আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এখানে সবাই উপস্থিত ছিলো

বিকট * -শুরু করব? -হ্যাঁ, শুরু করেন। সবাই এসে গেছে। * নতুন বাসায় ওঠার পর ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরোনো পাপ এবং পঙ্কিলতাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে নব বাসস্থানটির জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে আদৌ কোন লাভ হয় বলে আনিস বিশ্বাস করে না। কিন্তু তার ধর্মপ্রাণ মায়ের কঠোর আদেশ মেনে চলতেই হয় তাকে। বাবা-মা যদিও তার সাথে থাকেন না, গ্রামের হলুদ সরিষা ক্ষেত আর সবুজ প্রান্তরের মাঝে নীল আকাশের ছায়া দেখতে ভালোবাসেন তারা।

আনিস ঢাকায় নতুন বাসায় উঠছে জেনে তার মা ফোন করে দোয়া-আশীর্বাদ ইত্যাদি জানিয়ে সাথে এই আদেশও করেন, যেন বাসার মঙ্গলার্থে একটি মিলাদ দেয়া হয়। বাতের বেদনা বেড়ে যাওয়ায় তিনি উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে আফসোস করলে আনিসের মনটাও খারাপ হয় কিছুটা। এত ব্যস্ততার মাঝে গ্রামে যাবার জন্যে সময় বের করা তার জন্যে প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। কতদিন ছোঁয়া হয়না সবুজ, দেখা হয় না নীল, স্পর্শ করা হয় না মাটি। স্নেহবৃক্ষের ছায়াতলে বসে শরীর জুড়োনো হয় না।

মিলাদের মত ঠুনকো সামাজিক উপলক্ষ্যে মা এলে পরে কত ভালো হত! বাবাকে বলা যায়, কিন্তু সে যেমন এক চ্যাম্পিয়ন ঘরকুনো গেরস্থ! তার কালো গাইয়ের আসন্ন সন্তান, গোয়ালঘরের প্রয়োজনীয় পরিচর্যা, পুকুরে বেড়ে যাওয়া কচুরীপানা নিস্কাশন, ক্ষেতে পোকামাকড়ের সংক্রমন নিরসন; এসব ক্রীয়াকর্ম ছেড়ে সে আসতে চাইবে ভাবাটা দুরাশা। মিলাদে বেশি মানুষকে না দাওয়াত না দিলেও চলবে। মহল্লায় কেবলই আসা হল, কারো সাথে পরিচয় হয়নি তেমন। বাড়িঅলাকে বলতে হবে, আর কাছাকাছি থাকা কিছু বন্ধুবান্ধব। বিল্ডিংয়ের সব ভাড়াটেকে জানাতে হবে অবশ্যই।

এই তো! তাহলে আগামী ১২ই অক্টোবর বাদ আছর নতুন বাসায় আগমন উপলক্ষ্যে মিলাদ। আর কাকে কাকে দাওয়াত জানানো যায় শেষবারের মত ভাবতে বসে আনিস। * "শুরু করেন হুজুর" হুজুর তার আনুনাসিক একঘেয়ে স্বরে দীর্ঘদিনকার প্রচলিত মিলাদ সঙ্গীত গাইতে থাকেন। আনিসের মন নেই সেদিকে। কিছুই না করে বসে থাকলে মানুষজন ভালো চোখে দেখবে না, তাই সে বিড়বিড় করে কিছু বলার ভান করে।

আর কিছুক্ষণ, তারপর এই ধার্ম-সামাজিক অতিষ্টানুষ্ঠানের অবসান হবে। শুরু করতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিলো। শেষ হতে হতে সাঁঝ নেমে আসবে। সন্ধ্যাবেলা সময়টা আনিসের বেশ প্রিয়। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে সন্ধ্যাকাল তার বন্ধ্যা সময়কে মনোরম করে তোলে।

এ সময়টায় জানালার পাশে বসে বই পড়ার ছলে পাশের বাসার ব্যালকনিতে টাঙানো নারীবস্ত্রগুলোকে জীবন্ত হিসেবে কল্পনা করে সে বেশ পূলক অনুভব করে। সাঁঝবেলায় পাশের বাসার শ্যামলা তরুণীটি নিশ্চয়ই একদিন কাপড়গুলো তুলতে আসবে! মাত্রইতো তিনদিন হল এসেছে সে। একটা রোমান্টিক চমকের জন্যে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা যেতেই পারে! অস্থির হবার কিছু নেই। মিলাদ চলাকালীন বিরক্তিকর সময়টায় এসব ভেবে বেশ কেটে যায় আনিসের। এইতো তোবারক বিতরণের সময় চলে এলো বলে! ক্ষিধেও পেয়েছে বেশ।

সান্ধ্যভোজন এ দিয়েই বেশ চলে যাবে। -আপনারা সবাই সুরা ফাতিহা তিনবার, সুরা এখলাস পাঁচবার এবং দুরুদ শরীফ সাতবার পড়েন। "তুমি যে নূরেরও নবী" শুনতে অবশ্য খারাপ লাগছিলো না! বেশ সুরেলা ধর্মীয় সঙ্গীত। তবে এখন গুনগুন করে সম্মিলিত শব্দে মিলাদের উপসংহার ঘোষণাটা আরো বেশি ভালো লাগছে। গুনগুন আওয়াজটা একটু বেড়ে গেল কী? হয়তোবা।

বাড়লেও মানুষের শ্রাব্যতার সীমার সহনীয় মাত্রার মধ্যেই রয়েছে। ভুলে যাওয়া সুরা এবং দোয়াগুলো মনে করে গুনগুনতানে যোগ দেবার প্রয়াস নেয় আনিস। কিন্তু আওয়াজটার ক্রমবর্ধমান তীব্রতা তাকে মনোযোগবিচ্যুত করে। গুনগুন না এখন শব্দটাকে রীতিমত গমগম বলা যায়! হঠাৎ এত বেড়ে গেল কেন শব্দটা? মানুষজন কি তোবারক পাবার নেশায় ক্ষেপে উঠেছে? মনে মনে খুব বিরক্ত হয় আনিস, তবে তা প্রকাশ করে না। নাহ, শব্দটা শ্রাব্যতার সহনীয় সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

হুজুর কিছু বলছে না কেন? নাকি সেই নেতৃত্ব দিচ্ছে এসবের? ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সময় প্রশ্ন করাটাও তো আবার বেয়াদবি! আনিস চোখের ইশারায় হুজুরকে সংকটাবস্থার কথা জানিয়ে অনুষ্ঠান সমাপ্ত করার অনুরোধ করে। কাজ হয় এতে। হুজুরের অঙ্গুলিচলনে থেমে যায় সবাই। -কী হয়েছে জনাব? কিছু বলবেন? -হ্যাঁ, বলছিলাম যে মিলাদটা শেষ করে দেন না তাড়াতাড়ি! অনেকক্ষণ তো হল! আর সবাই এত শব্দ করছিলো কেন সূরা পড়ার সময়? -শব্দ আরো বাড়তে পারে জনাব। আরো মানুষ আসবে তো।

মিলাদ এখনও শেষ হয় নাই। দেরী হবে। এত পেরেশান হচ্ছেন কেন? কত মানুষ আসবে, কত উপলক্ষ্যে, সবই তো আপনার খাতিরেই! -কী কন! দরকার নাই আমার অত খাতিরের। আরো মানুষ, আরো দেরী মানে! বিস্ময় এবং ক্রোধে প্রায় চিৎকার করে ওঠে আনিস। ফাজলামি করছে নাকি লোকটা! "হ ইমাম সাব, শুরু করেন।

আমরা সবাই আইসা পড়ছি। " খুব পরিচিত একটা কন্ঠ। কে যেন? ওহ, তার গ্রামতুতো চাচা খয়ের উদ্দীন। তাদের পরিবারের তদারকিতে সে সবসময় তৎপর থাকে বলে তারা তাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সমীহ করে। আনিসের এও মনে পড়ল যে, হুজুরটি তাদের গ্রামে ইমামতি করতেন আগে।

এজন্যেই খয়ের চাচা তাকে ইমাম সাব বলছেন। কিন্তু চাচা আবার মাতবরি করতে এখানে এল কেন? ভালো যন্ত্রণা তো! -কী হইল ভাতিজা? এমুন কইরা চায়া আছো কেন? খবরটা শুইনা মন খারাপ হইছে? চিন্তার কিছু নাই। আল্লার নাম নাও। সব ভালো হইয়া যাইবো। ইমাম সাব, শুরু করেন না! আনিসকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ইমাম সাহেব তার সেই বিরক্তিকর আনুনাসিক ছিচকাঁদুনে কন্ঠে বয়ান করতে থাকেন, "আমাদের মহল্লার নতুন বাসিন্দা, মুহাম্মদ আনিসুজ্জামান আজ আল্লাহর এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন।

তার আম্মার হায়াৎ আল্লাহপাকের জামিনদারী ছাড়া ইনকেলাব পাবে না। এ্যায় আল্লাহ, তুমি সন্তানের মুখে হাসি ফুটিয়ে দাও। সে কোন তকলিফ করে থাকলে ক্ষমা বখশিস করে দাও" -থামেন! কী বলেন এসব? আম্মার কী হয়েছে? আনিস এবার বেশ জোরেই চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু ততক্ষণে মিলাদ শুরু হয়ে গেছে। তার কথায় কর্ণপাত করে না কেউ।

আনিসের কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে খয়ের উদ্দীন। "মিলাদে এত মানুষ হইছে, কারু না কারু দোয়া তো আল্লায় কবুল করবই! তমি শান্ত হও ভাতিজা। ভাষণ বন্ধ কইরা মিলাদ শুরু করেন ইমাম সাব। " "ইয়া নবী সালামুআলাইকা..." গমগম করতে থাকে পুরো ঘর। আনিস ভীত চোখে তাকায় চারপাশে।

কালো কালো মাথা দুলছে মিলাদসঙ্গীতের তালে তালে। সবার মাথায় কালো টুপি। মিলাদ পড়তে এসে এরকম দলবদ্ধ ম্যাচিং টুপি এই প্রথম দেখল আনিস। অন্যসময় হলে এটার একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা বের করার চেষ্টা করত সে। কিন্তু আজকে সবকিছুই গোলমেলে।

এতক্ষণ ধরে মিলাদ হচ্ছে কেন? এত মানুষ এলো কোথা থেকে? গমগম আওয়াজে আতঙ্কের তরঙ্গ ঝাঁকি দিয়ে যায় তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সে পালাবার পথ খুঁজতে থাকে। একে তো এই ভৌতিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান, তার ওপর মায়ের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা। প্রস্থানপথ খুঁজতে পাগলপারা হয়ে যায় সে। কিন্তু যাবে কোথায়? সব দরজা বন্ধ।

কালো কালো মাথাগুলো ভক্তিতে নুয়ে ওপর-নীচ দুলছিলো, তারা আচমকা আনিসের গতিবিধি লক্ষ্য করে সটান বসে যায় শিরদাঁড়া সোজা করে। স্থির, ঠান্ডা চোখে তাকায় আনিসের দিকে। এবার তারা মাথা ডানে-বামে এদিক ওদিক করে সম্মিলিত নেতি আন্দোলনে ব্রতী হয়। তারা আনিসকে কোথাও যেতে দেবে না। আনিস উদভ্রান্ত চোখে জানালার দিকে তাকায়।

ঐ তো, ঐ যে দেখা যাচ্ছে তার আকাঙ্খিত শ্যামলা মেয়েটাকে! মৃদু হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে সেও ডানে-বামে মাথা নাড়ছে। তার দেহভঙ্গিমাকে নৈর্বক্তিক দৃষ্টিতে দেখে আনিস। মেয়েটি তাকে কোথাও যেতে দেবে না? আটকে রাখবে এই চক্রবুহ্যে অন্যান্যদের মত? সেও কি তাদের দলভূক্ত? নাকি সে কখনও ছিলো না, কখনও থাকবে না? অথবা থাকলেও আনিস কখনও তাকে ছুঁতে পারবে না? এই ধাঁধা সমাধানের সময় নেই এখন। "আপনারা সবাই সুরা এখলাস পাঁচবার, দুরুদ শরীফ সাত বার এবং সূরা ফাতিহা এগার বার করে পড়েন"। হুজুরের এই নির্দেশে আশ্বাস খোঁজে আনিস।

এবার কি তবে শেষ? এখন কি মুক্তি পাবে সে এই ভয়ংকর আনুষ্ঠানিকতা এবং অজানা চক্রান্তের ঘেরাটোপ থেকে? -তোমার আম্মায় মাশাল্লা ভালা আছে এখন। বল আলহামদুলিল্লাহ। খয়ের চাচা বলেন। -আলহামদুলিল্লাহ! মিনমিনে কন্ঠে বলে আনিস। মায়ের রোগমুক্তির চেয়ে এই অসহনীয় মিলাদমুক্তির সম্ভাবনাই তাকে বেশি স্বস্তি যোগায়।

-হুজুর, তাইলে তোবারক দেয়া শুরু করি? আনিস সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করে। -এত তাড়াতাড়ি! আপনাদের কারো কি ক্ষিধা পাইছে? উপস্থিত জনগণের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সে ষড়যন্ত্রী ভঙ্গীতে তার প্রত্যাশামত জবাব আসবে এই আস্থায় বলীয়ান হয়ে। -না! সমস্বরে জানান দেয় সবাই। -আমাদের কারো তো ক্ষিধা পায় নাই। তোবারক দিয়া কী হবে? আসেন না আরেকটু আল্লা বিল্লা করি।

"দেখেন", কন্ঠস্বরে কঠোরতা আরোপ করে আনিস। আপনারে শুধু একটা মিলাদের জন্যে আনা হইসিলো। এখন কি শুরু করসেন এইগুলা? -আমি একা কী করলাম! আরো মানুষ আসতাছে দেহেন না? আরো মানুষ, আরো খবর, কুনডা ভালো কুনডা খারাপ কইতে পারি না। আমার কাজ মিলাদ পড়ানো, আমি পড়ামু। পড়ামুই! আনিস পেছন ফিরে তাকায়।

সত্যিই তো! আরো মানুষ আসছে। আরো অনেক অনেক মানুষ আসছে। তার এই ছোট্ট ঘরে এত মানুষ আঁটবে কীভাবে? মানুষ আসছে। কালো কালো মাথা সবার। নুইয়ে রেখেছে নীচে।

ভক্তিতে। ঠেলাঠেলি হচ্ছে, সংঘর্ষ হচ্ছে, কিন্তু সবাই মেনে নিচ্ছে নির্বিকার ঔদাসিন্যে। আনিসের কেমন দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। তার নাকের ওপর বসে পড়ছে মানুষ, উরুকে টুল বানিয়ে ব্যবহার করছে কেউ, তার চোখ ঢেকে দিয়েছে কে যেন! এবার আক্ষরিক অর্থেই আনিসের দমবন্ধ লাগে। -হুজুর, শুরু করেন।

আনিস বুঝতে পারে, এই চক্র থেকে পালানোর কোন পথ নেই। শ্বাস নেবার জন্যে হাঁসফাঁস করতে করতে সে বেশ কিছু মিলাদ উপলক্ষ্য শুনতে পায়। সবই সে এবং তার পারিপার্শ্বিকতাকে কেন্দ্র করে বিরচিত। "আনিস তুমার বাপে পইড়া যায়া আঘাত পাইছে। -ইমাম সাব শুরু করেন।

"আনিস, তুমার বাবা অহন ভালো আছে" -মাশাল্লাহ, ইমাম সাব শুরু করেন। "আনিস ভাই, আপনার বোনের একটা ছেলে হয়েছে! আপনি মামা হয়েছেন!" ইমাম সাহেব সুরেলা কন্ঠে গেয়ে চলেন, "তুমি যে নূরেরও নবী নিখিলে ধ্যানেরও ছবি তুমি না এলে দুনিয়ায় আঁধারে ডুবিত সবই" আঁধার! আনিসের চোখে এখন আঁধারঠুলি পরানো। কন্ঠ রূদ্ধ হয়ে আসছে। একটু বিশূদ্ধ বাতাসের জন্যে প্রাণপন চেষ্টা করছে। মৃত্যুর মাকড়শা জাল বুনে চলে।

আনিস ছাড়াতে গিয়ে আরো আঁটকে যায়। শ্বাস না নিয়ে কতক্ষণ থাকতে পারে মানুষ? শরীরের কোষে কোষে মৃত্যুর বারতা পৌঁছে যাচ্ছে। আনিস ডুবে যাচ্ছে আঁধার নর্দমায়... "ওহ আল্লাহ! বাঁচাও আমাকে। এত তাড়াতাড়ি তুলে নিও না। আমি আর কোনদিনও..." তার ফ্যাঁসফ্যাঁসে কন্ঠের আকূতি জট পাকানো শব্দবলের মত করে আরাধনারত মানুষগুলোর কাছে গেলে তাদের মোহবিষ্টতা কেটে যায়।

তারা দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে থাকা আনিসকে কিছুটা জায়গা করে দেয়। সবার দৃষ্টির ছন্দসমতা অর্জিত হলে তারা আনিসের দিকে চেয়ে থাকে গভীর আগ্রহে। তার কোষে কোষে প্রাণ ফিরে আসে ধীরে। জীবনের পরিবর্ধিত একটা অংশ উপহার পাবার পর চোখ মেলেই দেখতে পায় একদল সোৎসাহী মানুষকে, যারা গভীরভাবে নীরিখ করছে আনিসের বুকের ওঠানামা, চোখের সাদা অংশের ঘোলাটে রূপান্তর এবং পুনরায় সাদায় প্রত্যাবর্তন, গলার কাছে শক্ত হয়ে এঁটে থাকা পিন্ড। -আপনারা এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? -আনিস, তুমি বাঁইচা আছো? আলহামদুলিল্লাহ! হুজুর, শুরু করেন।

আনিস বেঁচে থাকে। তার আয়োজিত শুভকামনামূলক অনুষ্ঠানের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে বেঁচে থাকে। ইমাম সাহেব ক্লান্তিহীনভাবে দোয়া দুরুদ পড়ে যাচ্ছেন। আর সমবেত জনতাও মাথা ওপর নীচ করে সঙ্গত করছে। আনিসকে আবারও মৃত্যানুভূতি পেয়ে বসে।

এই ভৌতিক বর্তনীতে আঁটকা পড়ে জীবনটা কার তর্জনীর নির্দেশে ঘুরপাক খায় সে বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না সময় এবং জীবনের বয়ে চলা। রাত কত হল? কত রাত গেল? রাত শেষ হয়নি? হবে না কখনও? একটা ভোর! একটা পাখি ডাকা ভোর, হকারের কলিংবেল টিপে অধৈর্য্য হয়ে অবশেষে কলাপসিবল গেট ঝাঁকানো ভোর, মুয়াজ্জিনের কন্ঠে "আসসালাতু খাইরুন মিনান নাওম" আহবানে জেগে উঠবে না ভোর? জেগে উঠবে না মানুষ? কেউ কি তাকে উদ্ধার করবে না, হাত বাড়িয়ে দেবে না এই রাত-মিলাদ-উপলক্ষ্য-আয়োজন-উদযাপন-শোককাঁপন-রাত এর নাগচক্র থেকে? একটু একটু আলো আসছে নাকি? সফেদ, পেলব, স্নিগ্ধ একটু আলো দেখা গেল যেন চকিতে! ঐ যে জানালা! ঐ যে ব্যালকনি! ঐ যে মেয়েটা! মেয়েটার পাশে ওরা কারা? বাবা! মা! ওরা কি তাকে ডাকছে? নাকি নিষেধ করছে আসতে? এত ঝাপসা আলো, কিচ্ছু বোঝা যায় না। আরেকটু অপেক্ষার পরে ভোরের আলো দেখার জন্যে আনিস বেঁচে থাকার শক্তি অর্জনের চেষ্টা করে। মিলাদের তোবারকের জন্যে অপেক্ষা করা বৃথা।

এখন অপেক্ষা প্রিয়জনদের কাছে যাবার। দেখা বা না দেখা জন। তাতে কিছু এসে যায় না। আনিস অপেক্ষা করে। অপেক্ষার গোপন সংকেত পেয়ে আরাধনারত জনতা হঠাৎ থেমে যায়।

হাই তোলে। "তোবারক দিবেন না ইমাম সাব? অনেক তো হইল। এইবার শেষ করেন। আর দরকার নাই" খয়ের কাকার কন্ঠ। ভুল শুনছেনা তো আনিস! অবশেষে শেষ হচ্ছে এই বিভিষীকা কাল? হলে হোক, অন্য অপেক্ষায় বুদ থেকে সে দূরে সরিয়ে রাখে নিজেকে এতদিনকার প্রতীক্ষার দুঃস্মৃতি থেকে।

-হ, শেষ। তোবারক রেডি কর। ইমাম সাহেব সায় জানান। "দরকার নেই, দরকার নেই আমার তোবারকের, আমি ঐ ব্যালকনিটায় যাবো...যাবো...যাবো..." হঠাৎ আসুরিক শক্তি ভর করে যেন আনিসের শরীরে। ছিটকে ফেলে দেয় আশেপাশের কালো কালো কায়াগুলোকে।

সে উঠে দাঁড়াতে চায়। দাঁড়াতে গিয়ে মুখ থুবরে পড়ে। নিঃশেষ হয়ে আসছে শক্তি, প্রাণ, দেহকোষে আবারও বেজে ওঠে মরণের টংকার! -আনিস, তুমি কি মইরা যাইতাছো? ইন্নালিল্লাহ! খয়ের চাচার কন্ঠে ঠিক কোন অনুভূতি খুঁজে পাওয়া যায় না। -তোবারকগুলা তো সব নষ্ট হয়া গেছে গা। এতদিন কী আর ঠিক থাকে! ব্যবস্থা করা দরকার খয়ের ভাই।

ইমাম সাহেব জানান। -দরকার নাই আমার তোবারকের। আমি ঐখানে যামু, ঐখানে। ঐখানে আছে, ঐখানে...আছে... আ...আ...আ... আনিসের চোখের সামনে আবারও বামে-ডানে নেতিবাচক ভঙ্গীতে মাথা নাড়তে থাকে নুয়ে থাকা মানুষগুলো। এখন আর তাদের ইমাম সাহেব অথবা খয়ের উদ্দীনের নেতৃত্বের প্রয়োজন হয় না।

* -লন তোবারক লন। -মাংসটা টেস্টি না। শুকনা দেহ। -স্বাস্থ্য ভালা না। আর তাছাড়া কত রক্ত গেছে শরীর থিকা, ঐরকম হইলে মাংসের টেস্ট নষ্ট হয়া যায়।

-চোখের মনিটা ভালা আছে এখনও। লন না, খান? কবরের মাংসভূক পতঙ্গেরা বেশ মৌজে আছে নতুন একটা মৃতদেহ পেয়ে। তাদের সাথে সমান্তরালে চলা স্ব-প্রজাতির উপলক্ষ্যকামী নেতৃত্ববান আপনজনেরাও। তোবারক বিতরণে সবাই তুষ্ট।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.