তাঁরা সবাই ‘সাধারণ মানুষ’। সাভারের ভবনধসে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে তাঁরাও কাজ করেছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। দেখিয়েছেন অসাধারণ সাহসিকতা। তাঁদের কয়েকজনের মুখোমুখি হয়েছিলেন মো. রুবেল ও মো. সাইফুল্লাহ
‘ওরাও তো আমার মতোই শ্রমিক’
আমরা তখন দাঁড়িয়ে আছি ধসে পড়া রানা প্লাজার উল্টো দিকে। বিশালকায় ক্রেনগুলো ভেঙে পড়া কংক্রিট সরাতে ব্যস্ত।
অপেক্ষায় থাকা স্বজনদের সাথে দাঁড়িয়েছিলেন এ কদিন নিরলস পরিশ্রম করে যাওয়া উদ্ধারকর্মীরাও। ভিড়ের মধ্যে ছিলেন চিকিৎসক, সাংবাদিক, পথচারী আর উৎসুক বহু মানুষ। এত শত মানুষের মধ্যেও আলাদাভাবে চোখে পড়ল এক নারীকে। মুখে মাস্ক, হাতে টর্চ।
শশব্যস্ত হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিলেন তিনি।
উদ্ধারকর্মীদের একজন পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘আমাগো এই বইন এই কয়টা দিন অনেক কষ্ট করছে। অনেকগুলা মানুষের সন্ধান দিছে। ’
তিনি আফরোজা আক্তার। একজন পোশাকশ্রমিক, থাকেন সাভার রেডিও কলোনিতে। সেদিন ভবনধসের খবর পেয়েই ছুটে এসেছিলেন।
শুধু প্রাণের টান থেকেই উদ্ধারকাজে যোগ দিয়েছেন।
প্রচন্ড ব্যস্ততায় কেটেছে আফরোজার কটা দিন। ক্ষনিকের বিশ্রাম পেয়েও আফরোজা যেন সুস্থির হতে পারছিলেন না। দু-দণ্ড কথা বলার ফুরসত নেই। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর অবশেষে আফরোজা কিছুটা সুস্থির হলেন।
‘ওরাও তো আমার মতোই শ্রমিক, আমার ভাই-বইন। আমার বইনের জামাইও রানা প্লাজায় কাজ করত। ’ বলছিলেন আফরোজা। অন্য উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে রাত-দিন কাজ করেছেন তিনি। জীবিত কিংবা মৃত কোনো মানুষের অস্তিত্ব টের পেলে নিজে উদ্ধার করতে না পারলেও দ্রুত অন্যদের খবর দিয়েছেন।
আরও কিছু কথা হয়তো বলা যেত আফরোজার সঙ্গে। কিছু তাঁর একটুখানি সময়ের যে তখন অনেক দাম!
‘শুইলেই মনে হয় লাশ আমার হাত ধইরা রাখছে’
সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন দিদার হোসেন (২৮)। কাজ করছেন আল মুসলিম গার্মেন্টসের অপারেটর হিসেবে। রানা প্লাজার কাছেই, রাজ্জাক প্লাজার ঠিক পেছনে আল মুসলিম গার্মেন্টস। বুধবার সকালে হঠাৎ হইচই শুনে আর সবার মতোই জানালার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন দিদার।
দেখলেন, কিছুক্ষণ আগেও যে রানা প্লাজার নয়তলা ভবনটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে শুধু ধুলা আর ধুলা। সঙ্গে সঙ্গেই ছুটি ঘোষণা হলো। সবাই মিলে রানা প্লাজার দিকে ছুটলেন মুসলিম গার্মেন্টসের কর্মীরা।
‘আমাগো গার্মেন্টসে আমাগো লগেই কাজ করত হেলাল। এই মাসেই (এপ্রিল মাসে) রানা প্লাজার তিনতলায় একটা গার্মেন্টসে কাজ নিছিল।
ওর বউ আমাগো গার্মেন্টসে কাজ করে। প্রথমেই মাথায় আসছিল হেলালের কথা। ’ বলছিলেন দিদার। টানা প্রায় আড়াই দিন উদ্ধারকাজে ছিলেন দিদার। জীবিত-মৃত মিলিয়ে উদ্ধার করেছেন অনেকগুলো মানুষকে।
কিন্তু তাঁদের মধ্যে হেলালের মুখটা চোখে পড়েনি। দিদারের সঙ্গে যখন আমাদের কথা হয়, হেলাল তখনো নিখোঁজ।
দিদার জানালেন, প্রায় ২৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন তিনি। তাঁদের মধ্যে একজন কিশোরী আন্না। ‘১২ বছরের একটা বাচ্চা মাইয়া।
হাতের উপর স্ল্যাব পইড়া আটকায় আছিল। আমি কইলাম, “বইন, তোমার তো হাত কাটা লাগে। ” আন্না কইল, “যেমনেই হোক, আমারে বাইর করেন। ” আমি তো কাটাকাটি পারি না। বাইর হইয়া ডাক্তার সাবরে কইলাম।
ডাক্তার সাব আমারে একটা ছুরি আর একটা ইনজেকশন দিল। ক্যামনে কী করতে হইব, বুঝায় কইল। ইনজেকশন দিয়া, হাতে কাপড় প্যাঁচাইয়া আমি আন্নার হাত কাটছি। আন্নাও কানতাছিল, আমিও কানতাছিলাম। ’ সেই মুহূর্তের কথা বলতে গিয়ে শিউরে উঠলেন দিদার।
তিনি নিজ হাতে এ কাজ করেছেন, যেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। ‘ওর দুই পায়ের সঙ্গে আমার দুই পা বাইন্ধা শুইয়া শুইয়া বাইর হইয়া আসছি। ’
এখন কেমন আছে আন্না? ‘আপনাগো দোয়ায় মোটামুটি ভালো। ’ এনাম মেডিকেলের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন আন্নার বড় ভাই। ‘ এখনো ঘুমাইতে পারি না ভাই।
শুইলেই মনে হয় লাশ আমার হাত ধইরা রাখছে। ’ বলছিলেন দিদার।
‘কোনো দিনও ভাবি নাই, এই কাজ করতে পারব’
‘আমাদের কোনো ট্রেইনিং নাই। তবে ফায়ার ব্রিগেড আর সেনাবাহিনীর কথামতো কাজ করতে করতে ট্রেইনিং হয়া গেছে। ’ বলছিলেন মো. মোবারক খান (২৬)।
মোবারকের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছে, সেনাবাহিনী তখন ভারী যন্ত্রপাতির মাধ্যমে রানা প্লাজায় উদ্ধারকাজে ব্যস্ত। টানা সাত দিন উদ্ধারকাজ করেছেন মোবারক, এখন বাকি কাজ সরকারি উদ্ধারকর্মীদের। অথচ মোবারক খানকে তখনো খুব অস্থির দেখাচ্ছিল। চোখে-মুখে কেমন একটা ঘোর লাগা ভাব। সরকারি উদ্ধারকর্মীদের হাতের ইশারা পেলেই আবার উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।
‘আমরা এই কয় দিন শুধু পানি আর জুস খাইছি। ভিতরে ঢুকছি তো ঢুকছি, বাইরে দিন না রাইত টের পাই নাই। ’ বলছিলেন মোবারক।
‘আমরা এই পর্যন্ত প্রায় ১৫০ জন মানুষকে জীবিত উদ্ধার করছি। ’ এই ‘আমরা’ কারা, জানতে চাই মোবারকের কাছে।
‘আমরা কোনো দলের লোক না। আমাদের কোনো নাম নাই। আমরা এই এলাকার পোলাপান। ’
মোবারক স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। বুধবার সকালে খবর পেয়ে রানা প্লাজার কাছে এসেছিলেন।
এরপর টানা সাত দিন আর ঘরে ফেরা হয়নি। ‘কী কী যে করছি ভাই গত কয়টা দিন, কল্পনার বাইরে। কোনো দিনও ভাবি নাই, এই কাজ করতে পারব। আল্লাহ আমারে দিয়া করায় নিছেন। ’ বলছিলেন তিনি।
‘হাত কাইটা, পা কাইটা মানুষজনরে বাইর করছি। একটা মেয়ে অন্ধকার সহ্য করতে না পাইরা পাগল হয়া গেছে। আমি উদ্ধার করতে যাওয়ার পর আমার হাতে কামড় দিছিল। অনেক কষ্ট কইরা তারে বাইর কইরা আনছি। আরেকটা ছেলেরে উদ্ধার করছিলাম...’ কথোপকথনের এই পর্যায়ে কী যেন একটা কাজে মোবারককে ডাকলেন ফায়ার ব্রিগেডের কর্মী।
কথা শেষ না করেই ছুটলেন তিনি।
‘মাঝে মাঝে মনে হইতেছিল আর পারতাছি না’
—ভাই আপনার নাম কী?
—হাবিব
—বাড়ি কোথায়?
—ঠাকুরগাঁও
মো. মিরাজ হোসেনের (২২) সঙ্গে হাবিবের যখন কথা হচ্ছে, হাবিব তখন প্রায় সংজ্ঞাহীন। কোমরের ওপর ভেঙে পড়েছে কংক্রিটের স্তম্ভ। চোখ প্রায় বুজে আসছে। মিরাজ চেষ্টা করছিলেন কথা বলে বলে হাবিবকে জাগিয়ে রাখতে।
রাত তখন প্রায় তিনটা। সঙ্গে নিয়ে আসা খাবারের কিছু অংশ হাবিবকে খাওয়ালেন মিরাজ। মিরাজের হাত আঁকড়ে ধরে হাবিব দুর্বল গলায় অনুরোধ করলেন, ‘ভাই, আমাকে বাঁচান। ’ মিরাজ ভালোমতো পরখ করলেন। স্তম্ভটা ভেঙে পড়েছে কোমরের ওপর।
হাবিবকে টেনে বের করার কোনো উপায় নেই। বললেন, ‘আপনি একটু ধৈর্য ধরেন। আমি আসতেছি। ’ হাবিব কিছুতেই ছাড়তে চান না, ‘ভাই আপনি থাকেন, যাইয়েন না। ’
অনেক কষ্টে হাবিবকে বোঝালেন মিরাজ।
যন্ত্রপাতি ছাড়া তাঁকে উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। কী ভেবে যেন বেরিয়ে আসার আগে মোবাইলে হাবিবের একটা ছবি তুলে নিলেন। বাইরে গিয়ে যদি স্বজনদের পাওয়া যায়, অন্তত এটুকু বলা যাবে, মানুষটা বেঁচে আছে। রানা প্লাজার ভেঙে পড়া সিঁড়ি কোঠা থেকে বহু কষ্টে বের হয়ে এলেন মিরাজ। যন্ত্রপাতি নিয়ে আবার যখন ফিরে গেলেন, ততক্ষণে হাবিব পাড়ি জমিয়েছেন না-ফেরার দেশে।
কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে আবারও কাজে নামলেন মিরাজ। বাইরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, অথচ ভেঙে পড়া রানা প্লাজার ভেতরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার।
মো. মিরাজ হোসেন সাভারের গেণ্ডা এলাকায় একটি সোয়েটার কারখানায় কাজ করেন। কদিন আগেও তিনি নিজেকে একজন নির্ভেজাল ‘কম সাহসী’ মানুষ হিসেবে চিনতেন। কখনো কল্পনাও করেননি, ধসে যাওয়া এক মৃত্যুপুরী থেকে জীবিত-মৃত মানুষ উদ্ধারে নামবেন তিনি।
‘মাঝে মাঝে মনে হইতেছিল আর পারতাছি না। কয়েক বার বাইর হইয়া আইছি। তারপর আবার গিয়া ঢুকছি। ’ বলছিলেন মিরাজ। মিরাজ সে যাত্রা পারেননি।
কিন্তু এর আগে আর পরে সব মিলিয়ে মিরাজের সহায়তায় নতুন জীবন পেয়েছেন ১৬ জন মানুষ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।