বৌদ্ধবিহারগুলোতে আক্রমণ শুরু হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টায় প্রথমে আক্রান্ত হয় উখিয়া বাজারের প্রাচীন জাদিমুড়া বৌদ্ধবিহার। সেখানে হামলা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা।

তাদের ছয়জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা হয়েছে। তবে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার তো করেইনি, বরং এখন ওই সব আসামি মামলা তুলে নেয়ার জন্য বিহার পরিচালনা পর্ষদকে হুমকি দিচ্ছে; নইলে পুরো বিহার গুঁড়িয়ে দেবে তারা। এসব কথা বিহারের পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানো হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন ওই বিহারের ভন্তে। সূত্র মতে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারদলীয় যারাই রামু ও উখিয়া সফর করেছেন, তাদের সবাই ঘটনার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সোমবার এ ঘটনার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যকে দায়ী করে বক্তব্য রাখেন।

অন্য দিকে বিএনপির যে তদন্ত দল সেখানে গেছে, তারা প্রাথমিকভাবে পুলিশের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে। তদন্ত দলের প্রধান ও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, এ ঘটনা পুলিশের ব্যর্থতা স্পষ্ট। তবে এর কারণ সম্পর্কে এখনই তারা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। একই রকম ভাষ্য রামু ও উখিয়াবাসীর। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তরুণ বড়–য়া নয়া দিগন্তকে বলেন, পুলিশ একটা হুইসেল পর্যন্ত দেয়নি।

একটা হুইসেল দিলে, লাঠিচার্জ করলে কিংবা ফাঁকা গুলি করলে ঘটনা এত দূর গড়াত না। তিনি জানান, রাখাইন বৌদ্ধবিহারে হামলার দেড় ঘণ্টা পর সীমা বৌদ্ধবিহারে হামলা হয়েছে। পুলিশ সতর্ক থাকলে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। দুটো বিহারের দূরত্ব মোটে ৭ মিনিটের হাঁটাপথ। স্থানীয়রা বলেছেন, সরকার ও অন্য সব রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক দোষারোপের ধূম্রজালে রামু ও উখিয়ায় যে নারকীয়তা ঘটানো হয়েছে, তার পেছনে আসলে কারা রয়েছে, তা চাপা পড়ে যাবে।

যেমনটি চাপা পেড়ে আছে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড কিংবা ইলিয়াস আলী গুমের মতো ঘটনা। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের এ রকম জঘন্য অপতৎপরতায় যারাই জড়িত, তাদের বিচার হওয়া উচিত এবং সে জন্য সরকারকে রাজনীতির বদলে সম্প্রীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য লুৎফর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এখানে দোষারোপের রাজনীতি চূড়ান্তপর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। তার মতে, আসল দায়ীদের খুঁজে বের করার বদলে হিংসার রাজনীতির চর্চা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কক্সবাজার বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি বোধি প্রিয় বড়–য়া নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা আস্থার সম্পর্ক আবার গড়ে তুলতে চাইছি।

রাজনৈতিক বিদ্বেষ ছড়িয়ে এটি করা সম্ভব নয়। আমরা সরকারের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি দাবি করছি। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.