আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"অদৃষ্ট'

আমি শুধুই আমি...অন্য কেউ নয় ১ খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও মাঝে মাঝে কবিরের ইচ্ছে করে মরে যেতে। ইচ্ছে করে নিজের সব চাওয়া পাওয়ার সাথে অমীমাংসিত যুদ্ধের অবসান ঘটাতে। কিন্তু মৃত্যু ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আধভৌতিক লাগে ওর কাছে। না হয় মরে গেল সে, ওপারে ঠিকঠাক শুয়ে থাকতে পারলে তো আর চিন্তা থাক্‌তনা, আরামের সিয়াস্তা হত। কিন্তু ওপারে তো মুখোমুখি হতে হবে ঈশ্বরের ,তার সাথে আবার ও তর্কাতর্কি করতে হবে ইহলোকের চাওয়া পাওয়া নিয়ে।

এটা কেন করেছে, সেটা কেন করেছে। শেষ্‌মেশ শাস্তি তো অবধারিত, হয়তো কোটি ডিগ্রী সেলসিয়াসের ভেতর ফেলে দেয়া হবে তাকে, না হয় চাকু দিয়ে কেটে ফালা ফালা করা হবে, সে তো এমন বিশেষ কেউ নয় যে তার ছোট খাট মর্জি আবদার মেটানো হয়নি বলে ঈশ্বর জবাব্‌দিহি করবেন। আচ্ছা সে কি সেদিন ঈশ্বরকে দেখতে পাবে? অনেক দিন সে কিছু দেখেনি। ওর খুব ইচ্ছে ছিল শেষবার ফৌজিয়াকে এক নজরে দেখে, কিন্তু না—সে পালিয়েছে রাতের অন্ধকারে, পাড়ার মুদে দোকানী ইস্‌মাইলের হাত ধরে, লোকে অন্তত তাই বলে। কবির প্রথম প্রথম অন্তত বিশ্বাস করে নি—যেদিন কারখানাতে গ্যাস পাইপ বিস্ফোরণ হল সেদিনের আগের রাতে ও ফৌজিয়াকে নিজ আলিঙ্গনে এনে সে আদর সোহাগ করেছে, সে কোন বাধ সাধে নি—অথচ আজ সে চোখে দেখতে পায় না বলে সে সমস্ত স্বীয় অধিকার ত্যাগ করে চলে গেছে-কোথায় আজ সে?অন্তত তাকে এক নজর দেখার জন্যে হলেও কবিরের মাঝে মাঝে মনে হয় মরে যাওয়া উচিত।

মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তে দুনিয়ার সকল অন্ধ রা নাকি এক পলক দেখতে পায় এই কুৎসিত পৃথিবীটাকে... বধির রাও নাকি একবার শুনতে পায় শিয়াল কুকুরের আর্তনাদের আওয়াজ। কবির ও দেখতে চায়। ফৌজিয়াকে-- একটিবার, কেমন আছে সে? কি এমন শকুন চক্ষুর সন্ধান পেয়েছে সে? যা তাকে আড়াল হতে দেয়না কখনো ! “কবির বাই—ও কবির বাই ! কেডা কথা কয়—ভিতরে আহো, বাইর হইতাম না। আমি জয়নাল, শরীরটা ভালা নি? না ভালা না—মইরা যামু শিগ্‌গির। দেনা- পাওনা থাকলে ভুইলা যাও মিয়া, শোধ দিবার পারুম না।

কবির বিরস মুখে বল্‌ল। আরে কও কি ! মরবা কিল্লাগি? আমরা আছি তো—না খাইয়া থাকোন তো লাগে না তোমার ! কারখানার কি খবর? আর কাম অয় না? কবির বলতে বলতে চোখ থেকে কালো চশ্‌মাটা আলাদা করে ফেল্‌লো। কি বিদঘুটে লাগছে তাকে। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যদি কোন অঙ্গ দিয়ে থাকেন সেটা হচ্ছে চোখ। সেটি না থাকলে মানুষ আর পশুর চেহারার প্রভেদ অনেক্‌খানি কমে আসে।

কারখানা আর খুল্‌বোনা ভাই, তোমার মিয়া কপালটা বালা,হুদা চোখের উপর দিয়া গেসে, সামনের বস্তির শমসের এর হাত পাও সব পুইড়া গেছে। আর জানোই তো মানুশ মরছে চল্লিশ এর উপ্‌রে ! হ ! এডি আর কইস না—ভাবতে অহনো ডর লাগে ! শমসের এর বউও কি ওরে রাইখা গেছে গা? কবির হতাশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল। নাহ, হের বেডি টা ভালা আসে---ও আচ্ছা তুমারে তো একটা খবর দেওয়া হয়নাই। কি ? না ---মানে তোমার বউ এ মনে হয় অজায়গা-কু জায়গায় গিয়া পড়ছে— কি কইতে চাস? মানে এলাকার অনেকেই দেখছে হেরে উত্তর পাড়ার বেশ্যাপল্লীতে, কে জানে সত্যি নাকি! এডি কস কি তুই ! কবিরের মাথায় রক্ত উঠে গেল ! আমার উপর খেইপা লাব কি বাই? তোমার তো চোখ নাই তাই দেহ না, যাগো চোখ আছে হেরা ঠিক ই দেহে... কবির চশ্‌মাতা চোখে দিল। এই সুখের জন্যে কি ফৌজিয়া তাকে ছেড়ে চলে গেল?কত টাকা পায় সে ভাড়া খেটে? কবিরের এখন কোন টাকা পয়সা নেই সত্যি, কিন্তু কিছু দিন অন্ধত্বের সাথে মানিয়ে নিলে সেও কি কিছু করতে পারত না? কত অন্ধ- প্রতিবন্ধী কত কি করে বেড়াচ্ছে এ যুগে।

বাই—আমি যাই, তোমারে খবরটা জানান দরকার ছিল জানাইলাম। কবির কিছু বল্‌ল না। পিচ করে একদলা থুথু ফেল্‌ল—যা গিয়ে পড়ল জয়নালের পায়ের কাছাকাছি---সে জানতে পারল না, তার নিশান আসলেই ঠিক আছে। । ২ আজ সে সেজেছে অন্যভাবে।

পাতলা হলুদ রঙের একটা শাড়ি লাল ব্লাউজের পাশাপাশি গলায় একটা নকল মালাও পড়েছে সে। ঠোঁটে লিপস্টিক মাখেনি,মাথার চুল গুলো বাঁধবে কিনা এ নিয়ে সংশয়ে আছে- যদি ও কেউ তাকে বলে দেয় নি আদৌ কেউ আসবে কি না তার কাছে---তারপর ও তার মনে হচ্ছে কেউ একজন আসবে। অনেক দিন কেউ আসে না। জায়গাটা সচরাচর খুব নীরব থাকে না, সবসময় হই হট্টগোল লেগেই থাকে। পেশাটা আজকাল আর কেউ অত লুকিয়ে ও রাখতে চায় না—ধীরে ধীরে বোধ হয় সামাজিক বৈধতার দিকেই এগুচ্ছে ব্যাপারটা।

আজ কেন জানি খুব নীরব চারদিক। কোন কাজ নেই এখন। তার ভাবনা গুলোকে এখন আর সে গুছাতে পারে না। মাঝে মাঝে মনে হয় সব ঠিক ই আছে আবার মাঝে মাঝে মনে হয়---না বিরাট ভুল করেছে সে। হ্যা,ভুল একটা করেছে সে, স্বামীর সংসার ফেলে অন্য লোকের আশ্বাসে ঘর পালিয়েছে...তবে ভুল সেটুকুই।

তা শুধ্‌রানোর কোন উপায় তার জানা নেই। এখানে সে বেশ সুখেই আছে তার মনে হয়—এখন পর্যন্ত ২৭০০ টাকার মত জমেছে তার। অনেক টাকা...কিভাবে খরচ করবে তাই বুঝতে পারছে না। এখান্‌কার কোন ঘরভাড়া নেই- খাবারের টাকা কেটে রাখলে যে খুব খারাপ টাকা হাতে থাকে ---তা না। আবার আজকাল দিনে দুপুরে ছোট ব্যাবসা ও শুরু করেছে সে, তার সাথে অবশ্য আরো মেয়েরা আছে, কাপড় সেলাই এর ব্যবসা, জামা বানানোর কাজ।

যদি ও খুব বেশি কেউ আসেনা এজন্য তাদের কাছে তবু বেশ ভালোই আছে সে । এখন পর্যন্ত একবার তার ক্লিনিকে যেতে হয়েছে, ডাক্তার সব শুনে বিরক্ত হয়ে তার জরায়ু ফেলে দিয়েছেন। এখন আর তার ক্লিনিকে যেতে হয় না...বেশ সুখেই আছে সে। খুব বেশি মানুষ এখনো তার শরীরে হাত দেয়নি, তবে যেই দিয়েছে, বলেছে সে অনেক সুন্দর। এরকম সুন্দর মেয়ে এ জায়গায় নাকি পাওয়া যায় না।

সবচেয়ে যেটা খারাপ লাগে সেটা হচ্ছে এদের অনেকেই তার চেনা। এলাকার খারাপ লোকজন। বড়লোকের আমদানি নেই এখানে, তারা গুলশান- বনানীর দামী হোটেল গুলোতে যায়। এ জায়গা তার মত ফকিরনীদের জন্য। তার খুব ইচ্ছে করে যারা আসে তাদের বউদের বলে দিতে ব্যাপারটা ...কিন্তু সে বলে না---কোন মুখে বলবে সে? সে নিজেও তো একজন প্রতারক,অন্যরা প্রতারণা করলে দোষটা কোথায়? কবির খুব কষ্টে তিনশ টাকা যোগাড় করেছে।

একজনের কাছে অবশ্য সে দেড়শ টাকা পেত,ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে গেছে এতে, আর একটা শখের ঘড়ি বিক্রী করে দিয়েছে সে। কবির অবশ্য আরেকটা জিনিস যোগাড় করেছে, সেটা আগে থেকেই ছিল তার কাছে। জিনিসটা সাথে নেবে নাকি নেবেনা অনেক ভাবল সে, অবশেষে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল-না লাগলে পড়ে দেখা যাবে। তার সাহসের কথা চিন্তা করে নিজেকেই বাহবা দিল সে। নষ্ট পৃথিবীর সব মানুষদের ই নষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত---কয়েকজন নষ্ট হবে আর বাকিরা সাধু-সন্নাসীর মুখোশ পড়ে ঘুরবে-এটা কেমন কথা? ৩ সে স্তম্ভিত হয়ে গেল,মানুষটা সত্যিই এসেছে, সে পথঘাট কেমন করে চিনল? সবচেয়ে বড় কথা সে জানল কি করে? কবির বসে পড়ল—অনেক কষ্ট হয়েছে তার।

অন্ধদের পথের দিক নির্দেশনা ভাল থাকে, তার ক্ষেত্রে হয়েছে উলটা। একবার ল্যাম্পপোস্টের সাথে জোরে ধাক্কা ও খেয়েছে সে, এর পর থেকে মাথা টা কেমন ঘুরছে। তুমি কি ঘরে একা না খদ্দের আছে কোন ?কবির লজ্জিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল। ফৌজিয়া কিছু বল্‌লনা। তার ঘোর এখনো কাটে নি।

কবির আবার বলল, একটু পানি খাওয়াও। ফৌজিয়া টেবিলের উপর রাখা জগটা দিকে এগিয়ে গেল। দরজার ওপারে ফিসফিস শুনা যাচ্ছে, এ জায়গার মেয়েদের কাছে এর আগে কোন অন্ধ লোক আসেনি, এই প্রথম, সবার কৌতূহল টা তাই অনেক বেশি। কবির পানির গ্লাস টা রেখে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। তাকে মীয়মান হলে চলবে না, সে এসেছে একটা মহৎ কার্য উদ্ধারের জন্য, অনেক কিছু জানতে হবে তাকে।

যখনই সে প্রশ্ন করতে যাবে তখন ই ফৌজিয়ার ফোঁপানির আওয়াজ পেল সে। কবিরের মনটা খারাপ হয়ে গেল, বুরবাক মেয়ে মানুষ –একটা ভুল না হয় করে ফেলেছে, এর জন্য সে কেন এখানে কৈফিয়ত চাইতে আসতে গেল? সে থাকত তার মত... কবির মন শক্ত করে বলল—কানবানা, তোমার কান্দন দেখতে আসিনাই আমি, তোমার রূপ দেখতে আইছি। দেখাও তোমার রূপ, আমি অন্ধ হইছি বইলা কি আমারে দেখাইবানা? টেকা তো দিয়া আসছি। ফৌজিয়া বলল—আমি ইচ্ছা কইরা এইখানে আসিনাই, কপালের দোষে আইছি। ইস্‌মাইল ভাই আমারে গার্মেন্টসে চাকরি দেওনের নাম কইরা লয়া আইছে এইহানে।

আমি আম্‌নেরে কেন ঠকামু কন? কেন ঠকাবা মানে?...অন্ধরে কে না ঠকায়? শোন বউ—তোমার সাত জনমের ভাগ্য তুমি আমার মত স্বামী পাইছিলা, তুমি আমারে এত বড় দুঃখ দিবা এইটা আমার জানা ছিলনা। ফৌজিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, চলেন আমরা ফেরত যাই- আমার কাছে এহন মেলা টাকা, আমরা আবার নতুন কইরা সব শুরু করতে পারুম। কবির চেঁচিয়ে উঠল--- ফেরত যাই মানে? অন্ধ হইছি বইলা কি আমার মান-ইজ্জত নাই? বেশ্যা লইয়া ঘরে উঠুম? ফৌজিয়ার কান্না আস্তে লাগল আবার। সে কিছু বললনা। পরনের কাপড় আলাদা করতে লাগ্‌ল।

কবির বুঝতে পারলনা তার মধ্যে কি হচ্ছে আসলে, নিজেকে একজন বলশালী বদমেজাজী লোক হিসেবেই চিনত সে, কিন্তু আজ সব হিসাবে কিভাবে যেন গরমিল হয়ে যাচ্ছে—তার খুব ইচ্ছে করছে ফৌজিয়াকে বলতে চল আমরা ফেরত যাই...যে যাই বলুক আমার কিচ্ছু আশা যায় না। কবির পকেটে হাত দিল। এসিডের বোতল টা খুঁজে পাচ্ছে না সে, আসলেই তো—নেই। ল্যাম্পপোস্টের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়াতে কি কোথাও ছিটকে পড়ল তাহলে? কবির মনে মনে খুশি হয়ে উঠল—তার শরীর থেকে একটা মস্ত বড় পাহাড় নেমে পড়ল যেন। এই মেয়েটা কে সে ভালবাসে---যত পুরুষের কাছেই সে যাক না কেন, সে তাকে আঘাত করতে পারবেনা।

ঈশ্বর তাকে এ ক্ষমতা দিয়ে পাঠান নি। আমি তৈয়ার হইছি,বিছানায় যাব- আপনে আসেন। ফৌজিয়ার ঝাপ্‌সা কন্ঠ শুনতে পেল সে। কবিরের কানে ছড়ার মত বাজতে থাকল সেই কন্ঠ। সে উঠে দাঁড়াল, হাতড়ে হাতড়ে দরজার দিকে চলে গেল।

তার ভালোবাসা শরীর ভোগের জন্য উৎসাহী ভাল্‌বাসা নয়---সে আরো বড় কিছু পেতে চায়। যা দেবার ক্ষমতা ফৌজিয়ার নেই, সবচেয়ে বড় কথা-তার মত একজন অন্ধ কখনো সেই ভালোবাসার আবদার রাখতে পারে না, কখনো না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।