বসে আছি পথ চেয়ে....
হাত নেই, পা নেই নাক নেই, কান নেই এমনকি মাথা পর্যন্তও নেই, এরকম মানুষও হয়তো পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এ রকম মানুষ পাওয়া যাবে কি? মানুষ হলে তার ‘মুদ্রাদোষ’ থাকবেই (অনেকটা যেনো দাম্পত্য কলহের মতো দম্পতি হলে খিটমিট লাগবেই)। কথায় আছে মুর্খের শতেক দোষ। আর বাঙালির হাজার হাজার দোষ। অবশ্য এর বেশির ভাগই মুদ্রাদোষ (আর এ দোষ খোঁজাটাও যাকে বলে ছিদ্রান্বেষণ-এটিও একটি বড় মুদ্রাদোষ)। কিছু মুদ্রাদোষ আছে যা আমাদের নিয়ত বঞ্চনাপূর্ণ জীবনে যতেষ্ট আনন্দের খোরাক হিসেবে আসে।
আমার এক পরিচিত লোকের কাহিনি দিয়েই শুরু করি। ভদ্রলোক প্রতি বাক্যের শুরুতে কিংবা শেষে অথবা অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থানে ‘আপনার’ ব্যবহার করবেই। ভদ্রলোক একদিন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন: কালরাতে অনেক দেরি করে ‘আপনার’ বাসায় ফিরেছিলাম। গিয়ে দেখি ‘আপনার’ স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছে। ‘আপনার’ এমন বেগতিক ঘুম যে আর জাগাতে সাহস পেলাম না।
তারপর ‘আপনার’ আলোটা নিভেয়ে আপনার স্ত্রীর পাশে শুয়ে পড়লাম। খানিক পর ‘আপনার’ ঘরের মধ্যে একটা শব্দ হলো। ‘আপনার’ স্ত্রী চিৎকার দিয়ে আমাকে জাপটে ধরলো। এরপর আমি আলোটা জ্বালিয়ে দেখি ‘আপনার’ একটা বিড়াল। এরপর ‘আপনার’ স্ত্রী আর ঘুমুতে দেয়নি।
এবার চিন্তা করুন অবস্থাটা। ‘আপনার’ ঠ্যালায় কার বউ কার হেয়েছে! তবে প্রচলিত মুদ্রাদোষ গুলোর মধ্যে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ এর আধিক্য বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’-এর স্রোতে ভেসে যেতে হয়। শেষ পর্যন্ত বক্তা যে কী বলতে চান আর কিছুই বোঝা যায় না। এমনই একজন বক্তার উক্তি: মানে এই যে রাজনীতি, মানে সমস্ত ব্যাপারটা যদি ভেবে দেখা যায়, মানে তাহলে মানে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মানে ব্যাপারটা মানে।
অথবা এই যে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস বুঝেছেন, সন্ত্রাস আসলে মানে বুঝেছেন, মানে ধরুন রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে ব্যাপারটা হচ্ছে মানে ধরুন ব্যাপারটা বুঝেছেন কি না।
এর পর বুঝতে পারা আসলেই মুসকিল। এদের সঙ্গে কথা বলতে হলে সীমাহীন ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। আমার এক বন্ধু আছে যে কথা আরম্ভ করে ‘কথা হচ্ছে কিনা জানিস? বিএনপি আসলে কথা হচ্ছে মূলত সাম্প্রদায়িক দল, এখন কথা হচ্ছে আওয়ামী লীগের কথা হচ্ছে আগের মতো অসাম্প্রদায়িক চেতনা, কথা হচ্ছে-এভাবে 'কথা হচ্ছে' দূর পাল্লায় নাইট কোচের মতো চলতেই থাকে। আমার এক শিক্ষক এক ব্যতিক্রমধর্মী মুদ্রাদোষ লালন করতেন-যদি বলি কেন।
তার ভাষায়, এদেশের বুদ্ধিজীবীরা আসলে ফালতু, যদি বলি কেন, এদের সামাজিক দায়বদ্ধতা বলে কিছুই নেই, যদি বলি কেন, এদের মেরুদণ্ড বলে কিছুই নেই, যদি বলি কেন...।
এছাড়া প্রায় প্রতিটি বাঙালির যেমন গ্যাসিট্রক বা অ্যাসিডিটির সমস্যা আছে, তেমনি রয়েছে অকথ্য বা স্ল্যাং বলার অভ্যাস। এ ব্যাপারে উদাহরণ না দেয়াটাই স্বাস্থ্যসম্মত। আর এটাকে মুদ্রাদোষ না বলে বর্বরতা বলাই শ্রেয়।
সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালির মধ্যে দেখা যায়, সেটা হচ্ছে বাংলা কথাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ।
‘আমরা আংকেল অর্থাৎ মামা, মিডলইস্ট অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমার জন্য একটা গোল্ড চেইন অর্থাৎ সোনার হার পাঠিয়েছেন অথবা আমি মানে এক সময় খুব ভাল ছাত্র ছিলাম: আই ওয়াজ এ ভেরি ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এবসোলিউটলি মিনিংলেস। শুধু তাই নয়, এরা চান্স পেলেই ‘আমার ফাদার মানে বাবা’ কিংবা ‘আমার ওয়াইফ মানে স্ত্রী’-র (নারীদের সিংহভাগ জুড়ে ‘আমার হাজবেন্ড অর্থাৎ ও-র গুণগান শোনা যায়) গল্প শুনিয়ে ছাড়েন।
আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রসঙ্গ পেলেই বলে ওঠে, আমার ফাদার বুঝেছিস, এতো অনেস্ট ছিলেন যে সারা জীবন এক পয়সাও ঘুষ খাননি। আবার আরেক বউ-পাগল বন্ধু কথায়-কথায় ওয়াইফের প্রসঙ্গ টেনে আনে। হোটেলে ভাত খেতে বসেছি এ সময় তার বিবৃতি: আমার ওয়াইফ জানিস কিনা জানি না, এতো ফাস্ট-ক্লাস রান্না করে যে একবার খেলে জীবনে ভুলতে পারবি না।
অথবা জানিস আমার ওয়াইফ না অদ্ভুত রিসাইট করে, ওর কন্ঠ এতো সুন্দর, একবার শুনলে পাগল হয়ে যেতে হয়।
আমাদের বেঁচে থাকার অনেক ঝামেলা আছে। বেঁচে থাকতে হলে এসব বক্তব্য হজম করতেই হবে। কারো বাবা মানে ফাদার, স্ত্রী মানে ওয়াইফ, যেমন হোক না কেন এতে যে আপনার আমার কিছুই যায় আসে না, কেউ তা জানবার জন্য উদগ্রীব নয়-এটা তাদের বোঝাবে কোন মূর্খ!
আমাদের দেশে বিদ্যমান রাজনীতিতেও মুদ্রাদোষ লক্ষ করা যায়। যেমন আওয়ামী মুদ্রাদোষ-জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বা আদর্শ, সোনার বাংলা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ, খেটে খাওয়া মানুষ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি।
জাতীয়তাবাদী মুদ্রাদোষ-দেশ বিক্রি, দেশ রক্ষার আন্দোলন, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, ক্ষমতায় থাকতে দেয়া যায় না, শহীদ জীয়ার স্বপ্ন-সাধ, বর্জন, শর্ত, হরতাল ইত্যাদি। এসব মুদ্রাদোষ বিষয়ে সাবধান এবং সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
তবে সমস্ত মুদ্রাদোষকে ছাপিয়ে ওঠে শারীরিক মুদ্রাদোষ। এধরনের লোকেরা বসে বসে দোলেন, হাঁটু নাচান, হাত-পা নাড়েন নানা রকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষ মারা, টেবিল চাপড়ানো-এসব ভয়ানক মর্মস্পর্শী উপসর্গ অনেকের দেখা যায়।
আমার একজন ঘনিষ্ঠজন আছেন যিনি বেশি ফুর্তি হলে অথবা বেশ হাসি বা মজার কথা হলে ইহি ইহি করতে করতে নারী-পুরুষ নির্বশেষে পাশের ব্যক্তিকে সাপটে ধরেন এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে বিনা উস্কানিতে কিলঘুসি মেরে তা প্রকাশ করেন (তার স্ত্রীর এখন এসব গা-সওয়া হয়ে গেছে, তিনি তার হাজব্যান্ডের এই প্রচণ্ড কিল-চড়-ঘুষি নাকি রীতিমতো উপভোগ করেন)! এসব লোক থেকে কম পক্ষে তিন গজ দূরত্ব বজায় রাখা কর্তব্য, বিশেষত মেয়েদের।
আসলে মুদ্রাদোষের কোনো শেষ নেই। আর এ সংক্রান্ত জটিলতার হাত থেকেও তাই মুক্তি নেই। বেঁচে থাকার কত জ্বালা!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।