ইনকার হারিয়ে যাওয়া তিন দেবদূত
রহস্যের এক অদ্ভূত জগতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মিসরীয় সভ্যতার পিরামিড, ইনকা সভ্যতার মাচুপিচু, কুজকোর ইতিহাস। পিরামিড, ইনকাদের স্থপত্য, মমি- প্রতিটি শব্দই আমাদের মনে কী যেন এক রোমাঞ্চের জন্ম দেয়। বিশেষ করে ‘মমি’ শব্দটি শুনলেই অজানা এক রহস্যের জাল মনের মধ্যে বোনা হতে শুরু করে। রহস্যের দুনিয়ার সবার ওপরে রাজা তুতেনখামেনের মমি। ফারাও রাজবংশের তরুণ রাজা ছিলেন তুতেনখামেন।
মাত্র নয় বছর বয়সে রাজা হয়ে রাজা তুত রাজত্ব করেন মাত্র ১০ বছর। মিসরের যত প্রাচীন মমি পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচুর্যময় হলো তুতেনখামেনের মমি।
মমি কি সেটা তো আপনারা জানেন। মিশরীয়রা ধারণা করতো মানুষ মারা যায়না। মৃত্যুর পর আত্মা পুনরায় দেহে ফিরে আসে।
তাই তাদের মৃত্যুর পর মৃতদেহ মমি করে কফিনে রেখে দেওয়া হতো। দেহে যাতে পচন না ধরে সেজন্য অদ্ভূত এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান মিশিয়ে সংরক্ষণ করার পদ্ধতিটার নাম মমি। মমি আজো মানুষের কাছে এক বিস্ময়কর অধ্যায়। মমিকে নিয়ে আজো মানুষের মনে রয়েছে হাজারো জল্পনা-কল্পনা। এ মমিকে নিয়ে বেশ কিছু অবিশ্বাস্য সত্য ঘটনা রয়েছে।
মিশরীয়রা তো সভ্যতার ক্ষেত্রে অনেক উন্নত ছিলো। অন্যদিকে ইনকা সভ্যতা উন্নত হলেও অতোটা উন্নত তখনো হয়নি। তবে তারাও কিন্তু মমি তৈরির পদ্ধতি জানতো। তবে, এটি ছিলো খুবই গোপন একটা বিষয়। এ তথ্য কেবল ইনকা সভ্যতার শীর্ষস্থানীয় কিছু ব্যাক্তিরই জানা ছিলো।
তবে তাদের মমি তৈরির পদ্ধতিটি কিন্তু খুব একটা পছন্দ হওয়ার মতো ছিলো না। কেমন ছিলো তাদের মমি বানাবার পদ্ধতি? বলছি, দাড়ান।
ওরা মমি করতো শিশুদের! আর শিশুদের মমি করতো মানে তো বুঝতেই পারছেন, সেটা কোনো সুখকর ব্যাপার ছিলো না। আপনাদের আজকে এমন তিনটি শিশুর ঘটনাই বলবো।
ঘটনার শুরু ২০০১ সালে।
আর্জেন্টিনার লুলাইমাকো পর্বতের মধ্যে আগ্নেয়গিরির একটি গুহায়। চিলির সীমান্ত থেকে ৩০০ মাইল পূর্বে এ পর্বতটির অবস্থান। লুলাইমাকো পর্বতের ২২ হাজার ফুট মাটির নীচে তিনজন ছেলেমেয়েকে পাওয়া গেলো মানে উদ্ধার করলেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। মমি আকারে পাওয়া এ তিন ছেলেমেয়েকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন তারা। আশ্চর্য হবেন না কেন? তারা দেখলেন মমির সঙ্গে এদের যে কোনো মিলই নেই।
যেন তিনটি শিশু ঘুমিয়ে রয়েছে। তাদের পরণের পোশাক থেকে শুরু করে তাদের মাথার টুপি এবং অন্যান্য অলঙ্কারও সুন্দরভাবে সাজানো রয়েছে। এদের মধ্যে একজনের বয়স ৬ বছর। ও একটা ছোটো মেয়ে। এ মেয়েটিকে দেখেই সবচেয়ে বেশি করে মনে হবে ।
আহা কতো সুন্দর একটা শিশু। আরেকজনের বয়স ৭। ও একটা ছেলে। ওর মাথায় একটা পাগড়ী জাতীয় কিছু একটা রয়েছে। এ পাগড়ীর অর্থ তার সামাজিক মর্যাদা ছিলো অনেক বেশি।
এমনকি সে রাজপরিবারের সন্তানও হতে পারে। দেখে যেন মনে হচ্ছে এদের কেউ চুরি করে এনে এভাবে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। তাদের শরীরের একটা আঁচড়ও নেই। মাটির নীচের হিমশীতল আর শুষ্ক পরিবেশই তাদেরকে ঠিক রেখেছে। কিন্তু এখানে এরা কিভাবে এল? এই চিন্তাটা গবেষকদের পেয়ে বসলো।
তারা গবেষণা শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত তারা বুঝতে পারলেন কি ঘটেছিলো এ তিন হতভাগ্য শিশুর ভাগ্যে।
আপনারা তো ইনকাদের হারিয়ে যাওয়া অনেক ইতিহাসের গল্পই শুনেছেন। কিন্তু ইনকার হারিয়ে যাওয়া শিশুদের কথা কি কখনও শুনেছেন। ইনকাদের সুন্দর কিছু শিশু হারিয়ে যেতো।
হারিয়ে যেতো মানে তাদের হারিয়ে ফেলা হতো। আপনারা তো ছেলেধরাদের নাম শুনেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারটা আসলে ওরকম কিছু নয়। ইনকারা তাদের শিশুদের হারিয়ে যেতে দিতো। ভাবছেন, এটা কি রকম? এ বিষয়টা ইনকাদের পবিত্রতা আর বিশ্বাসের একটা অংশ ছিলো।
কেবল সেই শিশুদেরই হারিয়ে যেতে দেয়া হতো যারা নির্বাচিত হতো। যে শিশুদের হারিয়ে যেতে দেয়া হতো তাদের দেখতে সুন্দর, ভালো স্বাস্থ্য আর যথেষ্ট বুদ্ধিমান হতে হতো।
প্রায় ৫০০ বছর আগের কথাঃ
ওদের একজনের বয়স ১৫, একজনের ৬ আর একজনের ৭। প্রথম দুজন মেয়ে আরেকজন ছেলে। ওদের হারিয়ে যেতে দেয়া হবে।
কিভাবে? ইনকাদের একটি শহর নাম কুজকো। সেখানে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান শুরু হলো। শহরের সবাই হাজির সেখানে। বেছে নেয়া হবে তিনজনকে। কারা হবে সেই তিনজন।
অনেক নাচ-গান আর বুদ্ধির খেলায় জিতে গেলো তিনজন। ওদের নাম কি ছিলো সেটি অবশ্য কোথাও লেখা নেই। এই তিনজনকে সবাই মিলে কুর্নিশ করলো। তারপর শুরু হলো তাদের সম্মান দেখানোর পালা। পুরো একমাস ধরে চললো অনুষ্ঠান।
মেয়ে দুজনকে সাজানো হলো সুন্দর পোশাকে। কি অপূর্ব সে পোশাক। হলুদ আর বাদামী কাপড়। মাথায় অলিভ গাছের পাতার মুকুট। তাদের খেতে দেওয়া হলো সবচেয়ে উৎকৃষ্ট খাবার।
এরপর চললো তাদের উপহার দেবার পালা। যার যা সামর্থ্য তাই নিয়ে তাদের উপহার দিলো। এ দুজন মেয়ের মধ্যে ১৫ বছর বয়সী একজন ছিলো রাজকুমারী। আর ৬ বছরের ছোটো মেয়েটা ছিলো সবচেয়ে বুদ্ধিমান আর সুন্দর। আর ৭ বছরের ছেলেটির মাথায় রাজমুকুট পরানো হলো।
সঙ্গে সুন্দর বাহুবন্ধ বা তরবারী ছিলো।
ইনকাদের এ ধর্মীয় অনুষ্ঠানটার নাম ছিলো ‘কাপাকোচা’। কাপাকোচা অনুষ্ঠানটার শেষ হবার পর সবাই মিলে বিদায় দিলো তিনজনকে। তাদের কোথায় যেন যেতে হবে। এ তিনজনের সঙ্গে যাত্রা শুরু করলো আরো কয়েকজন ইনকা।
তারপর শুরু হলো লুলাইমাকো পর্বতের দিকে যাত্রা। কুজকো থেকে শতশত মাইল পথ হেঁটে তারা লুলিয়াকো পর্বতের কাছে পৌঁছেছিলো। এ পবর্তটার উচ্চারণ ‘উয়ি-ইই-অআয়া-কো’। একদিন তারা পর্বতের ওপরে পৌঁছে গেলো। সেখানে এবার শুরু হলো ধর্মীয় উপাসনা।
এ তিনজনকে ঘিরে শুরু হলো অদ্ভূত এক নাচ। তারপর সূর্যদেবতার উদ্দেশ্যে তারা প্রার্থনা করলো। তোমরা তো জানোই তখন তাদের বিশ্বাস ছিলো সূর্যই দেবতা। নাচ-গান শেষে তিনজনকে খেতে দেওয়া হলো ‘চিচা’। এ চিচা হচ্ছে মধুজাতীয় একধরনের পানীয়।
এ পানীয়টা খেলে প্রথমে ঘুম আসতে শুরু করে তারপর একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় মানুষ। এরপর আর কোনো জ্ঞানই থাকেনা। ওরা তিনজনও ঘুমিয়ে পড়লো। আর ঘুমিয়ে পড়ার পরই তাদের হারিয়ে যেতে দেওয়া হলো। মানে তাদের রেখে আসা হলো লুলাইমাকো পর্বতের গুহায়।
আর সেখানেই তারা ঘুমিয়ে থাকলো। এ ঘুম আর তাদের ভাঙ্গলো না।
এসব শিশু বেছে নেযা হতো যারা দেখতে সুন্দর, স্বাস্থ্য ভালো। আর যাদের পছন্দ করা হতো তারাও প্রচুর সম্মান পেতো। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিলো কোনো ভালো কাজ করতে যাচ্ছে তারা।
এদিকে, ইনকাদের বিশ্বাস ছিলো, পাহাড়ের নীচে তাদের ফেলে দেওয়া হলেও কখনও তারা মারা যাবেনা। বরং তারা চিরদিন বেঁচে থাকবে এবং দেবদূত হয়ে গ্রামের এবং ইনকাদের রক্ষা করবে। তারা তাদের উত্তরসূরীদের সঙ্গে মিলিত হবে এবং শতশত বছর পর তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবে আধুনিক সভ্যতার মানুষ।
এরপর কেটে গেলো ৫০০ বছর। ২০০১ সালে তাদের উদ্ধার করলেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।
কিন্তু এ তথ্যটা পুরোপুরি গোপন রাখলেন তারা। আসলে তারা এটা প্রকাশ করতে সাহস পাননি। কারন এটা সবাই ভালো মনে করতো না। আর তাদের উদ্ধার করার পর সংরক্ষণ কাজে এতোটা সময় পার করলেন গবেষকরা। তাদের উদ্ধার করার পর ৮ বছর পর প্রথমবারের মতো তাদের বিষয়ে প্রথম তথ্য প্রকাশ করা হলো।
বিভিন্ন মিডিয়ায় হৈচৈ পড়ে গেলো। তাদের নাম দেয়া হলো ‘লস নিনোস’ বা ‘দ্য চিলড্রেন’। তাদের এক্সরে ফটোগ্রাফে দেখানো হল তাদের সিটি স্ক্যান বা ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা হলো তাদের পরিধেয় পোশাক থেকে শুরু করে সঙ্গে থাকা প্রতিটি অলঙ্কারও পরীক্ষা করে দেখা হলো।
এরপর ‘মিউজিয়াম হাই আল্টিটিউড আর্কিওলজিতে’ প্রথমবারের মতো তাদের দেখানো হলো। তবে তিনজনকে নয় কেবল ১৫ বছর বয়সী মেয়েটিকে।
এ মেয়েটির নাম দেয়া হলো ‘লা ডনসেলা’।
এখন তাদের সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে একটি বিশেষ পাত্রে। একটি বাক্সের মধ্যে একাধিক কাঁচের পাত্র ব্যবহার করে লা ডনসেলাকে এখন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। যে ঘরটিতে তাকে রাখা হয়েছে সেটি মৃদু আলোকিত। আর কখনও অন্ধকার হয়ে গেলে তার দিকে আলো ফেলে তাকে দেখা যায়।
আর এ আলো আঁধারির বিষয়টাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাদামী পোশাক আর ডোরাকাটা স্যান্ডেল পরে এবং কোকা পাতা তার ঠোঁটে নিয়ে এ মেয়েটি পথ চেয়ে রযেছে। তার লম্বা চুল এবং চুলের বেনী দেখে মনে হবে কেউ যেন দীর্ঘদিন ধরে বসে বসে সেই বেণী বুনেছে। ইনকাদের ছেলেমেয়েরা কেমন ছিলো জানতে চান? ঠিক আছে, আপনারা যদি কখনও আর্জেন্টিনায় মিউজিয়াম দেখতে যান তবে ‘লা ডনসেলা’কে একবার দেখে এসেন তবে নিজেই সব জানতে পারবেন। তবে, আপনি চাইলে ইনকাদের পুরাকীর্তিগুলো আর ওখানে এখন যারা বাস করছে পারলে তাদেরও দেখে এসেন।
সংগৃহীত
প্রাচীন ইনকা সভ্যতা ও মাচু পিচু ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।