জবাবদিহিতার উর্ধে কেউ নন । যার জবাবদিহিতা নাই সে হয়ে পড়ে বেপরোয়া , চরম স্বেচ্ছাচারী এবং দুর্নীতিবাজ। এরা স্তাবকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতে ভালবাসে , তাই নিজেদের সঠিক অবস্থান বুঝতে পারে না। এই পরিবেশ যাতে না হয় সেজন্যই বাংলাদেশের সংবিধানে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যদিও এর বাস্তবানুগ কার্যকারিতা নিয়ে অনেক নেতিবাচক মতামত রয়েছে।
সুপ্রীম কোর্টের বিচারকগণ এই জবাবদিহিতার আওতাভুক্ত। রোমান ম্যাক্সিমে বলা হয়েছে ঃ শুধু বিচার করলেই হবে না , সাথে সাথে এটাও দেখাতে হবে যে বিচার সঠিকভাবেই করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রীম কোর্টেও অপরাপর বিচারকগণকে দায়িত্ব গ্রহণের আগে শপথ নিতে হয়। শপথ বাক্য হচ্ছে ঃ আমি আইন-অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সাহিত আমার পদের দায়িত্ব পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব ; আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ , সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব ; এবং ভীতি বা অনুগ্রহ , অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব। কর্মে এই শপথবাক্যের বরখেলাপ অনৈতিক বলে বিবেচিত হয় এবং তা গুরুতর অসদাচারণের শামিল বলে গণ্য হয়।
এর সাথে রয়েছে আচরণ বিধি। বিচারকদের পালনীয় আচরণবিধি নির্ধারণ করা এবং তাদের সামর্থ্য ও আচরন সম্পর্কে তদন্ত করে তার ফল রাষ্ট্রপতিকে জ্ঞাপন করার জন্য রয়েছে ‘সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল’ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকদের মধ্যে পরবর্তী যে দুজন কর্মে প্রবীন তাদের নিয়ে গঠিত হবে ‘সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল’।
সংবিধানের ৯৬(৫) অনুচ্ছেদ অনুসারে ঐরূপ কোন বিষয়ে তদন্তযোগ্য কোন তথ্য পেলে কাউন্সিল তা রাষ্ট্রপতিকে জ্ঞাপন করবেন। এই কাউন্সিল বা অন্যকোন সূত্র থেকে রাষ্ট্রপতির যদি উপলব্ধি করেন যে কোন বিচারক (ক) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থের কারণে তার পদের দায়িত্ব পালনে অযোগ্য হয়ে পড়তে পারেন, অথবা (খ) গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে দোষী হতে পারেন তাহলে তিনি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করে তার ফল জ্ঞাপন করার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। কাউন্সিল যদি উক্তরূপ নির্দেশিত মতে তদন্ত করে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে বলে যে উক্ত বিচারক তার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অযোগ্য হয়ে পড়েছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হয়েছেন তাহলে রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা উক্ত বিচারককে তার পদ থেকে অপসারিত করবেন।
নির্বাচন কমিশনার , মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারী কর্মকমিশনের সভাপতি ও সদস্যদের উল্লিখিত কারণে অপসারণের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য হবে। এখানে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ মতে এই দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি পালন করবেন শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। অর্থাৎ সুপ্রীম কোর্টের বিচারকগণসহ নির্বাচন কমিশনার, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারী কর্মকমিশনের সভাপতি ও সদস্যদের তাদের পদ থেকে উল্লিখিত কারণে অসারণের বিষয় নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের উপর। এভাবেই বিচার বিভাগের উপর শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের সংবিধানমতে রয়েছে।
পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শাসনতন্ত্রের ২০৯ অনুচ্ছেদ মোতাবেক পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি , তার পরবর্তী কর্মে প্রবীন সুপ্রীম কোর্টের দুইজন বিচারক এবং হাইকোর্ট সমূহের মধ্যেকার কর্মে প্রবীনতম দুই জন প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে ‘সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল’ গঠিত হয়েছে।
এই কাউন্সিল সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারকদের আচরণবিধি নির্ধারণ করে দেবেন। সুপ্রীম কোর্ট অথবা হাইকোর্টের কোন বিচারক শারীরিক বা মানসিক দিক থেকে স্বীয় দায়িত্ব পালনে অসমর্থ্য হয়ে পড়েছে মর্মে প্রশ্ন উঠলে অথবা এরূপ কোন বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ(misconduct)এর অভিযোগে উত্থাপিত হলে রাষ্ট্রপতি উক্ত বিষয়ে তদন্ত করার জন্য কাউন্সিলকে নির্দেশ দিতে পারেন। কাউন্সিল যে কোন সূত্র থেকে অনুরূপ তথ্য পেয়ে নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ বিষয়ে তদন্ত করতে পারে। উক্ত বিষয়ে কাউন্সিল তদন্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। রাষ্ট্রপতি এই প্রতিবেদন বিবেচনা করে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ্য অথবা অসদাচরণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত বিচারককে উক্ত দফতর থেকে অপসারণ করতে পারেন।
পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের ৪৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক মন্ত্রীসভা বা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব সমূহ পালন করবেন। তবে এরূপ কোন পরামর্শ পূনর্বিবেচনা করার জন্য পরামর্শ দানকারী মন্ত্রীসভা বা প্রধান মন্ত্রী ( যেভাবে প্রযোজ্য )কে সাধারণভাবে বা অন্যকোনভাবে রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করতে পারেন। তা পূনর্বিবেচনার পর রাষ্ট্রপতির কাছে মন্ত্রীসভা বা প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ পেশ করলে রাষ্ট্রপতি তদনুযায়ী কাজ করবেন। এ ছাড়াও রাষ্ট্রপতি শাসনতন্ত্র মোতাবেক অন্তর্নিহিত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি এই অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগ করেও শাসনতন্ত্র মোতাবেক দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
এইরূপ কোন কর্ম রাষ্ট্রপতি সম্পাদন করলে তার বৈধতা নিয়ে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না।
ভারতের শাসনতন্ত্রের ১২৪(৪) অনুচ্ছেদ মোতাবেক ভারতের সুপ্রীম কোর্টের কোন বিচারক দায়িত্বপালনে অসমর্থ হয়ে পড়েছেন বা তার বিরুদ্ধে অশোভন আচরণ (misbehave) করার অভিযোগ উত্থাপিত হলে আইনসভার উভয় কক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। আইনসভা কর্র্তৃক আইন দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে এ বিষয়ে তদন্ত করা হবে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ পেশ করতে হবে। লোক সভা এবং রাজ্য সভা নিজ নিজ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে উক্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। এটা বিবেচনার সময় অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাবটি গৃহীত হতে হবে।
এভাবে তদন্ত শেষে আইন সভার উভয় কক্ষে উক্তরূপ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গৃহীত হওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে কোন বিচারক দায়িত্ব পালনে অসমর্থ্য হয়ে পড়েছেন বা তার বিরুদ্ধে আনীত অশোভন আচরণ ( misbehave ) করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে মর্মে রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ দায়ের হলে রাষ্ট্রপতি তা বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট বিচারককে অপসারন করতে পারবেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার সহায়তা ও পরামর্শ মোতাবেক রাষ্ট্রীয় কার্যাদি সম্পাদন করবেন। তবে এরূপ কোন পরামর্শ পূনর্বিবেচনা করার জন্য মন্ত্রীসভাকে সাধারণভাবে বা অন্যকোনভাবে রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করতে পারেন। তা পূনর্বিবেচনার পর রাষ্ট্রপতির কাছে মন্ত্রীসভা পরামর্শ পেশ করলে রাষ্ট্রপতি তদনুযায়ী কাজ করবেন।
প্রাগুক্ত আলোচনা মতে তুলনামূলক বিচারে দেখা যায় যে পাকিস্তান ও ভারতের বিচারকদের বিরুদ্ধে যথাক্রমে অসদাচরণ(misconduct) বা অশোভন আচরণ (misbehave) করার অভিযোগ প্রথম ক্ষেত্রে যে কোন নাগরিক এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যগণ উত্থাপন করতে পারেন।
এরূপ অভিযোগ উত্থাপিত হলে তদন্ত অবশ্যই হবে এবং দোষী সাব্যস্ত হলে সংশ্লিষ্ট বিচারক অপসারিত হবেন। আমাদের সাথে উপমহাদেশের অপর দুই দেশের এতদসংক্রান্ত সাংবিধানিক পদ্ধতিতে গুরুত্বপর্ণ পার্থক্য রয়েছে।
লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।