আগের পর্বগুলো - ১ , ২ , ৩ , ৪ , ৫ , ৬ , ৭
(উপরের ছবিটা গুগল থেকে পাওয়া। )
আগ্রা থেকে ভোরবেলা বাসে করে রওনা দিলাম ফতেহপুরের উদ্দেশ্যে। তখনও জানতাম না আমাদের ট্রেন যে বারো ঘন্টা দাঁড়িয়েছিল তার কারণ কী ছিল। পরে শুনলাম ঐ সময় গুজরাটে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল যেখানে দাঙ্গাকারীরা একটা ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়ায় অনেক যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। এদিকে বাসায় এই খবর পেয়ে সবাই খুব টেনশনে পড়ে গেল।
কারণ আমরাও যে ট্রেনে ভ্রমণ করব এটা সবাই জানত। যদিও আমাদের গুজরাটে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা ছিল না, তারপরও দাঙ্গা তো যে কোন সময় যে কোন জায়গাতেই হতে পারে। মেজপার কাছে আমাদের যাত্রা-পরিকল্পনার একটা কপি দিয়ে রেখেছিলাম। সেটা দেখে সে বের করল আমরা কখন কোন হোটেলে থাকব। হোটেল স্যাভয়ের নাম দেখে গুগল করে ঐ হোটেলের ফোন নাম্বার বের করে ফোন দিল।
কিন্তু ততক্ষণে আমরা বের হয়ে গিয়েছি, তবু এটুকু তো জানতে পারল যে আমরা সুস্থ আছি, কোন সমস্যা হয়নি।
যা হোক, আমরা চললাম ফতেহপুর-সিক্রির উদ্দেশ্যে। ফতেহপুর-সিক্রি হল বিশাল এক দুর্গ যার দুটি অংশ। এক অংশে আছে বেশ কয়েকটা প্রাসাদ, হাওয়া মহল, খাস দরবার, আম দরবার, রাজাদের পাশা খেলার স্থান, জলসার স্থান ইত্যাদি। আরেক অংশে মসজিদ, মাজার।
প্রথম অংশে ঢুকবার পর দেখি এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত আর দেখা যায় না। বিলাসিতা যে কতদূর যেতে পারে তা-ই দেখতে থাকলাম একে একে। এখানে ঢুকবার সময় আমরা একজন ভারতীয় গাইড নিলাম। সে একেকটা স্থাপনার কাছে নিয়ে গিয়ে তার ইতিহাসসহ নির্মাণশৈলীরও বর্ণনা দিতে থাকল।
প্রথমবারের মত এলেও জায়গাগুলো আমাদের পরিচিত।
কারণ এখানেই ধারণ করা হয়েছিল শাহরুখ-মহিমার "পরদেশ" সিনেমার শুটিং। জলসার এই স্থানটির কথা হয়তো মনে আছে অনেকেরই। মাঝখানে মঞ্চ, আর চারপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পানি। চারদিক থেকে মঞ্চে আসার জন্য চারটা সেতু আছে। মঞ্চে বসে তোলা এই ছবিতে অবশ্য এত কিছু দেখা যাচ্ছে না।
ছোট বড় অনেকগুলো স্থাপনা ছিল যেগুলোর বর্ণনা এখন মনে পড়ছে না। এরকম একটা একতলা স্থাপনার উপর বসে ছবি তুলেছিলাম। তবে উদ্দেশ্য ছিল পাশের অংশটুকুর ছবি তোলা। পাশের এই অংশটুকু ছিল বাদশাহদের পাশা খেলার জায়গা। একটা টুলের মত বসার জায়গা আছে ওখানে।
ওখানে নাকি বাদশাহ খেলার সময় বসতেন। ঐ টুলের চারপাশে টালিগুলো দিয়ে পাশার ঘর কাটা আছে। বাদশাহর পাশার ঘুঁটি ছিল সুন্দরী মেয়েরা। তিনি বলতেন কোন ঘরে যেতে হবে, সুন্দরীরা নাচতে নাচতে ঐ ঘরের উপর গিয়ে দাঁড়াত। হ্যারি পটারের সেই দাবা খেলার মত বলা যায়।
ছবিতে পাশার ঘরগুলো বোঝা যাচ্ছে না।
একটা মহল আছে যেখানে আছে চারপাশ বারান্দা ঘেরা একটা ছোট উঠান। উঠানের মাঝখানে একটা বেদীর মত আছে, অনেকটা তুলসীর বেদীর মত। এই বারান্দাগুলোর প্রতিটি দেয়ালের কারুকাজও দেখার মত।
একেক মহলের একেক রকম বারান্দা।
কোনটা রেখে কোনটার ছবি তুলব।
এই মহলটা এমন করে বানানো যে, যে কোন প্রান্তে দাঁড়ালে ঠান্ডা বাতাস এসে প্রাণ জুড়িয়ে দিবে।
খাস দরবার এমন করে বানানো যে পুরো দরবারই বসবে উপরতলায়। গোলাকার এই দরবারের মাঝখানে একটা বড় থাম, এর উপর বাদশার বসার জায়গা। এর চার কোণায় রয়েছে চারটি ব্রিজ, যার একেক প্রান্তে বসত চার বিজ্ঞজন যাদের সাথে বাদশা পরামর্শ করতেন এই দরবারে বসে।
পাঁচতলা এই ভবনের নাম হাওয়া মহল। বোঝাই যাচ্ছে নামের কারণ। এর কোন দেয়াল নেই, আছে শুধু থাম। তাই হাওয়া চলাচলের কোন বাঁধা নেই। গ্রীষ্মকালে এই ভবনে বসে রাণীদের সাথে করে বিকালের হাওয়া খেতেন বাদশা।
হাওয়া মহলের দোতলায় আমরা।
এবার চলে আসি দুর্গের অন্য অংশে। এখানে মসজিদ আর মাজারসহ আরও কিছু স্থাপনা আছে।
এই অংশের মূল ফটক হচ্ছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এত উঁচু ফটক যে সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে গেলে মাথা পিঠের সাথে লেগে যায়।
গাইড বলছিল এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ফটক। পুরোটার ছবি একবারে তোলাও মুশকিল। ফটকের একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে এটা তোলা হয়েছিল। ফটকটা সাজানো হয়েছে ঘোড়ার নাল দিয়ে।
এই ফটক দিয়ে বের হয়ে ১০১ টা (গুণিনি অবশ্য) সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে নেমে এলাম ফতেহপুর-সিক্রির বিশাল দুর্গ থেকে।
বের হয়েই ছোটখাট একটা বাজারের মত যেখানে পর্যটকদের জন্য নানান রকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে স্থানীয় বিক্রেতারা। এর মধ্যে বেশির ভাগই মার্বেল পাথরের শোপিস। কেউ কেউ কিনে নিল পছন্দমত শোপিস। আমার কাছে দাম একটু বেশী মনে হল।
যা হোক, ঘুরাঘুরি অনেক হল।
আমরা এবার রওনা দিলাম জয়পুরের উদ্দেশ্যে। বাসে করে যেতে যেতে দেখছিলাম দুই পাশের দৃশ্য। সারি সারি ক্ষেত আর বাড়ি-ঘর, তবে বাংলাদেশের গ্রামের সাথে বেশ পার্থক্য। আমাদের দেশে ক্ষেতে যেখানে গরু-ছাগল চড়ে বেড়ায়, এখানে বেশির ভাগই দেখা যায় মহিষ। মসজিদ একটা কি দুইটা দেখেছি, মন্দির দেখা যায় অনেক।
আরও যেটা লক্ষণীয় পার্থক্য সেটা হল, আমাদের দেশে যেভাবে কাক-মাছরাঙা-ফিঙে দেখা যায়, এখানে দেখা যায় ময়ুর। এখানকার হাটে-মাঠে-ঘাটে দলবেঁধে ময়ুর ঘুরে বেড়ায়। এমনটাই হবার কথা, যে দেশের জাতীয় পাখিই ময়ুর।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আরও একটা ব্যাপার চোখে পড়ল। কিছুক্ষণ পর পরই দেখা যায় রাস্তা দিয়ে ভালুক হেঁটে যাচ্ছে।
না একলা না, গলায় দড়ি বাঁধা, দড়ির অপর প্রান্ত একজন লোকের হাতে। এরা ভালুকের খেলা দেখায়। বেশ কয়েকবার এমন দৃশ্য দেখে আমরা ড্রাইভারকে বললাম যেন এরপর কোন ভালুক দেখলে বাস থামায়। খেলা দেখার সময় নেই, অন্তত ছবি তো তুলতে পারব। ড্রাইভার আমাদের অনুরোধ রাখল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা মিলে গেল মালিকসহ আরেকটা ভালুকের। আমরা নেমে ভালুকের সাথে দলে দলে ভাগ হয়ে ছবি তুলতে থাকলাম। আমি ভেবেছিলাম যে ভালুকের গায়ে হাত দিয়ে ছবি তুলব, কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি ভীষণ নোংরা। হাত দিতে আর ইচ্ছা করল না। আমাদের একজন সখী আবার অতি সাহসী।
সে পা তুলে দিল ভালুকের গায়ে। আমরা মানা করলাম, আরেকজন তো হাত দিয়ে ঠেলে ওর পা সরিয়ে দিচ্ছিল। বলছিল, এই ভালুকের মালিক তো মাইন্ড করবে। ভালুকের মালিক আমাদের ভঙ্গী দেখে আন্দাজ করল আমরা কী বলছি। সে আরও খুশি হয়ে বলল, নেই কোই বাত নেই, ইয়েহি ঠিক হ্যায়, ইয়েহি কারনি চাইয়ে।
আফসোস হচ্ছিল হাতে কেন সময় নেই। থাকলে ভালুকের খেলাও দেখে যেতাম। যা হোক ভালুকের মালিককে কিছু টাকা দিয়ে আমরা উঠে পড়লাম বাসে। দুই দিকের দৃশ্য ধীরে ধীরে বদলাতে থাকল। গ্রামের বাড়িঘর, গাছপালা কমতে থাকল, ক্ষেতও কমে গেল।
এক সময় এসব কিছুই আর থাকল না। রুক্ষ মরুভূমি আর কাঁটাগাছের ঝোপঝাড়ই শুধু রইল। আমরা এগিয়ে চললাম রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরের দিকে।
চলবে................ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।