আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রলয়ের হাতছানি-৫ম কিস্তি

প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন পূর্বের অংশ পড়তে ক্লিক করুন পূর্বে যা ঘটেছেঃ রাশিয়ান এক টপ সিক্রেট রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে দশ বছরের গবেষণা সফলের পর ডঃ মিখাইল দব্রোভলস্কির আত্নহত্যা, তবে তিনি সেটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখাতে সফল হয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার ডায়রিগুলো তার ইচ্ছানুযায়ী তার এক বন্ধুর কাছে পাঠানোর আগে ক্রিপ্টোগ্রাফি বিভাগে চেক করা হয়। সব ঠিক দেখে সেগুলো তার গন্তব্যে যাওয়ার ক্লিয়ারেন্স পেয়ে যায়, তবে ক্রিপ্টোগ্রাফার দিমিত্রি মারকভ সেগুলোর এককপি নিজের কাছে রেখে দেয় অবসরে পড়ার জন্য, যা ক্রিপ্টোগ্রাফি বিভাগের এক ক্লিনার আইভানের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ডায়রিগুলো অবশেষে ইংল্যান্ডের ডেভন কাউন্টির এক রাশিয়ান বংশদ্ভুত গ্রাম্য মহিলার হাতে এসে পৌঁছায়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অতি গোপনীয় এক বিমানের নকশা সফলভাবে পাচার করতে সক্ষম হয় ওই বিমানের প্রজেক্টের চিফ সুপারভাইজার।

১ জুলাই, ২৫,রাদে কন্দিকা রোড,ভেতেরনিক,সার্বিয়া রাত ৩টা। সামনের রাস্তাটা দিয়ে একটা - দুটো গাড়ি যাচ্ছে। আজকে একটু ঠান্ডা পড়েছে-তাপমাত্রা মোটামুটি ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। নিজের ছোট্ট বেডরুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে ভ্লাদিমির আন্তনেজ। রাতের হাওয়া মাঝে মাঝে একটু পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে।

রাস্তার বাতিগুলো জ্বলছে- সবকিছু মিলিয়ে একটা শান্ত কোমল পরিবেশ। রাস্তার ওপাড়ের গাড়ি সারানোর গ্যারেজটায় বুড়ো পেত্রভ এখনো কাজ করছে,তার ঠুংঠাং শোনা যাচ্ছে। ভবঘুরে রুশেভ একটা লাইটপোস্টের নিচে বসে মদ খাচ্ছে আর ঝিমোচ্ছে। এরকম রাত জাগা আন্তনেভের এর জন্য নতুন কিছু নয়। প্রায়ই তাকে রাতে জেগে থাকতে হয়, দুঃস্বপ্নগুলোকে তাড়াতে।

আন্তনেভ মোটামুটি চৌত্রিশ বছর বয়সের যুবক, পাক্কা ছয়ফুট চার ইঞ্চি হাইট, ফরসা,নীল চোখ। হালকা চাপদাড়ি আছে তার। গত তিন বছর ধরে ভেতেরনিকে বাস করছে সে। কাজ করে স্থানীয় একটা পুরনো গাড়ির দোকানে, ম্যানেজার হিসেবে। বেতন যা পায় তাতে তার একার ভালোই চলে যায়।

তার ভেতেরনিকে আসার কাহিনী খুবই আজব। তিনবছর আগে তাকে রক্তাক্ত অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসে দুজন লোক। তাদের চলন্ত গাড়ির সাথে হঠাৎ এসে পড়ে আন্তনেভ,ধাক্কাটা এড়ানো যায়নি। জ্ঞান ফেরার পর আন্তনেভ নিজের নামটা ছাড়া কিছুই মনে করতে পারছিল না, ডাক্তাররা ধরে নেয় এটা তার মাথার আঘাতের কারণে। তার সাথের কাগজপত্র দেখে পুলিশ বের করে যে সে উত্তরের সুবোটিকা থেকে চাকরির সন্ধানে এসেছে,বাবা মা কয়েকবছর আগে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে,তারাই ছিল আন্তনেভের একমাত্র আত্নীয়।

পুলিশ খুব বেশি খোঁজখবর করার গরজ দেখায়নি,ভেতেরনিকে তখন একটা বড় মাপের ডাকাতি হয়েছিল,সেই কেস সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছিল তারা। যাদের গাড়ির সাথে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তাদেরও তেমন কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি,আন্তনেভ বেঁচে গিয়েছিল বলে। তবে আন্তনেভ যে কাজের সন্ধানে এসেছিল সেটা ততদিনে আরেকজন নিয়ে নিয়েছে। আন্তনেভ তখন স্মৃতি হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ভাগ্যক্রমেই সে হাসপাতালে ইউজিন পেরেলমান নামে এক বুড়ো ভদ্রলোকের সাথে পরিচিত হয়, তাঁর পুরনো গাড়ি বেচাকেনার ব্যবসা আছে এবং তাঁর একজন ম্যানেজার দরকার।

আন্তনেভকে তাঁর ভালো লেগে যায়, তিনি আন্তনেভকে বুঝিয়ে চাকরিটা দিয়ে দেন। আন্তনেভও আপত্তি করেনি। কারণ বেঁচে থাকতে হলে উপার্জন তো করতেই হবে। গত তিনবছরে আন্তনেভ সেই বুড়ো ভদ্রলোক আর তাঁর স্ত্রীর অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। তাদের কোন সন্তান নেই,তারা আন্তনেভকে নিজেদের ছেলের মতোই দেখেন, আন্তনেভও তাদের বাবা মার মতোই দেখে।

মাঝে মাঝে তাঁর ইচ্ছা হয় একবার সুবোটিকা যাবে, নিজের শেকড়ের সন্ধানে, কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। তার নিজের অতীত জীবন সম্পর্কে কিছুই মনে নেই,তার জন্য জীবন যেন গত তিনবছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে। তাকে বুড়োবুড়ি মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে বলে, কিন্তু আন্তনেভের একটু সংকোচ বোধ হয়,তাই সে এখনো এই ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টটাতেই থাকে। তিনবছর ধরে সে বেশ ভালোই আছে, শুধু কিছু দুঃস্বপ্ন তার জীবনটাকে পুরোপুরি শান্ত হতে দেয়না। দুঃস্বপ্নগুলো সে যে প্রতি রাতেই দেখে তা না, তবে প্রতি তিন চারদিন পর পরই তাকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়।

স্বপ্নগুলো আসে ঝাপসাভাবে। কখনো সে দেখে সে অনেক উঁচু বাড়ির ছাদে বসে আছে, সামনে বড় আকারের স্নাইপার রাইফেল। কখনো দেখে একটা অফিসের ভেতর দিয়ে সে হাঁটছে। তবে যে স্বপ্নগুলো তার নির্ঘুম রাতের কারণ সেগুলোতে সে দেখে যে সে মানুষ খুন করছে। কখনো লাশ টেনে নিয়ে ঝোপের ভেতর ঢুকাচ্ছে, কখনো স্নাইপার দিয়ে কারো মাথা ফুটো করে দিয়ে শান্তভাবে চলে যাচ্ছে।

অনেক সময় সে দেখে তার সাথে কিছু মানুষ কথা বলছে। এরমধ্যে একটা বিশেষ স্বপ্ন হচ্ছে পুরোই অন্ধকার,শুধু সে কানে শুনতে পাচ্ছে তার কানে কানে কেউ যেন বলছে,"তোমার নাম ভ্লাদিমির আন্তনেভ। ভাল থেকো বাছা। " ইউজিনকে সে কথা বলতেই সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে এই বলে যে আন্তনেভ সম্ভবত থ্রিলারের ভক্ত ছিল। আন্তনেভ তাই আর কারো সাথে তার স্বপ্নগুলোর কথা শেয়ার করে নি।

আন্তনেভ অবিবাহিত। বুড়ো ইউজিনের পাশের বাড়ির মেয়েটা তার প্রতি দুর্বল,এটা সে কিছুদিন আগে বুঝতে পেরেছে। আন্তনেভ গত তিনবছরে তার কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা আবিষ্কার করেছে। সে অনেকগুলো ভাষা জানে। তাকে কেউ নজরে রাখলে সে সেটা ধরতে পারে।

রাস্তাঘাটে চলতে থাকলে আশেপাশের মানুষের কাজকর্ম তার চোখ এড়ায় না। মেয়েটার সাথে এক দুবার কথা হয়েছে তার। সে খেয়াল করেছে মেয়েটা তাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করে মাঝে মাঝে। তারও মেয়েটাকে ভালোই লাগে। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী, বয়স ছাব্বিশের মতো হবে।

মেয়েটার পেছনে এক আধজনকে সে ঘুরতেও দেখেছে, কিন্তু মেয়েটা পাত্তা দেয় না তাদের। সে মনে মনে ভেবেছে সে সম্পর্কটা আগে বাড়াবে। কিন্তু তার ভেতরে একটা দ্বিধাবোধ কাজ করে। নিজের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ জাগে তার মাঝে মাঝেই। স্বপ্নগুলো তাকে রাতে ঘুমোতে দেয় না।

তার অস্বাভাবিক ক্ষমতাগুলো তার পরিচয় নিয়ে সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আন্তনেভের ভেতরে আরেকটা স্বত্বা কাজ করে। সেটা তাকে নিজের বর্তমানকে মেনে নিয়ে জীবনযাপন করতে বলে, মেয়েটার সাথে সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখায়। বিস্মৃত অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে বলে। আজ আর ঘুম হবে না, বুঝতে পারছে আন্তনেভ।

জানালার কাছ থেকে সরে এসে বিছানায় শুয়ে পাওলো কোয়েলহোর "দ্য ফিফথ মাউন্টেইন" বইটা পড়তে লাগলো। অর্ধেক পড়া হয়ে গেছে আগেই, বাকি অর্ধেক দোকানে যাবার আগে শেষ করবে বলে ঠিক করলো। বইটা বেশ ভালো লাগছে। আজ অনেক কাজ আছে তার। ইউজিন আর তার বউ রাশিয়াতে বেড়াতে যাবে।

সেখানে তাদের আত্নীয় আছে। দুপুরে তাদের নিয়ে এয়ারপোর্টে যেতে হবে। এদিকে অ্যালিসভিলে তখন রাত ২টার কিছু বেশি বাজে। অ্যানা মিয়োস্কি তখন ডঃ মিখাইলের ডায়রিগুলো পড়ছে। সে গত কয়েকদিন ধরে প্রতি রাতে ডায়রিগুলো পড়ে।

মাঝে মাঝে আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদেও দেয়। সে তার আবেগকে কখনো ঠেকায় না, কারণ সে জানে এটা তাকে সন্দেহমুক্ত থাকতে সাহায্য করবে। ডায়রিগুলো যে সম্পুর্ণ নজরের বাইরে আসেনি সেটা অ্যানা আন্দাজ করতে পেরেছিলো। ডায়রিগুলোর প্রতিটার কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় একটা করে অতি ক্ষুদ্র ক্যামেরা লাগানো আছে, এটা সে জানতে পেরেছে। ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স এ তার সংস্থার লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

এসব গোপন ক্যামেরা বা গোয়েন্দাযন্ত্র লাগানোর কাজ যে উপ বিভাগ করে সেখানে তাদের লোক আছে। প্রতিটা ডায়রিতেই কিছু চিহ্ন দেয়া আছে যেগুলো অন্য কেউ বুঝবে না, স্বাভাবিক দাগ মনে করবে। কিন্তু অ্যানা সেটা বুঝতে পারে, কারণ এই চিহ্নগুলো দেয়ার ব্যাপারটাও প্ল্যান করা ছিল। তার চশমাতে অতি ক্ষুদ্র ক্যামেরা আছে,যেটা নিখুঁতভাবে ডায়রিগুলোর লেখার ছবি তুলে নিচ্ছে। ডায়রি তার কাছেই থাকবে, তথ্যগুলো চলে যাবে বহু দূরে।

নিখুঁত প্ল্যান, সবকিছু পরিকল্পনামতোই হচ্ছে। আর বেশি দেরি নেই। বদলার সময় এসে গেছে। অ্যানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডায়রি পড়তে লাগলো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।