বিনিয়োগ করে টাকা সাদা করার আগ্রহ নেই কালোটাকার মালিকদের। এমনকি শেয়ারবাজারেও তাঁরা যাচ্ছেন না। কালোটাকার মালিকেরা দেশে সবচেয়ে বেশি কালোটাকা সাদা করেছেন জমি ও ফ্ল্যাট কিনে।
দেশে সবচেয়ে কম কালোটাকা সাদা হয়েছে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। আর বেশি হয়েছে গাড়ি, বাড়ি ও জমি কেনার ক্ষেত্রে।
ফলে আবারও জমি ও ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দিয়েছে সরকার। আর শেয়ারবাজারে সাড়া না পাওয়ায় এই বিধানটি বাতিল করা হয়েছে।
এর বাইরে দেশে কালোটাকা বেশি সাদা হয়েছে ভয়ে, ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। সব মিলিয়ে দেশে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৫১৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা সাদা হয়েছে। আর এ থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে মাত্র এক হাজার ৪০৭ কোটি ২১ লাখ টাকা।
খুব বেশি অর্থ সাদা না হলেও কালোটাকার মালিকদের আবারও নতুন নতুন সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অথচ ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘অপ্রদর্শিত আয়কে বিনিয়োগে ব্যবহার করার জন্য এ দেশে বহুবার নানা ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে কখনো তেমন ফল পাওয়া যায়নি। ’
অর্থমন্ত্রী এর আগেও অনেকবার বলেছেন, তিনি কালোটাকা সাদা করার পক্ষে নন। তার পরও প্রথম থেকেই তিনি এই সুযোগ দিয়ে আসছেন।
২০০৯ সালের ১২ জুন বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে একে ‘রাজনীতির কাছে নৈতিকতার পরাজয়’ উল্লেখ করেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। তার পরও এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ সমঝোতা। কেননা, রাজনীতি হলো আপসের সবচেয়ে নিপুণ কৌশল। রাজনীতিতে সব ধরনের মানুষ ও সব ধরনের স্বার্থকে সমন্বয় করে চলতে হয়।
’
গত শুক্রবার বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি একইভাবে সমঝোতার কথা বলেছেন।
বাজেটের ঠিক আগে মাছরাঙা টেলিভিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে সমঝোতা সব সময়ই করতে হয়। এটাই রাজনীতি। কিন্তু যদি আমার আগের সময় হতো, তাহলে আমি বলতে পারতাম, না, এটা আমি করব না। কিন্তু এখন...।
’
গত শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ঠিক কাদের সঙ্গে তিনি সমঝোতা করেছেন। অর্থমন্ত্রী সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর দেননি। তবে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নির্বাচনী বছরে এ ধরনের সুযোগ প্রায় সব সরকারই অতি আগ্রহের সঙ্গে দিয়ে থাকে।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, এটা রাজনীতির সঙ্গে সমঝোতা। কিন্তু আমাদের কথা হলো, কালো- টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া নীতি-নৈতিকতাসহ মৌলিক মূল্যবোধ ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তাহলে জনগণ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে রাজনীতি কতটা হবে?’
তাঁর মতে, এ ধরনের সুযোগ দিলে সমাজে একধরনের বার্তা পৌঁছায় যে, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করলে একসময় পার পাওয়া যায়। এতে বৈধ উপার্জনকারীরা কর প্রদানে নিরুৎসাহিত হন।
সংবিধানের ২০(২) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না। ’
আগ্রহ নেই, তবু সুযোগ: দেশে ঘোষণা দিয়ে প্রথম কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, সামরিক আইনের আওতায়। কিন্তু সেই সুযোগও খুব বেশি মানুষ নেননি।
ফলে ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় (১৯৭৭ সালের ২৫ জুন) রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘নানা কারণে অনেকে এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারেননি বলে আবেদন-নিবেদন বিবেচনা করে সরকার তাঁদের কর-অনারোপিত প্রকৃত আয়ের ঘোষণার জন্য এ বছর ৩০ জুন পর্যন্ত আর একবার সুযোগ দিয়েছেন। আশা করা যায়, করদাতারা তাঁদের এখনো অপ্রকাশিত আয় ঘোষণার এই শেষ সুযোগ হারাবেন না। কেননা, এরপর কর ফাঁকির মামলাসমূহের ব্যাপারে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ’ জিয়াউর রহমানের সময় মাত্র ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা হয়েছিল।
এরপর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক আইন জারি করে লে. জেনারেল এরশাদ সামরিক আইনের ৫ নম্বর ধারায় ১৫ শতাংশ কর দিয়ে আবারও একই সুযোগ দেন।
শুরুতে নিয়মকানুন কঠোর হলেও পরে তা অনেক সহজ করা হয়। তার পরও এরশাদের সময় মাত্র ৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা সাদা হয়েছিল।
এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি সরকার গঠন করলে অর্থমন্ত্রী হন এম সাইফুর রহমান। তিনি ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের বাজেটে বলেছিলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে কালোটাকা বৈধ করার যে ধরনের বৈষম্যমূলক কর দায়মুক্তির সুবিধা দেওয়া হয়েছে, আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে, এ ধরনের গণতান্ত্রিক ও গোষ্ঠী স্বার্থপ্রসূত বৈষম্যমূলক করনীতি আমাদের এ গণতান্ত্রিক সরকার সম্পূর্ণ পরিহার করবে। ’ সে সময়ে ঘোষণা দিয়ে কখনো কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
তবে এখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যাচ্ছে, ১৯৯১ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত ১৫০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা সাদা হয়েছিল। সে সময়ে আয়কর আইনে অন্য কোনো পদ্ধতিতে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ ছিল কি না, তা-ও এনবিআর সূত্র বলতে পারেনি।
এরপর আওয়ামী লীগের সময় প্রায় প্রতিবছরই নানাভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল থাকে। সে সময়ে অর্থমন্ত্রী ছিলেন শাহ এ এম এস কিবরিয়া। তিনি প্রথমবারের মতো কর দিয়ে জমি-ফ্ল্যাট বিলাসবহুল গাড়ি কিনলে বিনা প্রশ্নে তা মেনে নেওয়ার বিধান করেন।
এ ছাড়া শিল্প ও পুঁজিবাজারেও বিনিয়োগে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ ছিল।
তবে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরের বাজেটে শাহ এ এম এস কিবরিয়া স্বীকার করে নেন যে, কালোটাকা সাদা করার এই সুযোগ দিলেও এতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের ক্ষেত্র কেবল নতুন শিল্পে সীমিত রাখার কারণে করদাতাদের কাছ হতে তেমন আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়নি। ’ একই ধরনের কথা তিনি আবারও বলেছিলেন ২০০০-০১ সালের বাজেটে। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অপ্রদর্শিত আয় বিদ্যমান আছে বলে ধারণা করা যায়।
ইতিপূর্বে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়া হলেও ঘোষণার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত রাখায় আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়নি। ’
১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৯৫০ কোটি ৪১ লাখ টাকা সাদা হয়।
এরপর আবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে অর্থমন্ত্রী হন এম সাইফুর রহমান। তিনি এ সময় অবাধে সব ক্ষেত্রে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তিনি এর পক্ষে বলেছিলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিতে বিপুল অঙ্কের কর অনারোপিত আয় রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইতিপূর্বে একাধিকবার কর অনারোপিত আয় ঘোষণার বেলায় যে আংশিক কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল, তাতে বিনিয়োগের কোনো দিক-নির্দেশনা না থাকায় এতে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া যায়নি। ’
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ে কালোটাকা সাদা হয় ৮২৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান এনটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কালোটাকা সাদা করা প্রসঙ্গে বাজেটের আগে বলেছিলেন, যদি সুযোগ থাকে তাহলে তিনি তাঁর বাজেট বক্তৃতার নিচে একটা পাদটীকা সংযোজন করতে চান যে, এই পদক্ষেপটা তিনি নিতে বাধ্য হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চাপে।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর আবারও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে বলা হয়, এর মধ্যে সুযোগ না নিলে সর্বোচ্চ ২৫০% পর্যন্ত জরিমানা করা হবে।
অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার এই সুযোগ নেয় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। আর এতে বৈধ হয় নয় হাজার ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
২০০৯ সালে নতুন সরকার গঠন করার পর আওয়ামী লীগ আরও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। এমনকি আয়কর অধ্যাদেশে স্থায়ীভাবে নতুন একটি ধারা সংযোজন করে কালোটাকা সাদা করার আইনি সুযোগ রাখা হয়। এই ধারাটি হচ্ছে ১৯ ই।
এর ফলে প্রযোজ্য আয়করের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দিলে যে কেউ অর্থ সাদা করতে পারবেন।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গাড়ি, জমি ও ফ্ল্যাট কিনে কালোটাকা সাদা করা-সংক্রান্ত আয়কর অধ্যাদেশের সব কটি ধারা (১৯বি, ১৯ বিবি, ১৯ বিবিবি) বিলুপ্ত করে দিয়েছিল। বর্তমান সরকার আবার গাড়ি ছাড়া বাকি সবগুলো সুযোগ নতুন করে দিয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ফ্ল্যাট ও গাড়ি কিনে এক হাজার ৪৭৫ জন ৭৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা কর দিয়েছিলেন। আর জমি কিনে ১৭৬ জন পাঁচ কোটি ৮৪ লাখ টাকা কর দেন।
২০০৯-১০ অর্থবছরে কালোটাকা দিয়ে জমি ও ফ্ল্যাট কিনেছিলেন এক হাজার ৩২০ জন। আর তাতে সরকার কর পায় ২৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।