আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তবুও তিনি রহিমের মা...

অতি সাধারণ বগুড়া আযিযুল হক কলেজে ইন্টারমেডিয়েট ভর্তি হয়েছি মাত্র। মেসে থাকতে হবে, গ্রামের বাড়ি থেকে কলেজ করা সম্ভব নয়। এক বিকেলে কাঁথা-বালিশ নিয়ে মেসে উঠলাম। এই প্রথম বাহিরে থাকা। রাতের খাবার পাতলা ডাল আর ছোট মাছের চচ্চরি।

মাছ জিনিস টা বরাবরই আমার অপছন্দের তালিকায়, ছোট মাছ হলে তো কথাই নেই একেবারেই অপছন্দ। কী করব উপায় খুজে পাচ্ছিনা, শুধু পাতলা ডাল দিয়ে অল্প ক’টা খেয়ে বাটি রেখে দিলাম। সকালে এক বয়স্ক মহিলা এসে বলল, রাতে খেতে পারোনি বাবা, রান্না ভাল হয়নি বুঝি? -মাথা নেড়ে বলললাম হ্যাঁ ভাল হয়েছে। পেট ভরা ছিল তাই খাইনি। মনে হলো আমার কথা সে মোটেও বিশ্বাস করেনি।

কিছু না বলে রুম থেকে চলে গেল। বুঝলাম, এই মহিলাই আমাদের বেটি। বগুড়ায় মেসের বুয়াদের সবাই বেটি অথবা খালা ডাকতো। আমাদের সময় ঐ মেসে তাকে বেটিই ডাকতাম। প্রথম ক’ দিন কিছুই ডাকতাম না, বেটি বলে ডাকতে অসস্তি লাগত।

এত বয়স্ক মানুষ কে বেটি বলব কেমনে! ক’ দিন পর অবশ্য ঠিক হয়ে গেল। আমিও সবার মতই তাকে বেটি বলে ডাকি। এলাকায় তিনি রহিমের মা বলে সমধিক পরিচিত। কোন মেসে বেটি লাগবে, কোন বেটি চুরি করল, কোন বেটির কি সমস্যা সব তদারকি করতেন এই রহিমের মা। তার এই দেওয়ানি গিরি করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে আমাদের না খেয়ে থাকতে হতো।

একদিন এক কান্ড ঘটলো, দুপুরে কলেজ থেকে ফিরে এসে দেখি ভাত আছে তরকারি নাই। কাচা তরকারি বাটিতে কাঁটা কিন্তু রান্না হয়নি। কী আর করা, দুপুরে খাওয়া বন্ধ। মেস ম্যানেজার ক্ষেপে গিয়ে চেচামেচি শুরু করল, তার মেজাজ এখন ফোরটি নাইন। ঐ মাসে দুদু মামা ম্যানেজার।

দুদুকে সবাই মামা বলে ডাকতাম। মেসে সব সময় ম্যানেজারদের একটা এক্সট্রা পাওয়ার থাকে। এ মাসে দুদু মামার হাতেও অনেক পাওয়ার। সে বেটির চাকুরি মুহুর্তে নট করে দিতে পারে। রাতে একটা মিটিং ডাকা হলো।

সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত আগামি কাল বেটিকে বিদায়। নো এক্সকিউজ । বেটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কাটকাট মারমার। আর যাই হোক এই দেওয়ানি বেটিকে আর রাখা যাবে না। বাধ সাধলেন একজন।

সবার সিনিয়র বকর ভাই। তিনিই এই মেসের ফাউন্ডার। যখন এই বাসা ভাড়া নেয়া হয়, তখন থেকেই রহিমের মা এখানে কাজ করেন। যত বার এই বেটির চাকরি নট হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এই বকর ভায়ের জন্যই পারা যায় না। মিটিং শেষে বকর ভাই বিনয়ের সহিত বললেন, আগামি কাল সকালে বেটি আসলে আগে শুনে নেই যে কি কারনে আজ দুপুরে রান্না হয়নি।

তার পরে ফাইনাল সিদ্ধান্ত। একজন গরিব মানুষ কে এভাবে বিদায় করা মোটেই সমীচিন নয়। সবাই চুপ। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সবাই রাগ। যা হবে আজই হোক।

আগামি কাল ঐ বেটিকে আর দেখতে চাইনা। কিন্তু, হলোনা। রাতটা অপেক্ষা করতেই হলো। একজন তো বলেই বসলেন বকর ভায়ের এখানে কী স্বার্থ। সে সব সময় এই বেটির পক্ষে কথা বলে কেন? পরে অবশ্য বুঝে ছিলাম সেই স্বার্থটা কী।

যথারিতি সকালে বেটি আসলেন। বকর ভাই জিজ্ঞেস করলেন গতকাল সে কোথায় গিয়েছিল? কেন রান্না হয় নি? শুরু হলো বেটির প্যাচাল, জানো বাবা, ঐ যে পাশের মেসে আগে যে বেটি ছিল তার ছেলেটার খুব জ্বর। দু’ মাস যাবত কাজ নাই। টেকা-পয়সা হাতে নাই তার মধ্যে ছেলেটার আবার জ্বর। তাকে নিয়ে হাসপাতাল গেছিলাম।

কী করব বাবা, ওরা গরীব মানুষ, না করতে পারিনি... ব্যাস, এ যাত্রায় চাকরি আর গেলো না। আমরাও কিছু না বলে যে যার রুমে গেলাম। এক সন্ধ্যায় দেখি বেটি খাবার তৈরী করছে আর চোখ মুছছে। বললাম বেটি কাঁদো কেন? -না বাবা কাঁদি না। -তাহলে চোখ মুছো কেন? বলতেই কথা আরো গাঢ় হয়ে গেল।

কী হয়েছে বলো? কেউ কিছু বলেছে তোমাকে? - না বাবা কেউ কিছু বলেনি। -তাহলে কাঁদো কেন? - না বাবা খুশিতে কাঁদি। আল্লাহ আমার রহিম রে ফিরায়া আনছে। -কেন, রহিম কৈ গিয়েছিল? - শুরু হলো রহিমের গল্প। গত দু’সপ্তাহ যাবত রহিম বাড়ী ফিরেনা।

সে ট্রাক ড্রাইভার। কোথায় গেছে জানেনা। রহিম কোন দিনও মাকে বলে যায় না। কিন্তু প্রতি রাতে মা রাত জেগে দরজায় বসে থাকে। রহিম যখন বাড়ী ফিরে, মা তখন ঘুমাতে যায়।

রহিমের মা কার কাছে যেন শুনেছে যে চিটাগাং এ একটা ট্রাক এক্সিডেন্ট হয়েছে। পেপারে নাকি তার ছবিও দিয়েছে। রহিমের মায়ের ধারনা ঐ ট্রাক-ই রহিমের, তাছাড়া সে বাড়ী ফিরবেনা কেন? সেই যে খবর শোনার পর থেকে রহিমের মা রাতে আর ঘুমোয় না। রাত জেগে জেগে কাঁদে। জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে মিনতি করে।

আল্লাহ আমার সোনারে ফিরাইয়া দাও। আমার কলিজাটারে বাচায়ে রাখো মাবুদ...। গভীর রাত শুনশান নিরবতা, কার যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। কলিজা ধক করে উঠে মায়ের। এই বুঝি রহিম আসলো।

হ্যাঁ সত্যিই রহিম এসেছে। রহিমের পায়ের আওয়াজ তার মা দূরে থেকেই বুঝতে পারে। দরজার ফাক দিয়ে তাকিয়ে থাকে মা। কখন তার ছেলেটা বারান্দায় বের হবে। এক নজর সন্তান কে দেখবে তাই... এই বাড়ির জমি রহিমের মায়ের নামে কেনা।

তার বাবা সখ করে এই জমি কিনে ভালোবাসার মানুষের নামে দলিল করে দেয়। বর্তমান বাজারে এই জমির দাম কুড়ি লাখের বেশি হবে। মুক্তিযুদ্ধের পর রহিমের বাবা সেই যে বাড়ি থেকে ব্যাবসার কাজে বাহিরে গেলেন আর ফিরলেন না। সেই বাড়িতেই রহিম থাকে পাকা ঘরে। মা এবং তালাক প্রাপ্ত বোন থাকে পাশের একটা ঝুপড়ি ঘরে।

এই বোনটাকে নিয়েই মায়ের সাথে ছেলে এবং ছেলের বউয়ের বিবাদ। তারা কথা বলেনা। এমন কি জিজ্ঞেস করলেও না। কিন্তু, সে তো মা। মা হয়ে মেয়েকে ফেলে দিতে পারেনা।

তাই এই বয়সেও মেসে মেসে কাজ করে। সারা দিন কাজ করে যে খাবার পায় তাই মা-মেয়ে খায়। ছেলে কোন দিন মা-বোনের খোজ করেনা। তাতেও মায়ের কোন আক্ষেপ নাই। গল্প শুনে আমার চখেও ছলছল।

কথা আটকে আটকে যাচ্ছে। তবুও বললাম জমিটা বিক্রি করে দাও। ছেলে-বউ যেখানে পারে সেখানে যাক। তোমার এত কী? যে ছেলে তোমাকে একমুঠো খেতে দিতে পারেনা তার জন্য এত মায়া কেন? রহিমের মা বললেন ‘না বাবা ছেলেটারে কই ভাসায়ে দিমু। রাস্তা দিয়ে যখন হাটি তখন সবাই তো আমারে রহিমের মা বলেই ডাকে।

তাতেই আমার মন ভরে যায়’। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।