আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তবুও ঈদ.............



২০ বছরের পুরানো রুটিনটা ফসকে যাবার ভয়ে একেকবারে ২-৩টা সিঁড়ি টপকে নামছি। সিঁড়িতে রেলিং নেই, পড়ে গেলে ঘাড় না হোক ঠ্যাং ভাঙবেই, কিন্তু আপাতত সেটা ভাবার সময় নেই, ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। আম্মার প্রথম কয়েকটা ডাকে উঠিনি, শেষমেশ ঝাঁটাপেটা করার হুমকি শুনে লাফিয়ে উঠে কোনরকমে ঝপাঝপ গায়ে পানি দিয়ে সেমাই মুখে দিয়েই জায়নামায বগলদাবা করে একলাফে দরজার বাইরে, আজকে নামাযটা ধরতে পারলে হয়। এই দৌড়াদৌড়ি নতুন কিছু না, নিত্যকার চিত্র, বাসার লোকজন অভ্যস্ত। আব্বা আগেই চলে গেছেন নামায ধরতে, এমনিতে তিনিও এই দৌড়ের সঙ্গী থাকেন, এবার কিভাবে কিভাবে যেন পার হয়ে গেছেন।

বাসায় লোকজন বলতে অবশ্য আমরা ৩ জনই, তবে রুটিনের কথা বলতে গেলে আরো অনেকের কথা চলে আসে। এই যেমন দৌড়াতে দৌড়াতেই টের পাচ্ছি, মানুষের শেকড় আসলে অনেক জায়গাতে ছড়িয়ে যায়, যত সময় যায় ততই গভীরে চলে যায়, টেনে তুলতে গেলে মনে হয় আত্মা ছিঁড়ে বের করা হচ্ছে। নিজের মানুষ, ঘরের মানুষ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, দিন দিন শেকড় শুধু ছড়াতেই থাকে। সেই একদম ৬ বছর বয়স থেকে, ঢাকাতে ঈদ করলেই, ঈদের সকালে বড় রাস্তায় নামায পড়ে প্রথম নাস্তা করা হয় পাড়াতো বন্ধু কাদিরের বাসায়, নিজের বাসারও আগে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম কখনোই হয়নি, এবারো সেটা রক্ষার জন্যই এই ছোটাছুটি।

সেই ৫ বছর বয়সে, পাশের বাসার দেয়ালের উপর বসা যে ছেলেটা প্রথম জিজ্ঞেস করেছিল--তোমার নাম কি, সেখান থেকেই প্রথম বন্ধুত্বের সংজ্ঞা শেখা শুরু। ২১ বছর পার হয়ে গেছে, আমরা এখন যার যার পেশা আর পরিবার নিয়ে ব্যস্ত মানুষ, দু'জনেই বদলে গেছি অনেক, বদলে গেছে আমাদের চারপাশের মানুষগুলো, হারিয়েও গেছে অনেকে, বলয় থেকে, পৃথিবী থেকেও, কিন্তু বদলায়নি আমাদের ঈদের সকাল, সম্ভবত বন্ধুত্বের চেহারাও একই আছে। কবি সুকান্ত বেঁচেছিলেন ২১ বছর, বন্ধুত্বের আর ঈদের সকালে সেই একই বাড়িতে প্রথম সেমাই খাবার ২১ বছর পার হয়ে গেল, জীবনের অর্জনের খাতায় মনে হয় বড় করে এটা লেখাই যায়। এবারের ঈদে অবশ্য তেমন কিছু করার নেই, বন্ধুবান্ধবরা তেমন কেউ নেই। ২ বছর আগেও ঈদের আগের রাত থেকে ঈদের পরের রাত পর্যম্ত মোটামুটি ১০ জনের একটা দল বের হয়ে যেতাম ঢাকা চক্কর দিতে, হিসেব করে দেখলাম এবার আছি মাত্র ৩ জন, বাকি সবাই পেশাগত কাজে হয় ঢাকার বাইরে নয়তো দেশেরই বাইরে, আগামী বছর সম্ভবত কেউই আর ঢাকাতে থাকবে না।

দেশের বাড়িতে গেলেও ম্যালা লোকজন, কিন্তু আস্তে আস্তে সেখানেও কমে আসছে, বয়স্করা অনেকেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন যারা পুরো পরিবারকে বেঁধে রাখতেন এক সুতোয়, ভাই-বোনরা একেকজন একেক দেশে একেক শহরে। মানুষ না থাকলে আর শেকড় কোথায়, সেজন্যই আর এই বাস-ট্রেনের হুজ্জোত পার হয়ে যাবার উৎসাহ পেলাম না, এভাবেই বোধহয় ধীরে ধীরে শেকড় উপড়ে আসে। তো এই ভাসমান শহরে ভাসমান আমার ধান্দা ছিল বাসায় এসে একটা ঘুম দেয়ার, কোরবানির কাজে আমাকে পাওয়া যাবেনা এটা বাবা ধরেই নিয়েছেন। একবার বলেছিলেন বটে গরুটা দেখতে যাবো কিনা, জবাব দিলাম, দুনিয়া সব গরুই হাম্বা হাম্বা করে ডাকে, দেখার কি আছে? তোরে দিয়া কিছু হবে না, এই ধরণের কিছু একটা বলে এরপর আর এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। মানসিক বার্ধক্য মনে হয় ধরেই ফেলেছে, নয়তো একপাল লোকজনের সামনে দাঁত কেলিয়ে সামাজিকতা করতে হবেনা এই সম্ভাবনায় মনে মনে খুশি হয়ে যাবো কেন? তারপরেও ঈদ উপলক্ষে কিছু একটা করা দরকার, কি করা যায় ভাবতে গিয়ে দেখলাম ঈদ এলে একটু বিপদেই পড়ে যাই এই করা বা না করা নিয়ে।

টিভি দেখা বাদ দিয়েছি ম্যালাদিন, ঈদের অনুষ্ঠান দেখার তো প্রশ্নই আসেনা, যতবার টিভি ছাড়ি বস্তাপচা বিজ্ঞাপন ছাড়া কিছুই পাই না, আর কপালজোরে মাঝে মাঝে পাই তারচেয়েও বস্তাপচা নিম্নরুচির হাসির নাটকের নামে কিছু ভাঁড়ামি। আজকাল সাথে যোগ হয়েছে কিছু গানের অনুষ্ঠান যেখানে মিলা টাইপের কয়েকটা সং এসে হুল্লোড় করে আর তারকাকথন জাতীয় কিছু একটা যেগুলোতে সেজেগুজে এসে নেকু নেকু গলায় তারকারা তাদের ঈদ কিভাবে কাটলো সেটার মুখস্ত বর্ণনা দেন, সাথে বয়ান করেন এবারের ঈদে তারা অস্কার পাবার মত কত দুর্ধর্ষ একেকটা কাজ কত কষ্ট করে করলেন। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সেই দুর্ধর্ষ কাজ দেখলে দুর্ধর্ষতম দস্যু মোহনেরও পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। রাস্তাঘাটে বের হওয়াও আজকে মুশকিল, গরুর গন্ধে ক'দিন ধরেই নাক জ্বলে যাচ্ছে, কেন যেন এটায় কখনোই অভ্যস্ত হতে পারিনি, কোরবানির পরে নাড়িভুড়ি আর গোবরের সুবাস বাড়তি পাওনা। লোকজনের ফূর্তির অভাব নেই, গতবার ঢাকাতে ঈদের দিনেও ট্রাফিক জ্যাম দেখে বুঝেছি দিনকাল আসলেই বদলে গেছে।

ঢাকার নারীকূল সম্ভবত আজকাল ঈদের ৩ দিন আগে থেকেই পার্লারে গমন শুরু করে, অন্তত তাদের প্লাস্টার করা মুখমন্ডল আর ইস্ত্রি করা কেশরাজি দেখে সেটাই মনে হয়, আর চাক্ষুষ প্রমাণ দেখলাম গত পরশু। অফিসের পাশেই একটা বিউটি পার্লার আছে, অফিসের পর এক বন্ধুকে আসতে বলে দাঁড়িয়ে ছিলাম ৩০ মিনিট প্রায়, এর মাঝে সেখানে যারা ঢুকেছেন তাদের মাঝে সবচেয়ে কমবয়সীজন হবেন ১৩-১৪ বছরের, সবচেয়ে বয়স্কজন নির্ঘাত ৫০। গাড়ি থেকে নেমে যেমন কেউ কেউ এসেছেন, তেমনি কাউকে কাউকে দেখে বুঝতে বাধ্য যে কোন পোশাকবালিকাও এই উপলক্ষে একটু সেজে নিতে চায়। চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন আর ডিজুসের যুগ এমনই জিনিস, একবার হুজুগটা শুধু ধরিয়ে দিতে হয়, হুজুগে মানুষ এরপর নিজেকে বিক্রি করে হলেও পণ্য আর সেবা কিনবেই কিনবে। তাই বলে ভাবার কারণ নেই ঈদের এই দিনেও নিরানন্দের কথা বলে সবার আনন্দ মাটি করতে হাজির হয়েছি, বলা যায় খাঁটি খানিকটা আনন্দের খোঁজেই বান্দার আগমন, যেমনটা পাই সকালের ঐ প্রথম সেমাই খেয়ে অথবা বছরে ঐ ২টা দিনই মা-বাবাকে সালাম করে।

বন্ধুবান্ধব বিশেষ এখন না থাকলেও যে ৩-৪ জন আছে তাদের নিয়েই শহরের অলিগলিতে ঢুঁ মারবো আজ না হলেও কাল-পরশু, হানা দেব এর-ওর বাড়িতে কিছু খানাখাদ্যের লোভেও। অমুকের বাড়ির সেমাইটা খাঁটি দুধের, তমুকের মা চটপটিটা ভাল রাঁধেন, এর বাড়ির পায়েসটা বেশ, ওর বাড়িতে গেলে গরুর ভুনা বরাদ্দ, মাথায় থাকেই এগুলো। পুরানো মুখগুলোর সাথে দেখা হবে এ সুযোগে, যারা আমাদের হাঁটি হাঁটি পা পা থেকে বড় হয়ে উঠতে দেখেছেন। আনন্দ আর আশীর্বাদে এই একটা দিন হবে আমাদের জন্য মঙ্গলময়, পাওয়ার খাতায় কম বলে ধরি না সেটাকেও। ঈদের নামাযে আর রাস্তায় ঝিকমিকে পোশাকের ফুটফুটে শিশুগুলোকে দেখে স্বর্গের আনন্দের রূপটা পৃথিবীতেই দেখি, এ-ও বা কম কি? এত আনন্দের মাঝেও তবুও অস্বস্তির কাঁটা কোথায় খচখচ করে, এড়িয়ে যেতে চাই।

দেখতে চাই না ধবধবে সাদা নয়তো সূচারু নকশী পান্ঞ্জাবীর পাশে ছেঁড়া ফতুয়ার মলিন চাউনি, অথবা টুকটুকে শিশুর পাশে অবাক চোখে তাকানো ধুলিমাখা দেবদূত। আমাদের আনন্দ যেন ঠিক ওদের জন্য না, আমাদের জগতে ওদের প্রবেশাধিকার নেই। এটাই দুনিয়ার নিয়ম, আমরাও তো কত জায়গায় পা দিতে পারি না, এমন হাতেম তাই হলে চলে নাকি, ভেবেও ঠিক এড়ানো যায় না। ওদের জন্য আজকে শুধুই ২ টুকরো মাংস খাবার দিন। যেখানে দিনরাত গর্জন করে পাজেরো আর বিএমডব্লু, সেই তিলোত্তমা নগরেও বেশিরভাগ লোকে বছরে এক দিন মাংস খায়, হঠাৎ ভাবলে মনে হয় কোন এক দূর নরকের গল্প পড়ছি।

সমস্যা হলো, নরকটা আমাদের হাতের নাগালে, অথবা আমরাই নিজের হাতে এই নরক গড়ে তুলেছি অনেক যত্নে। এই নরক থেকেই প্রতি ঈদে উত্তাল নদী পার হতে গিয়ে অতল জলের নীচে চলে যায় অনেক জীবন, কয়েকটা ছাগল আর টিভি চ্যানেলের নাকিকান্না আর ডিপফ্রিজে ঢুকে যাওয়া একটা তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে যেসব জীবনের দাম নির্ধারণ করি আমরা। এসব জীবনের দামে ঈদ করেন আমাদের বড়বাবুরা, তাদের সিঙ্গাপুরের ঈদ শপিংয়ের দাম দিতে গিয়ে মেঘনার অতলে লক্ষ মানুষের কবর হলেই কার কি? এই গল্প লেখা হয় প্রতিদিন প্রতিবেলা, এই গল্প পড়ে আমরা একটু আনমনা হই, এই গল্প পড়ে আমরা ছোট একটা শ্বাস ফেলি, এরপরে গল্পটা ডাস্টবিনে ফেলে আমরা কাঁধটা ঝেড়ে সামনে পা বাড়াই। এভাবে পেছনে তাকালে চলে না, এভাবে পেছনে তাকানো যায় না, এভাবে তাকালে আনন্দ করা যায় না। আমাদের এই আনন্দনগরের বাসিন্দাদের কাছে এসব দুঃখী গল্পের কাগজে কিংবা আন্তর্জালে খানিক বাহবা কুড়ানো ছাড়া আর কোন মূল্য নেই, এ শহরের বাসিন্দারা নিরন্তর উড়ছে অলৌকিক এক সুখের ফানুসের পেছনে।

আসুন, আমরা আজ আনন্দ করি, আজ আমাদের ঈদের দিন, আসুন, আজ আমরা সব কিছু ভুলে অতিপ্রাকৃত সেই ফানুস জ্বালাই। যত যাই হোক, আজ তো ঈদের দিন, নষ্ট মানুষের পাপে পিষ্ট এই নষ্ট শহরের খুশির দিন। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।