দ্বিধা-দ্বন্দের সমীকরণ ! দিনাজপুরের জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের ছোট মন্ত্রিসভায় তাঁরা যোগ দেবেন না। চলতি নির্বাচনী রাজনীতিতে যদিও শেষ কথা বলে কিছু নেই, তা-ও তাঁর এ ঘোষণা একটা চরমপত্রের মতো মনে হয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না, আর হতে দেওয়াও হবে না। কিছুদিন আগে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার একটি উদ্যোগের কথা শোনা গিয়েছিল। এখন আর সেটা থাকল না।
খালেদা জিয়া বলেন, ছিয়ানব্বই সালে এ ধরনের অন্তর্বর্তী সরকারের যে প্রস্তাব আওয়ামী লীগ মানেনি, এখন সে ধরনের ব্যবস্থা চলতে পারে না। অর্থাৎ, তুমি তখন যেহেতু মাননি, তা হলে আমি এখন কেন মানব! তুমি যে অস্ত্র দিয়ে সেদিন আমাকে ঘায়েল করেছিলে, আজ তোমাকে কুপোকাত করার জন্য আমি সেই অস্ত্র ছুড়লাম। অস্ত্রটি কী? হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, দেশ অচল, সরকারের পতন—এই সব। খালেদা জিয়া অপূর্ব প্রতিশোধের পথ বেছে নিয়েছেন।
অথচ তিনি ব্যাপারটা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন।
তিনি বলতে পারতেন, ছিয়ানব্বই সালে তিনি জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে ভুল করেছিলেন, আজ আর সেই ভুল করবেন না। তা হলে পরিষ্কার বোঝা যেত যে বিএনপি ভুল পথ থেকে সরে এসে সোজা পথ ধরেছে। তাঁর পরিষ্কার স্বীকার করা উচিত, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেওয়া তাঁর উদ্দেশ্য নয়, তিনি শুধু তাঁর ছিয়ানব্বই সালের ভুল শোধরাতে চান।
খালেদা জিয়ার দাবিটি ঠিক, কিন্তু যুক্তিটি ভুল। তিনি যদি বলেন, সেদিন শেখ হাসিনা করেননি বলে আজ আমি করব না, তা হলে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়।
অথচ তিনি যদি বলেন, জনগণ চায়, তাই আমিও চাই, তা হলে তাঁর অবস্থানটি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়।
সারা দেশের মানুষ ছিয়ানব্বই সালে যেমন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি যৌক্তিক মনে করত, আজও তাই করে। তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সেই প্রবল জনমতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। আর আজ সেই শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে জনমতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এখানে শেখ হাসিনাও ভুল করছেন।
ছিয়ানব্বই সালে তিনি ঠিক পথে ছিলেন, আজ ভুল পথে পা বাড়িয়েছেন।
আজও মানুষ মনে করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকার আছে। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ও সব দলের অংশগ্রহণের জন্য এটা দরকার। এমনকি আদালত যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছেন, সেখানেও বলা হয়েছে, অন্তত আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতে পারে, সংসদ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আদালতের সংক্ষিপ্ত রায়ে এ কথাটি ছিল, এখনো আছে।
রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথাটি উল্লেখ করা ছিল, আর এখন পূর্ণাঙ্গ রায়ে আছে আলাদাভাবে। কিন্তু দুই মেয়াদে নির্বাচনের কথাটি তখনো যেমন ছিল পরামর্শমূলক, পূর্ণাঙ্গ রায়েও তা-ই আছে। এটা বাধ্যতামূলক আগেও ছিল না, এখনো নেই। সুতরাং পূর্ণাঙ্গ রায় আর সংক্ষিপ্ত আদেশের মধ্যে গুণগত কোনো পার্থক্য নেই।
সংক্ষিপ্ত রায়ে দুই মেয়াদে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা হয়েছিল, সেটা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে বর্ণিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়, তবে তাতে বিচার বিভাগকে সম্পৃক্ত না করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এখন অনেকে বলছেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা হয়েছে, নির্দলীয় কি না, তা বলা নেই। এতে কিছু যায়-আসে না। কারণ, সংসদ যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আদালতের পরামর্শে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা আছে, এখন সংসদ বসে অনায়াসে সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে আগামী দুই মেয়াদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের রায়ে কোনো বাধা নেই।
এখানে বলা যেতে পারে যে সংসদ যদি মনে করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, যেটা ত্রয়োদশ সংশোধনীতে ছিল, তাতেও আদালতের রায়ে কোনো বাধা নেই। কারণ, সংসদ কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা আদালত কখনোই বলে দেন না বা বলেন না। আদালত এসব ব্যাপারে শুধু পরামর্শ দেন। কিন্তু সংসদের কোনো আইন যদি সংবিধানের মূল কাঠামোর বিরুদ্ধে যায়, সাংঘর্ষিক হয়, তাহলেই কেবল আদালত তা বাতিল করতে পারেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে অনেকের অনেক আপত্তি ছিল ও আছে।
কিন্তু গত প্রায় দুই দশকে আদালত তা বাতিল করেননি। কারণ, মানুষের একান্ত চাহিদা ও বাস্তবতার বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কোনো আইন সংবিধানের সঙ্গে অসাঞ্জস্যপূর্ণ হলেও বাস্তবতার আলোকে তাকে অনেক সময় স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আবার বাস্তবতার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সেই আইন আদালতে বাতিলও হয়।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারটিও সে রকম।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় এর প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। প্রথমে একটা কথা ছিল যে অন্তত তিন মেয়াদ পর্যন্ত চলুক, তারপর হয়তো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন আর থাকবে না। কিন্তু এখন বলা যায়, সেই দিন এখনো আসেনি। কবে নির্বাচন কমিশন মানুষের আস্থা অর্জন করবে, কবে দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে মানুষের আপত্তি থাকবে না, তা বলা মুশকিল।
আসলে নির্বাচন এমন এক লোভনীয় ব্যাপারে পরিণত হয়েছে যে ক্ষমতাসীনেরা সহজে পরাজিত হতে চায় না।
এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সব দেশেই আছে। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সব দেশেই প্রশ্ন ওঠে। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যতিক্রম নয়। পাকিস্তানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে, ইতালিতে হয়েছে। একদিন হয়তো ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ আরও অনেক দেশে হবে।
কারণ, নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার চেষ্টা কম-বেশি সব দেশেই হয়।
সুতরাং বাংলাদেশের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই আদর্শ বা মডেল হতে পারে। ছিয়ানব্বইতে শেখ হাসিনা এর পক্ষে ছিলেন, বলা যায় তাঁর নেতৃত্বেই এই মডেল ব্যবস্থাটি কায়েমের পথ সুগম হয়। আজ তিনি এটা চান না। আবার ছিয়ানব্বইয়ে খালেদা জিয়া এই মডেলের বিরুদ্ধে ছিলেন, আজ এর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
এই দুই অবস্থান যোগ-বিয়োগ করলে বলা যায় যে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া সমান সমান নম্বরে আছেন। এখন দুই পক্ষ আলোচনায় বসে একটি অভিন্ন সিদ্ধান্তে এলে কারও ভাবমূর্তির ক্ষতি হবে না।
অনেকে বলেন, সভ্য দেশে আবার অনির্বাচিত সরকারের অধীনে কীভাবে নির্বাচন হয়? আসলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ‘অনির্বাচিত’ বলা যায় না। কারণ, এই ব্যবস্থাটি যখন সংসদ অনুমোদন করে, তখন নিশ্চয়ই এটা ‘নির্বাচিত সংসদের নির্বাচিত’, সেই অর্থে এটাও নির্বাচিত বলে ধরে নিতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। যেমন—সংরক্ষিত কোটায় নারী সাংসদেরা কিন্তু বাস্তবে সরাসরি নির্বাচিত বলেই স্বীকৃত এবং তাঁরা সব সাংসদের সমান অধিকার ও মর্যাদা পান।
সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি নির্বাচিত সাংসদ বলে আইনসম্মত ও সংবিধানসম্মত বিবেচিত হতে পারেন, তা হলে সংসদের নির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন অনির্বাচিত হবে?
সুতরাং যদি সংসদ সদস্যরা ভোট দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন, তা হলে দেশের সামনের বিপদ অনেকাংশে কেটে যাবে।
আবার বলা হয়, ‘অনির্বাচিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে নাকি দেশে সংবিধানবহির্ভূতভাবে তৃতীয় কোনো শক্তির আবির্ভাব ঘটে। ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দেশে যতগুলো সামরিক শাসন জারি হয়েছে, তার সবগুলোই কিন্তু হয়েছে নির্বাচিত সরকারগুলোকে বন্দুকের নলের মুখে সরিয়ে। আর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে কিন্তু সরাসরি সামরিক শাসন ছিল না, জরুরি আইন ছিল, এই সরকারের পরিচিতি দাঁড়ায় ‘সেনাসমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই।
যদি সংবিধানবহির্ভূত শক্তির ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করতে হয়, তা হলে সংঘাত ও অনিশ্চয়তার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
কিন্তু বিরোধীদলীয় নেত্রী যে ভাষায় কথা বলছেন, তা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। তিনি দিনাজপুরের জনসভায় ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে যেসব শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেছেন, তা এযাবৎকালে তাঁর মুখে খুব কমই শোনা গেছে। বলা যায়, এবার তিনি অশোভন বাক্য ব্যবহারের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন। আগে বিএনপি অভিযোগ করত যে তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনায় প্রধানমন্ত্রী অশালীন ভাষা ব্যবহার করেন, তাই সংসদে যাওয়া যায় না।
এবার দেখা গেল খালেদা জিয়া নিজেই আওয়ামী লীগের নিন্দিত অস্ত্রটি হাতে তুলে নিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রীকে তিনি অকথ্য ভাষায় বকাবকি করেছেন। ‘নাকে খত দেওয়া’, ‘কান ধরে উঠবস’, ‘মহাচোর’ থেকে শুরু করে ব্যঙ্গবিদ্রূপ—কোনো কিছুই তিনি বাকি রাখেননি। এমনকি তিনি, ‘এই সরকারের লোকদের যেখানেই পাবেন, তাদের কান ধরে উঠবস করাবেন’ বলে জনগণকে উসকে দিয়েছেন (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১২)।
এগুলো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতার ভাষা হতে পারে না।
বিএনপি যদি সত্যিই তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, তা হলে সংসদে যেতে হবে, আলোচনায় বসতে হবে। জনসভায় চরমপত্র দিয়ে সমাধান পাওয়া যাবে না।
তথ্য সুত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।