তনুজার জন্মস্থানে সাতাশ পেরিয়ে যাওয়া মেয়েদের বিয়ে নিয়ে বেশীর ভাগ অভিভাবকদের মাঝেই একধরনের অস্থিরতার ঢেউ ওঠানামা করে। দেখতে আহামরি কিছুই নেই তনুজার। তবুও মুখের মাঝে কেমন এক লাবণ্য যেন ছুঁয়ে আছে। পড়াশুনার গন্ডি শেষ করে এলাকার এক স্কুলে নিজের অনেকটা সময় ঢেলে দেয় তনুজা। নিজের মাঝে এক আনন্দ-বেদনার কাব্য রচনা করে সে।
এখানেই গেঁথে যায় তার জীবনের নানান ছন্দমালা।
দিনশেষে বাড়ি ফিরে যখন মায়ের রান্না করা খাবার গোগ্রাসে গিলতে থাকে সে, তখন সেই খাবারের গন্ধের পাশাপাশি এক দীর্ঘশ্বাসেরও ঘ্রাণ নাকে এসে ঠেকে তার! বাবাহীন সংসারে দু'জন মানুষ তারা। তাকে নিয়েই তার মায়ের যত ভাবনা। মায়ের চোখে মেয়ের সেই রুপ গান গেয়ে যায়, যে গানে সেও সুর মিলিয়েছিল আজ থেকে কতগুলো বছর আগে!! মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়িয়েছে।
বাড়িতে আজ অন্যরকম আলো।
ঝলমল করছে চারপাশের সব প্রকৃতি। আজ মায়ের মুখেও প্রসন্ন হাসির রেখা। এই রেখা যেন ক্রমশ প্রশস্ত হচ্ছে। তনুজার জীবনের বোধকরি সেরা দিন আজ। সেরা দিনের সঙ্গিটি তনুজা থেকে বয়সে বেশ বড়।
অনেক বছর দেশের বাইরে কাটিয়েছে সে। পড়াশুনার পাঠ ওখান থেকেই চুকিয়েছে। একবার বিয়েও করেছিল সেখানে। ফুলের মত ফুটফুটে একটি শিশুও আছে তাদের। কিসব ঝামেলার কারণে সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিজের দেশেই বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তনুজার এই হবু জীবনসঙ্গী 'সুরেশ চৌধুরী'।
তনুজার পরিবারের কাছে এর কোনোকিছুই লুকোছাপা করেননি তিনি। পুরো পরিবার তার এই সুন্দর স্বীকারোক্তিতে বরং মুগ্ধই হয়েছিল। এছাড়া মায়ের ভাবনা, মেয়ের বয়সও হচ্ছে। পাত্র তো দেখতে শুনতে ভারী সুন্দর। অনেক বিদ্বানও আছে, কম কি!
নতুন জীবন শুরু হল তনুজার।
পড়াশুনায় বড় বড় ডিগ্রী নেয়া বিদ্বান আর দেখতে সুশ্রী এবং সুঠাম দেহের অধিকারী তার সহযাত্রীকে নিয়ে শুরুতেই কেমন যেন একটা গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গেল তনুজা। হতাশা এসে যেন চারপাশ কামড়ে ধরল। জীবনের সহজ অংকটা কষতে বড্ড ভুল করে ফেলেছে সে। তার কাছে কেবলই মনে হয় ছেলেবেলায় তার বাবা তাকে দোকান থেকে হরেক রকম পুতুল কিনে দিতেন আর বলতেন -' পুতুল ভালোবাসিস তাই পুতুল কিনে দেই কিন্তু নিজে কখনো পুতুল হয়ে যাসনা। ' ঐটুকুন বয়সে বাবার বলা সেই বাণী তার কাছে তেমন কিছুই মনে হয়নি।
কিন্তু আজ বড্ড মনে পড়ছে তার বাবাকে।
জোর করে কোনোকিছু আদায় করা যায়না। শরীরটাকে হয়তোবা দখল করা যায় একরকম কিন্তু মনটাকেতো আর সহজে আটকানো যায়না। মন পড়ে থাকে সেই কচিকোমল শিশুদের ভীরে। রাতজাগা পাখিদের বিরামহীন ডাকে।
রাতের বেলা অবাক জোছনার মায়ায় কিম্বা ভোরের শিউলি তলায় সাদা ফুলের সৌরভে। মায়ের হাতে রান্না করা ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে গরম গরম সরষে বাটা দিয়ে বেলেমাছ ভুনা বা জলপাই দিয়ে পুঁটি মাছের ঝোলের সেই স্বাদ এখনো যেন লেগে আছে জিহ্বায়। মনটা আনমনা হয়ে যায় তার।
একদিন গভীর রাতে ঘরের ভেতর উপচে পড়া জোছনা এসেছিল সেদিন। চঞ্চলমনে সে ছুটে গিয়েছিল গায়ে জোছনা মাখাতে।
পাশেই টের পেল কেউ একজন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। দু'জনই পরষ্পরের দিকে অপলক চেয়ে রইল ক্ষাণিকটা সময়। একসময় পুরুষ কন্ঠ ভেসে এল কানে। 'এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে কি হচ্ছে এসব! চাঁদ যেখানে থাকার সেখানেই থাকবে ওটাই তার কাজ। আলো ছড়াবে, আলোয় ভাসাবে।
আর তুমি! তুমি আলো ছড়াবে আমার ঘরে। চলে এস। বড্ড আদিখ্যেতা করছ তুমি। এর আগেও এমনটা করেছো । এসব আমার একদম পছন্দ নয়।
ঘরে এসে তুমি আমার কাজ কর। ' এরপর এক হ্যাঁচকা টানে তনুজার শরীরটা চলে আসে সুরেশের নাগালের মাঝে। কেমন যেন হিংস্র হয়ে ওঠে। এরপর ঝর থেমে সকালের রোদ্দুর দেখা যায়।
এভাবে কয়েক বছর একরকম সংগ্রাম করে,তনুজা যখন ভাবছে জীবনের কাছে নিজের সুখ, আহ্লাদ সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে সে,তখনই তার ভেতরের সত্তাটা যেন জেগে ওঠে।
তার কাছে মনে হয়- এ জীবন কোনো সুস্থ জীবন হতে পারেনা। মা আমার জীবনে সেরা একটি দিন উপহার দিয়েছে কিন্তু সেরা কোনো মানুষ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বা নিজেরও চেনায় ভুল ছিল । যে মানুষটিকে এ পর্যন্ত তার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি, যার কাছে শরীরটাই মুখ্য। মনের কোনো মূল্যায়নই করা হয়নি। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস কোনোটাই সুরেশের চোখে ফুটতে দেখেনি তনুজা।
'আজ কোনো অভিযোগ নয়। জীবন আমার। নতুন করে আমাকেই সাজাতে হবে সবকিছু মনের মত করে। কি নেই আমার! পড়াশুনার সম্পদটাতো আছে। তাকে ব্যবহার করব সঠিকভাবে।
ক্ষুদ্র জীবনে যা পেয়েছি তার জন্য দুঃখ নয়, হতাশা নয়। বিশাল এ সংসার। একটা কিছুর সাথে জড়াতে পারবোই' ....এমন এক আত্মবিশ্বাস নিয়ে সবকিছুর জাল ছিন্ন করে চলে আসে তনুজা। সামনে পড়ে আছে রঙিন দিন। স্বপ্ন দেখে চলে সে।
দু'চোখে তার অঝোরশ্রাবণ। এর উৎস কোনো বেদনা নয়, শুধুই আনন্দ। এ যেন এক কঠিন বেড়াজাল থেকে মুক্তির আনন্দজল। আজ তার আনন্দের দিন। মু্ক্তির চেয়ে বড় আনন্দ আর কীই বা হতে পারে!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।