আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আটকে পড়া জীবন।।

ঃহ্যা হ্যা ঠিক আছে। তুমি বুবাইকে দেখে রেখো। এখন রাখছি। নেমে ফোন দেব। ফোনটা রাখতেই হঠাত বাইরের দিকে চোখ আটকে যায় মুহিতের।

বুকের ভিতর কেঁপে উঠলো যেন। এ কাকে দেখল সে? খুব দ্রুত চলে এল জানালায়। পরবর্তী স্টেশনে এসে ট্রেন থেমেছে। হুড়মুড় করে যাত্রী উঠছে নামছে। নাহ এত ভীড়ে কাউকেই দেখতে পেলনা সে।

বার কয়েক ঊঁকি ঝুঁকি মারতেই জানালার পাশের যাত্রী বিরক্ত হল। ভুল দেখলো? না না এত বড় ভুল সে করতেই পারেনা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে সরে এল জানালা থেকে। কেন এমন ভুল দেখল সে? এত বছর পর হঠাত কেন মনে পড়ল সেই মুখখানি। নিজে নিজেই হেসে উঠল।

কত বছর হল? প্রায় বিশ বছরতো হবেই। তবে মুখখানি আজও সেই তেমনি রয়েছে। হয়ত দুরদর্শন বলেই মুখের ভাজগুলি তার চোখে পড়েনি। । বদলি হয়ে সে সদ্যই এদিকটায় এসেছে।

একটু মফস্বল এলাকা হলেও খারাপ লাগছেনা তার। বাস ট্রাক আর মানুষের হুড়োহুড়ি নাই, নাই ট্রাফিক জ্যাম আর কালো ধোঁয়ার ছড়াছড়ি। তার বদলে পেয়েছে গাছগাছালির নির্জন অরণ্য। আসা যাওয়ার এপথের নিত্যকার পরিবর্তন তার মনকে ভরিয়ে দেয় কানায় কানায়। কখনো দিগন্ত জোড়া ধানক্ষেতের সবুজ চাদর।

ফাঁকে ফাঁকে আকাশের প্রতিচ্ছবি গায়ে জড়িয়ে বিস্তৃত জলাশয়। সাদা বকের উড়াউড়ি সব কিছুই তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মত পথের দূরত্বকে ভুলিয়ে দেয়। তবে সবচেয়ে ভালোলাগে ফেরার বেলায় রাতের আলো আঁধারির খেলা দেখতে। কখনো কখনো শুক্লপক্ষের চাঁদ কি দুর্দান্ত ভঙ্গিমায় শাসন করে পুরো এলাকাকে। গাছেরা সব মাথা নীচু করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে বাধ্য ছেলের মত।

সম্পূর্ণ এলাকাটা চাঁদের রূপালি আলোয় ঝলমল করতে থাকে। কিন্তু ঘন বনের ভিতর যেখান অবধি চাঁদ তার আলো ছড়িয়ে দিতে পারেনা সেখানে গাঢ় আঁধারে জোনাকি পোকারা নির্বিঘ্নে খেলা করতে থাকে। আর মুহিত নেশাগ্রস্তের মত চলতে থাকে ট্রেনের জানালা ধরে। কিন্তু সেদিনের পর থেকে তার সব ওলোটপালট লাগছে। দীর্ঘপথের প্রতিটা মুহুর্ত সে খুঁজে ফেরে কেবল সেই চোখ ট্রেনের ভিতর প্রতিটা চোখের ভীড়ে।

তারপর আবারও একদিন হঠাত করেই নিমগ্ন মুহিতকে জাগিয়ে দিল সেই কন্ঠস্বর এই পথের বাঁকেই। ঃ আরে মুহিত ভাই যে, এদিকে কোথায় এসেছিলেন? চমকে ওঠে মুহিত। বুকের ভিতর জমিয়ে রাখা সেই অতি পরিচিত কন্ঠস্বরের ধ্বনি। কত কত দিন পর। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে সিট থেকে।

খুব দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে থাকে নইলে তা যেন যেকোন মুহুর্তে আটকে যেতে পারে। ঃ মুহিতভাই আমাকে চিনতে পারেন নাই? আমি খেয়া। আপনাদের পাশের বাড়িতে থাকতাম। ওহ হো অই যে কল্যাণপুরে থাকতে। আমরা আপনাদের পশ্চিমপাশের বাড়িটায়… খেয়া একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছে।

ওর সেই পুরোনো অভ্যাসটা এখনো যায়নি। কথা শুরু করলে আর থামার লক্ষণ থাকেনা। কিন্তু মুহিত কি বলবে এখন ওকে। শুধু সৌজন্যমূলক কিছু কথা। তার যে কত কথা, কত জমানো স্বপ্ন সব একসাথে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে।

মুখ খুললেই যেন সব এক সাথে বেড়িয়ে যাবে। না না এমন করা যাবেনা। বয়স কি আর থেমে আছে। তখন যা পারেনি এখন কি আর তা সম্ভব। কোন রকমে ঘাড় নেড়ে চিনতে পারার স্বীকারোক্তিমুলক সায় দেয় সে।

বুকের ভিতর জমানো সে স্মৃতিগুলোর বয়স কেন বাড়েনি আজও, একফোটাও। সেই টিনেজ বয়সের মত এখনো তারা কেন ছটফটাচ্ছে হৃদপিণ্ডটার বন্দী দেয়ালে। পাশের সিটের ভদ্রলোক নেমে যেতেই খেয়া বসে পড়ে তাতে। হাত নেড়ে নেড়ে সে গল্প করছে। তার সংসারের গল্প, স্বামী-সন্তানের গল্প, চাকরীর গল্প, তিলে তিলে গড়ে তোলা নানা রঙের স্বপ্নের গল্প।

মুহিতের পরের স্টেশন যেখানে মুহিত তাকে সেদিন প্রথম দেখেছিল সেখানেই নাকি সে চাকরী করে। তাও তো দশ বছর হতে চলল। মুহিত ওর চোখের দিকে তাকায়। এখনো জ্বলজ্বল করছে ওগুলো, ভুরুগুলো কথার তালে তালে নাচছে, লিপ্সটিক মাখানো ঠোট অহর্নিশ ওঠানামা করছে। এতটুকু বদলায়নি সেই অবয়ব।

মুহিতের জমাট বাঁধা কষ্টেরা আবার গলতে শুরু করেছে। খেয়া খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মুহিতের কাছে নানা তথ্য উদ্ধার করে চলছে। দেখতে দেখতে খেয়ার গন্তব্য এসে যায়। নামার আগে বলে যায় মুহিত ভাই এরপর থেকে আপনার টিকিট কাটার সময় আমার জন্যেও একটা টিকিট কাটবেন তো। এখান থেকে টিকিট কাটলে কখনই সিট পাওয়া যায়না।

চমকে ওঠে মুহিত। না না এ সম্ভব না। তার সমস্ত সত্ত্বা জেগে ওঠে না না রবে। দূরে সরে যেতে চায় মুহিত। সকল যাতণারা বিদ্রোহ করে ওঠে ।

নতুন করে কিভাবে সে সইবে এই যন্ত্রণা । তারপরও কেন যেন ঘাড় নেড়ে সায় দেয় মুহিত। তারপর থেকে আবার দায়িত্ব পালন। সেই ওবেলার মতন করে। মুহিত যেন খেয়ার সেই ফিরে পাওয়া ভরসাস্থল যেমন আগেও ছিল।

তখনও ছোটবড় নানা কাজের আশ্রয়স্থল ছিল এই মুহিত। নিশ্চিন্তে নিজেকে আবার সঁপে দেয় সে আপন ভেবে। কলিগদের হাসি ঠাট্টা উপেক্ষা করে প্রতিনিয়ত সেই দায়িত্ব পালন করে যায় মুহিত। সে জানে সে কেবল দায়িত্বই পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও কেন কষ্ট হয় তার? তবে কি জীবনের প্রান্তিক লগ্নে এসেও রয়ে রয়ে গেছে সেই ভালোবাসা? এ কেমন ভালোবাসা? কোন সংজ্ঞার অন্তরালে এ ভালোবাসার রূপ রস বন্দী? জানা নেই মুহিতের।

তবে কি নাম না জানা এ ভালোবাসার আঁকাবাঁকা বন্ধুর পথ তাকে নিয়তই টেনে নিয়ে যাবে কষ্টের নদীতে। জীবনের সংবিধান কি চিরকাল আটকে থাকবে এই বেদনার গিরিখাদে? কি জানি মুহিত নিজেও কি মুক্তি চায় এথেকে? নিজেকে হাজারবার প্রশ্ন করেও খুঁজে পায়নি তার কোন সদুত্তর। যদিও সে জানে দায়িত্ব পালন আর ভালোবাসারা কেবল রেললাইনের দুটি পাতের মত সমান্তরালে বহমান। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।